যাদের হাত ধরে ক্ষমতায়, তাদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট!
মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট পালানোর পর ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী/ ফাইল ছবি: এএফপি
যাদের হাত ধরে ক্ষমতায় বসেছিলেন, তাদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত হলেন মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা! সেই শক্তির নাম সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিট ‘ক্যাপসাট’। ২০০৯ সালে রাজোয়েলিনাকে ক্ষমতায় বসাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ‘ক্যাপসাট’। এখন রাজোয়েলিনা দেশ ছেড়ে পালানো ও সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের জেরে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে শক্তিশালী এই সেনা ইউনিটটি।
ক্যাপসাট কী?
মাদাগাস্কারের ক্যাপসাট (CAPSAT) হলো দেশটির সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ও প্রভাবশালী ইউনিট, যার পূর্ণ নাম ‘Corps des personnels et des services administratifs et techniques des armées’ — অর্থাৎ সামরিক প্রশাসনিক ও কারিগরি সেবা কর্পস।
এটি মূলত একটি সামরিক ইউনিট, যা প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত কাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দেশটির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের ইতিহাসও বহন করে।
আরও পড়ুন>>
জেন-জি বিক্ষোভের মুখে এবার দেশ ছেড়ে পালালেন মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট
মাদাগাস্কারে সরকারবিরোধী জেন-জি বিক্ষোভে অংশ নিলেন সেনা সদস্যরা
প্রকাশ্যে এলেন মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট, ফেসবুক লাইভে ‘বিস্ফোরক মন্তব্য’
২০০৯ সালের অভ্যুত্থানে এই ক্যাপসাট ইউনিট বড় ভূমিকা রেখেছিল। তখন তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মার্ক রাভালোমানানার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেয়, যা শেষ পর্যন্ত তার পতন এবং আন্দ্রি রাজোয়েলিনার ক্ষমতায় আরোহণের পথ তৈরি করে।
এই ইউনিটটি রাজধানী আনতানানারিভোতে অবস্থিত এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত ও আধুনিক শাখাগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত।
২০২৫ সালের চলমান রাজনৈতিক সংকটেও ক্যাপসাট আবার আলোচনায় এসেছে। কারণ তারা এবার প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
অধিকার আদায়ে আন্দোলন
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও মাদাগাস্কার বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, মাদাগাস্কারের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে।
দেশটিতে প্রথমে পানি ও বিদ্যুৎ সংকট ঘিরে বিক্ষোভ শুরু হলেও পরে তা বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আন্দোলনের প্রথম দিকের কয়েক দিনে অন্তত ২২ জন নিহত এবং এক শতাধিক আহত হয়। সরকার অবশ্য এই সংখ্যা অস্বীকার করেছে।
১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি বারবার রাজনৈতিক অস্থিরতায় কেঁপে উঠেছে। ২০০৯ সালে গণবিক্ষোভে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মার্ক রাভালোমানানাকে পদত্যাগে বাধ্য করে যখন রাজোয়েলিনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। এর ফলে তিনি হয়ে ওঠেন আফ্রিকার সবচেয়ে কমবয়সী সরকারপ্রধান।
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
দেশ ছেড়ে পালানোর গুঞ্জনের মধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছেন মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা। ফেসবুক লাইভে তিনি অভিযোগ করেছেন, তার ওপর প্রাণঘাতী হামলার চেষ্টা এবং অভ্যুত্থানের আশঙ্কার কারণে তিনি বর্তমানে একটি ‘নিরাপদ স্থানে’ রয়েছেন।
তার দাবি, একদল সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিক তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল।
৫১ বছর বয়সী রাজোয়েলিনা তার অবস্থান প্রকাশ না করলেও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, তিনি এরই মধ্যে ফরাসি সামরিক প্লেনে করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
আরও পড়ুন>>
জেন জি আন্দোলনে আরও এক দেশে সরকার পতন
মাদাগাস্কারে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলো সেনাবাহিনী
মাদাগাস্কারে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বললো জেন জিরা
রাজোয়েলিনার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন উপদেষ্টা এরই মধ্যে পার্শ্ববর্তী মরিশাসে পালিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান এনৎসে এবং ব্যবসায়ী মামিনিয়ান রাভাতোমাঙ্গা।
সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল
বিক্ষোভের মুখে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। একজন কর্নেল ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
এ ঘটনার আগে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনাকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন মাদাগাস্কারের সংসদ সদস্যরা। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) দেশটির জাতীয় পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটে ১৩০টি ভোট রাজোয়েলিনাকে অভিশংসনের পক্ষে পড়ে।
তবে অভিশংসন ভোট অনুষ্ঠানের নিন্দা করেছেন রাজোয়েলিনা। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি অভিযোগ করেন, জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া সত্ত্বেও সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে ভোটটি ‘অসাংবিধানিক’ বলে দাবি করেন তিনি।
জেন জি বিক্ষোভে সরকার পতন
তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের মুখে অক্টোবরের শুরুতেই সরকার ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা। তবে তাতেও মাঠ ছাড়েনি জেন জি প্রতিবাদীরা। তারা প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রেসিডেন্টেরও পদত্যাগ চান এবং দুজনকে প্রকাশ্যে জাতির কাছে ক্ষমতা চাওয়ার আহ্বান জানান।
তবে পদত্যাগ না করার ব্যাপারে অনড় থাকেন প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা। এরপর সেনাবাহিনীর সমর্থন হারালে তাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে ফরাসি নাগরিকত্ব পাওয়া রাজোয়েলিনাকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তির আওতায় ফরাসি সামরিক প্লেনে করে দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সূত্র: এএফপি, ডয়চে ভেলে, বিবিসি, উইকিপিডিয়া
কেএএ/