দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
গাজায় ভয়াবহ আগ্রাসন, একঘরে হয়ে পড়ছে ইসরায়েল
গাজা শহরের ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল/ ছবি: এপি, ইউএনবি
গাজায় ভয়াবহ আগ্রাসন চালিয়ে আরও একঘরে হয়ে পড়ছে ইসরায়েল। গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে গাজা শহরে বিতর্কিত স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনারা (আইডিএফ)। পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইসরায়েল একটি সিদ্ধান্তমূলক মুহূর্তে রয়েছে।’
বিমান হামলা ও কামানের গোলার আড়ালে ইসরায়েলি বাহিনীর দুটি ডিভিশন শহরের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোর দিকে অগ্রসর হয়, আরও দুটি ডিভিশন রিজার্ভে রাখা হয়। এখন পর্যন্ত সেনারা শহরের উপকণ্ঠেই অবস্থান করছে, তারা তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে গাজা শহরকে। বেসামরিক নাগরিকদের দক্ষিণে পালানোর জন্য পশ্চিম দিকের উপকূলীয় সড়ক খোলা রাখা হয়েছে।
তবে অধিকাংশ বাসিন্দা সরে যাচ্ছেন না। আনুমানিক দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ মানুষ শহর ছাড়লেও প্রায় ছয় লাখ রয়ে গেছেন। বহু পরিবার একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। নিরাপদে দক্ষিণে যেতে পরিবহন ব্যয় ও তাঁবুর অস্বাভাবিক দাম বহন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে ক্রমাগত বোমাবর্ষণের মধ্যেও অনেকে গাজা শহরেই অবস্থান করছেন।
আরও পড়ুন>>
- গাজা সিটি খালি করতে হামলার গতি বাড়ালো ইসরায়েল, একদিনেই নিহত ৪৯
- ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরপর গাজা সিটিতে বোমা ফেলছে ইসরায়েল
- ফিলিস্তিনিদের আক্ষেপ/ পশুরাও আমাদের চেয়ে ভালো জীবন কাটাচ্ছে
- গাজায় ৭০০ বছরের পুরোনো মসজিদ গুঁড়িয়ে দিলো ইসরায়েল
এ দৃশ্য অনেকটা যুদ্ধের শুরুতে হওয়া প্রথম বড় আক্রমণের পুনরাবৃত্তি। তখনো ইসরায়েলি বাহিনী গাজা শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল এবং নেতারা হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রায় দুই বছরে অন্তত ৬৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, বহু এলাকায় মানুষ অনাহারে ভুগছে।
ইসরায়েলে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব বাড়ছে
ইসরায়েলের ভেতরেও যুদ্ধবিরোধী মনোভাব এখন অনেক তীব্র। ২২ মাস আগে গাজায় হামলার সময় জনসমর্থন ছিল প্রায় সর্বসম্মত। কিন্তু বর্তমানে জরিপ বলছে, ইসরায়েলিদের ৭০ শতাংশ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নয়, বরং যুদ্ধবিরতির পক্ষে। সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইইয়াল জামিরও মনে করেন, হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব নয়, আর দীর্ঘমেয়াদি এই লড়াইয়ে অবশিষ্ট জিম্মিদের জীবনও বিপন্ন হবে। তার পছন্দ যুদ্ধবিরতি, যাতে জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা যায়।
ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, গাজা শহরে হামলা চলার সময় কিছু জিম্মিকে মানবঢাল হিসেবে কেন্দ্রীয় এলাকায় সরিয়ে আনা হয়েছে। অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জেরুজালেমে নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে জিম্মিদের স্বজনরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের অভিযোগ, এই পদক্ষেপ মানে সন্তানদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া।
বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ
ইসরায়েলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক কর্তাদের মধ্যে মতপার্থক্য নতুন নয়। তবে এবার পরিস্থিতি উল্টো—নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর, কারণ তার টিকে থাকা নির্ভর করছে অতিদক্ষিণপন্থি মিত্রদের সমর্থনের ওপর।
অন্যদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ শিগগির ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি পুনর্বিবেচনার হুমকি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে হামাসকে হুঁশিয়ারি দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘সব বাজি শেষ—অবিলম্বে সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে।’ তবে কূটনৈতিক মহলে ধারণা, এই অভিযানও যদি শেষ পর্যন্ত হামাসকে পুরোপুরি দুর্বল করতে না পারে, তাহলে ওয়াশিংটন যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেবে।
সব মিলিয়ে, গাজা শহরে এই নতুন আক্রমণ ইসরায়েলের জন্য বিজয় নয়, বরং আরও রক্তপাত, ফিলিস্তিনিদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গভীরতর একাকিত্ব বয়ে আনবে।
কেএএ/