পাক-আফগান সংঘাতের মূলে পশতু ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ প্রশ্ন, সীমানাবিরোধ?
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত/ ফাইল ছবি: এএফপি
দীর্ঘ দিনের মিত্র থেকে শত্রুতে পরিণত হয়েছে প্রতিবেশি দুই দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে বহু সেনা ও সন্ত্রাসী সদস্যদের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালানো সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) কে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে আফগানিস্তান সরকার। এক্ষেত্রে ভারত এ সংগঠনটিকে অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করছে। তবে এসব অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছে আফগান তালেবান সরকার।
সাম্প্রতিক এ ধারাবাহিক হামলায় দুই দেশের শতাধিক সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তানের বিমান ও সামরিক আক্রমনে আফগান সীমান্তে বহু সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হলেও হামলা বন্ধ হয়নি। যুদ্ধবিরতির মধ্যেই শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) পাকিস্তানের বিমান হামলায় দশ আফগান নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।
সংঘাতের মূল কারণ
‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’ কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত কবিতার এ লাইনটি যেন বিশ্বের সকল স্বাধীনতাকামী জনতাকে প্রতিফলিত করছে। পাক-আফগান সীমান্তে চলমান এ সংঘাতের মূলে রয়েছে একটি শব্দ স্বাধীনতা। কাল্পনিক সীমারেখা ডুরান্ড লাইন দ্বারা পশতু জাতিকে ভৌগলিকভাবে বিভক্ত করা গেলেও আত্মিক বিভাজন সম্ভব হয়নি। পশতু জাতির স্বাধীনতা পাবার আকাঙ্ক্ষাই সাম্প্রতিক এ সংঘাতের মূল কারণ।
পশতু জাতি আসলে কারা?
হাজার বছর ধরে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাস করা পশতু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীই মূলত পশতু জাতি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে পশতু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ৬ থেকে ৭ কোটি যাদের অধিকাংশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে বসবাস করে। তবে তার নিজেদের পাঠান হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলটি ‘পশতুনিস্তান’ নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ৭০-৮০ শতাংশ পশতু জাতির বসবাস।এছাড়াও কোহাট, বান্নু, দেরা ইসমাইল খান, সোয়াত, মানসেহরা, চিত্রাল এবং বেলুচিস্তানের কোয়েটা, চামান, লোরালাই অঞ্চলেও পশতুদের বসবাস রয়েছে। এসব অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম ইউসুফজাই, আফ্রিদি, মেহসুদ গোষ্ঠী। পশতুদের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের পেশোয়ার।
ডুরান্ড লাইন ও পশতু জাতির পরাধীনতা
ঐতিহাসিকভাবে যুদ্ধে পারদর্শী পশতু বা পাঠানদের আক্রমন থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে আফগানিস্তানের রাজা আমির আবদুর রহমান খান এবং ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব স্যার মর্টিমার ডুরান্ড একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৮৯৩ সালে ২,৬৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেখা সীমারেখা নির্দিষ্ট করার এ চুক্তিই পরবর্তীতে ডুরান্ড লাইন হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা পেলে এই ডুরান্ড লাইন বরাবর ভাগ হয় আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সীমান্ত। এতে পশতু জনগনের একটি বড় অংশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ফলে ‘পশতুনিস্তান’ নামে যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা এ জাতির ছিল তা চিরতরে শেষ হয়ে যায়। তবে ঔপনিবেশিক বিভাজন বলে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এ সীমারেখা অস্বীকার করে।
টিটিপি সন্ত্রাসী নাকি স্বাধীনতাকামী সংগঠন
পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর সাম্প্রতি যেসব সন্ত্রাসী হামলা ঘটনা ঘটেছে তার নেতৃত্ব দিয়েছে তেহরিক ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে বৈতুল্লাহ মেহসুদ টিটিপি প্রতিষ্ঠা করেন। টিটিপি মূলত পশতু জাতির স্বাধীনতা চায়। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া,বেলুচিস্তানের কোয়াট, চামান,সোয়াত ইত্যাদি সীমন্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘পশতুনিস্তান’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়।
তবে ভৌগলিক সার্বভৌমত্ব জন্য হুমকি হওয়ায় পাকিস্তান টিটিপি কে ফিত্না-আল-খারিজ বা সন্ত্রসী হিসবে চিহ্নিত করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ের এসব হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মাহসুদ। নূর ওয়ালি মেহসুদ ২০১৮ সালে টিটিপির নেতৃত্বে আসেন। কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে মেহসুদ টিটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন, নতুন কৌশল নিয়েছেন এবং বিভক্ত গোষ্ঠীগুলোকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
টিটিপির সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক
আফগানিস্তানে বসবাস করা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম এ পশতু জনগোষ্ঠী। আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪০–৪৫ শতাংশ পশতু। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে উৎখাত করলে, অনেক আফগান ও পাকিস্তানি যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের এসব উপজাতীয় এলাকায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে এসব অঞ্চল থেকে গেরিলা হামলা চালাতে থাকে। তাই পাকিস্তান তালেবান সরকারের যোদ্ধাদের সঙ্গে টিটিপির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা প্রশ্নে আদর্শগত ভাবে তালেবান সরকার টিটিপিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিতে পারছে না। তবে পাকিস্তানের অভিযোগ আফগানিস্তান টিটিপি যোদ্ধাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং আশ্রয় দিয়ে আসছে।
সাম্প্রতিক হামলায় ভারতের ভূমিকা
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, ভারত পরোক্ষভাবে টিটিপি কে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্প্রতি ভারতের উষ্ণ সম্পর্কে তা স্পষ্ট হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করা ভারতের দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা। পাকিস্তানকে দুর্বল করতে বিভিন্ন সময় বিদ্রোহী সংগঠনগুলোকে সাহায্য করার অভিযোগ এসেছে ভারতের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকায় দেশটিকে বিনিয়োগের উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করে আসছে ভারত। ২০০১–২০২১ সালের মধ্যে ভারত আফগানিস্তানে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগ মূলত নির্মাণ, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে। শেহরহ সেতু নির্মান,কাবুলে গ্যাস টার্বাইন প্ল্যান্ট স্থাপন,রেলওয়ে ও সড়ক প্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে ভারত।
সূত্র : উইকিপিডিয়া,ডন, টোলো নিউজ,আনাদোলু এজেন্সি, আরব নিউজ
কেএম