২১ শতকের ভূ-রাজনীতির চিত্র আরও স্পষ্ট হবে ২০২৬ সালে
বেইজিংয়ের এক দোকানে শি জিনপিং, ট্রাম্প, পুতিন ও ওবামার ছবি। এএফপি (ফাইল)
২০২৫ সাল বিশ্বরাজনীতিতে এক মোড় ঘোরানো বছর। এ সময়টায় পুরোনো বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ পুনর্গঠনের পাশাপাশি বহু দশকের প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতি, জোট ও প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেন। তার আরোপিত শুল্ক নীতি বহু-পাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে।
এ বছর জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিদেশি সাহায্য সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন কমে যায়। নিরাপত্তা জোটগুলোকে তিনি গড়ে তুলেছেন আরও লেনদেনভিত্তিক সম্পর্কে, যেখানে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করা হয়েছে দর-কষাকষির অস্ত্র হিসেবে।
দেশের ভেতরে ট্রাম্প দেখিয়েছেন শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ। ডেমোক্র্যাটদের শাসিত শহরগুলোতে সেনা পাঠানো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনতা খর্ব করতে হুমকি ও বাজেট কাঁটছাঁট, ফেডারেল রিজার্ভকে আক্রমণ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার—সব মিলিয়ে বছরের ঘটনাপ্রবাহ ছিল অভূতপূর্ব।
ট্রাম্পের এই দ্রুত ও ব্যাপক পরিবর্তনগুলো আসলে কি একটি স্থবির ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঝাঁকিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ, নাকি আমেরিকার গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত—এ প্রশ্ন পুরো বছরজুড়ে তর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
তারপরও তার নেতৃত্ব কিছু বাস্তব সাফল্য দেখিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ গাজায় যুদ্ধবিরতি। বহু সমালোচনার মুখে থাকা তার ব্যবসায়িক ধাঁচের কূটনীতি এই ক্ষেত্রে ফল দিয়েছে। ন্যাটো জোটকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়ায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়েছে—যা কল্পনাতীত ছিল। ছোট দেশগুলোর বিবাদেও তার চাপ প্রয়োগ সফলতা এনেছে বা অন্তত সংকট সাময়িক প্রশমিত করেছে।
তবে ব্যর্থতাও ছিল গুরুতর। ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ (রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার দায়ে) কিংবা ব্রাজিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা (জাইর বোলসোনারোকে বিচারের মুখোমুখি করার কারণে)—এই সিদ্ধান্তগুলো কৌশলগতভাবে ছিল দুর্বল। এতে দেশগুলো চীনের দিকে আরও ঝুঁকে গেছে। ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে অগ্রগতি হয়নি, আর শি জিনপিং তাকে কৌশলে ছাপিয়ে গেছেন। ২০২৫ সালের বাণিজ্য টানাপোড়েনে স্পষ্ট বিজয়ী ছিল চীন।
এদিকে শুল্ক নীতি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিতে পারেনি। ১০ শতাংশ গড় কার্যকর শুল্ক আরোপ সত্ত্বেও বড় কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ানো গেছে। দেশগুলো পরস্পর সমঝোতায় গিয়েছে, আর আমদানিকারকেরাই বেশিরভাগ খেসারত দিয়েছে।
একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কমানো, ক্রিপ্টো সম্পদের প্রতি সরকারের উৎসাহ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে রাখতে ট্রাম্প প্রশাসনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে দেখা গেছে অসাধারণ উত্থান। এই উত্থান ব্যবসায়ী মহলে এক ধরনের নীরব ঐকমত্য তৈরি করেছে—যে পরিস্থিতিই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

২০২৬—তিনটি ক্ষেত্রে নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা স্পষ্ট হবে।
১) পশ্চিমা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে নির্ধারিত হবে যুক্তরাষ্ট্র কি আরও স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে কি না। ডেমোক্র্যাটরা যদি প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর একটি বাস্তব নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের মধ্যবর্তী নির্বাচনে পরাজয় হয়, কিন্তু ২০২৬ আলাদা—কারণ ডেমোক্র্যাটরাও খুব জনপ্রিয় নয়। পাশাপাশি নির্বাচনী ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের ঝুঁকিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ইউরোপেও একই পরীক্ষার মুখে গণতন্ত্র। যুক্তরাজ্যে নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকে দল জনমত জরিপে এগিয়ে। স্থানীয় নির্বাচন দেখাবে, এই সমর্থন ভোটে রূপ নেয় কি না। ফ্রান্সে সরকার পতনের সম্ভাবনা রয়েছে; হলে জর্ডান বার্দেলার নেতৃত্বে প্রথম ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী আসতে পারে। জার্মানিতে কড়া-ডানপন্থি এএফডি-এর বিরুদ্ধে ফায়ারওয়াল কতটা কার্যকর থাকে, সেটিও বড় প্রশ্ন।
২) ভূ-রাজনীতির নতুন খেলা
২০২৬ সালে ট্রাম্পের লেনদেনমূলক কূটনীতি তিনভাবে রূপ নেবে—বিশ্বজুড়ে হঠাৎ-হঠাৎ শান্তি চুক্তির চেষ্টা, ল্যাটিন আমেরিকায় বলপ্রয়োগী হস্তক্ষেপ ও গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খলে সুযোগসন্ধানী দর-কষাকষি।
মধ্যপ্রাচ্যে তিনি আবার শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হবেন। গাজায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ফিরে আসতে দেবেন না এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য ক্ষমা অথবা সম্মানজনক বিদায়ের ব্যবস্থা করতে চাইবেন।
ইউক্রেন ইস্যু ইউরোপের হাতে ছেড়ে দেবেন—কিন্তু ইউরোপ নিজেই তখন ডানপন্থি ঢেউ সামলাতে ব্যস্ত থাকবে।
এশিয়ায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন—চীনের সঙ্গে ব্যবসা করার আগ্রহে ট্রাম্প তাইওয়ানকে আগের চেয়ে কম সমর্থন দেবেন। কৌশলগত অস্পষ্টতা হয়তো জায়গা করে দেবে উদাসীনতার।
ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র কঠোর অবস্থান নেবে—আর্জেন্টিনার মিলে বা এল সালভাদরের বুকেলেকে সমর্থন দেবে, বিপরীতে ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা, কলম্বিয়ায় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার—সবই সম্ভাব্য।
৩) অর্থনীতি—অস্থিরতা ও পুনর্বিন্যাস
বাজারে বড় ধস না এলেও ২০২৫–এর মতো শেয়ারবাজার আর ভরসা দিতে পারবে না। এআই-এর উৎপাদনশীলতা-বৃদ্ধির প্রভাবও আশানুরূপ দ্রুত আসবে না। শুল্কের ক্ষতি স্পষ্ট হবে, ভোক্তারা চাপে পড়বে, বাজেট ঘাটতি বাড়বে।
ডলারের ব্যাপক পতনের ঝুঁকি নেই, কারণ অন্য দেশগুলোর অবস্থাও দুর্বল। কিন্তু ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ আমেরিকান অর্থনীতির বিশেষত্ব ম্লান দেখাতে পারে।
অর্থনীতি দুর্বল হলে তা গণতন্ত্রের জন্য ভালোও হতে পারে।
বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটদের হাউজে ফিরে আসার সুযোগ বাড়বে, ফলে ট্রাম্পের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আর্থিক বাজারের অস্থিরতা হয়তো হোয়াইট হাউজের সবচেয়ে বিতর্কিত পরিকল্পনাগুলো আটকে দেবে। এমনকি ট্রাম্প নিজেও বাস্তবতার কারণে আরও সতর্ক হতে বাধ্য হতে পারেন।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
এমএসএম