অফিসে যৌন হয়রানি কী, শিকার হলে যা করবেন
কর্মক্ষেত্র শুধু উপার্জন নয়, এটি মানবিক সম্পর্কের জায়গা। প্রতীকি ছবি: পেক্সেল
রিনা (ছদ্মনাম) কাজ করেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়। দিনভর মেশিনের শব্দ, টার্গেটের চাপ, ঘাম আর ক্লান্তির মধ্যেই তার দিন চলে যায়। কিন্তু একদিন ম্যানেজারের অশোভন আচরণে তার পৃথিবীটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। ভয়, লজ্জা আর অপমানে তিনি চুপসে যান। গুটিয়ে যান নিজের ভেতর। রিনার এ গল্প তার একার নয়। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরছেন।
পরিসংখ্যানের ভেতরে শঙ্কা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের এক জরিপ বলছে, দেশের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন। গার্মেন্টস, অনানুষ্ঠানিক খাত ও সেবাখাতের নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই এ নিয়ে কোনো অভিযোগ তোলেন না। কারণ তারা জানেন, অভিযোগ মানে চাকরি হারানোর ভয়, সহকর্মীর সন্দেহের চোখ, আর সমাজের দোষারোপ।
হয়রানির রূপ বদলেছে, সচেতনতা কম
যৌন হয়রানি মানে শুধু স্পর্শ নয়। অশালীন মন্তব্য, কটূ রসিকতা, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি বা ডিজিটাল হয়রানিও এর মধ্যে পড়ে। ২০০৮ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি কর্মস্থলে এ ধরণের অভিযোগ গ্রহণের কমিটি রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে সেই ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তাই অনেক নারীই জানেন না, অনাকাঙ্ক্ষিত এ রকম আচরণের ক্ষেত্রে তিনি কী করবেন, কোথায় যাবেন!
অফিসে যৌন হয়রানি বলতে কী বোঝায়
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তাদের দাপ্তরিক নীতিমালায় নিচের উদাহরণগুলো তুলে ধরেছে:
ক. দৃষ্টিগত ও লিখিত আচরণ:
লালসাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, ই-মেইলসহ যেকোনো মাধ্যমে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ, অশ্লীল অথবা আবেদনপূর্ণ ভাষায় চিঠি, নোট, শুভেচ্ছা কার্ড অথবা আমন্ত্রণপত্র, ছবি, ভিডিও, কার্টুন, দেওয়ালচিত্র বা পোস্টার ইত্যাদি প্রেরণ।
খ. মৌখিক আচরণ:
শিস দেওয়া, বাজে ভঙ্গিতে কথা বলা, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার, অবমাননাকর মন্তব্য করা যা যৌন প্রকৃতির, যৌনক্রিয়া/আচরণ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা, নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মন্তব্য করা, অন্য কারো যৌন কার্যকলাপ/আচরণ এবং/অথবা যৌনসঙ্গী সম্পর্কে গুজব ছড়ানো। এমন কৌতুক বলা যার বিষয়বস্তু আপত্তিকর, অশ্লীল বা কামোদ্দীপক। যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ/প্রস্তাব।
গ. শারীরিক আচরণ:
অবাঞ্চিত/অনভিপ্রেত স্পর্শ, যৌন পীড়ন, চুম্বন/আলিঙ্গন/জড়িয়ে ধরা, যৌন সংসর্গ বা অন্য কোনো ধরনের যৌন কাজে লিপ্ত হতে কাউকে বাধ্য করা। চলাচলের সময় বাধা দেওয়া বা গতিরোধ করা, স্বাভাবিক কাজ বা চলাফেরায় শারীরিকভাবে বাধা দেওয়া, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি।
মানসিক ট্রমার যখন এক যুদ্ধ
হয়রানির ঘটনার পর ট্রমা কাটানো ভীষণ কঠিন। মানসিক আঘাত, আত্মসম্মান দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হওয়া, একাকিত্ব — সব মিলিয়ে নারীদের অনেকে একটা সময় কাজ ছেড়ে দেন। এই সময়ে তাদের দরকার সহকর্মীদের সংবেদনশীল আচরণ, পরিবারেরও উচিত তাদের পাশে থাকা, আর প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিলিং বা মানসিক সহায়তা ব্যবস্থাও অত্যন্ত জরুরি। একটু সহানুভূতি একজন ভুক্তভোগীকে নতুন করে জেগে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
পরিবর্তনের পথ
সচেতনতা থেকেই শুরু হোক পরিবর্তন। প্রতিটি কর্মস্থলে এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণে কমিটি সক্রিয় করতে হবে। ভুক্তভোগীকে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। নিয়মিত এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সংবেদনশীলতা-বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা জরুরি। নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়া ও পুরুষ সহকর্মীদের অংশগ্রহণ ছাড়া এ পরিস্থিতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। কর্মক্ষেত্র শুধু উপার্জনের জায়গা নয়, এটি মানবিক সম্পর্কেরও জায়গা। সেখানে নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। কারণ নিরাপদ কর্মপরিবেশই আসলে সবার কাজের প্রেরণা।
সূত্র: ইউএন ওমেন ও বিআইজিডির ‘ভয়েজিং অ্যান্ড চ্যালেঞ্জিং ওয়ার্কপ্লেস সেক্চুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ ২০২২
আরএমডি