মামদানির অভিষেক: নতুন বছর, নতুন নিউইয়র্ক, নতুন মেয়র
নতুন বছরের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল শহর নিউইয়র্ক পাচ্ছে নতুন মেয়র। বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) রাত পেরিয়ে বৃহস্পতিবার (১ জানুয়ারি) দায়িত্ব নিচ্ছেন জোহরান মামদানি। ৮০ লাখ মানুষের এই শহরে কেউ আশা নিয়ে, কেউ শঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছেন এই ‘ক্যারিশম্যাটিক’ নেতার দিকে, যাকে অনেকেই ভবিষ্যৎ নিউইয়র্কের জন্য ‘ব্যবস্থা ভাঙার’ মেয়র হিসেবে দেখছেন।
ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট মামদানির দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনের সূচিতে প্রতিফলিত হয়েছে তার রাজনীতি ও অগ্রাধিকার। তবে একই সঙ্গে আগের মেয়রদের রীতি থেকেও খুব একটা বিচ্যুতি নেই। রাত ১২টায় একটি সংক্ষিপ্ত ও আনুষ্ঠানিক শপথ অনুষ্ঠান এবং দুপুরে অপেক্ষাকৃত বড় ও উৎসবমুখর অভিষেক আয়োজন রাখা হয়েছে।
নিউইয়র্কের আইন অনুযায়ী, নির্বাচনের পরবর্তী বছরের ১ জানুয়ারি থেকেই মেয়রের চার বছরের মেয়াদ শুরু হয়। শহরের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যেন কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না থাকে, সে জন্যই মধ্যরাতে ছোট পরিসরে শপথ নেওয়ার রীতি চালু রয়েছে।
এবার মামদানি মধ্যরাতের শপথের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘ওল্ড সিটি হল’ সাবওয়ে স্টেশন। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই স্টেশনটি বছরে মাত্র কয়েকবার গাইডেড ট্যুরের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য খোলা হয়।
মামদানির ট্রানজিশন টিমের ভাষায়, এই সাবওয়ে স্টেশন নির্বাচন তার সেই শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন, যারা প্রতিদিন আমাদের শহর সচল রাখেন।
৩৪ বছর বয়সী এই সাবেক অঙ্গরাজ্য আইনপ্রণেতা নির্বাচনী প্রচারে ভাড়াবৃদ্ধি স্থগিত, বিনামূল্যে বাস ও শিশু পরিচর্যা সেবার প্রতিশ্রুতি দেন। জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতিকে কেন্দ্র করেই তিনি তার প্রচার গড়ে তোলেন, যা অনেকের মতে আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে সারা দেশের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্যও একটি সম্ভাব্য পথনির্দেশ।
মামদানি অনুপ্রাণিত করেছেন রেকর্ডসংখ্যক ভোটারকে। ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন ও তিনি মোট ভোটের ৫০ শতাংশ পেয়েছেন, যা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অ্যান্ড্রু কুমোর চেয়ে প্রায় ১০ পয়েন্ট বেশি এবং রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়ার তুলনায় অনেক এগিয়ে।
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমস মধ্যরাতে মামদানির শপথ গ্রহণ করাবেন। মামদানির প্রথম দিককার গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকদের একজন ছিলেন জেমস। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালে জেমস নিউইয়র্কে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত শুরু করেন। এর ফলেই ২০২৪ সালে এক বিচারক রায় দেন যে, ঋণদাতাদের বিভ্রান্ত করতে ট্রাম্প তার সম্পদের মূল্য ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেখিয়েছিলেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তার প্রশাসন জেমসের বিরুদ্ধে মর্টগেজ জালিয়াতির অভিযোগ তুলে তাকে লক্ষ্যবস্তু বানায়।
সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যাপক গ্রান্ট রিহার বলেন, অভিষেকে লেটিশিয়া জেমসের ভূমিকা মামদানির মূল সমর্থকদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে তিনি প্রেসিডেন্টের থেকে স্বাধীনভাবেই কাজ করবেন।
নতুন যুগের অভিষেক
উগান্ডায় জন্ম নেওয়া মামদানি হবেন নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র। অভিবাসনসহ নানা ইস্যুতে তিনি ট্রাম্পের তীব্র সমালোচক। হোয়াইট হাউসে উষ্ণ বৈঠকের পরও তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার মতপার্থক্য বহু বিষয়ে।
তবে অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে শপথ নেওয়া মামদানির রাজনৈতিক মিত্রতার দিকটিই বেশি তুলে ধরে। ২০১৪ সালে বিল ডি ব্লাসিও যাকে মামদানি তার জীবদ্দশায় নিউইয়র্কের সেরা মেয়র মনে করেন—নিজের প্রথম মেয়াদের শুরুতে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক শ্নাইডারম্যানের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে শপথ নিয়েছিলেন।
ভারমন্টের সিনেটর ও প্রগতিশীল রাজনীতিক বার্নি স্যান্ডার্স, যাকে মামদানি নিজের অনুপ্রেরণা বলেন, ২০১৮ সালে ডি ব্লাসিওর প্রকাশ্য অভিষেক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন। এবার মামদানির অভিষেকেও তিনি একই ভূমিকা পালন করবেন। এ ছাড়া উদারপন্থি ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্তেজও অভিষেক অনুষ্ঠানের কর্মসূচিতে থাকছেন।
মামদানির প্রকাশ্য অভিষেক উপলক্ষে সিটি হলের সিঁড়িতে আনুষ্ঠানিকতা এবং সিটি হল প্লাজায় ৪ হাজার অতিথির সামনে সংগীত ও বক্তব্যের আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্রডওয়ের বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে দেখার জায়গা থাকবে, যেখানে লাইভস্ট্রিমের মাধ্যমে ‘নতুন যুগের অভিষেক’ দেখতে পারবেন সবাই।
মামদানি অভিষেক ও ক্ষমতা হস্তান্তর আয়োজনের জন্য প্রায় ৩০ হাজার দাতার কাছ থেকে ২৬ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছেন। সরকারি প্রচারাভিযানের তথ্য অনুযায়ী, এই শতাব্দীতে মেয়রদের মধ্যে মোট ও একক অনুদান—দুই ক্ষেত্রেই এটি রেকর্ড। ২০০১ সালে মাইকেল ব্লুমবার্গের প্রথম মেয়াদ থেকে এ ধরনের তথ্য প্রকাশ শুরু হয়।
অ্যাস্টোরিয়ার বাসিন্দা মামদানি যেখানে বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে একটি প্রচার ভিডিও ধারণ করেছিলেন, সেই এলাকার আফগান রেস্তোরাঁ ‘সামির কাবাব হাউজের’ মালিক সামি জামানও অভিষেক কমিটির সদস্য ছিলেন। কমিটিতে আরও ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও অ্যাকটিভিস্টরা।
মেয়র হওয়ার পর মামদানি তার এক কক্ষের অ্যাস্টোরিয়ার ফ্ল্যাট ছেড়ে যাবেন। নিউইয়র্কের ভাড়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় থাকায় ওই ফ্ল্যাটে তার ভাড়া হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল না। নতুন মেয়র হিসেবে তিনি উঠবেন ম্যানহাটনের অভিজাত আপার ইস্ট সাইডে অবস্থিত গ্রেসি ম্যানশনে, যা নিউইয়র্ক সিটি মেয়রদের সরকারি বাসভবন।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক রাজধানী নিউইয়র্কের ব্যাংকারসহ বিভিন্ন মহলে মামদানিকে নিয়ে শুরুতে উদ্বেগ থাকলেও, নির্বাচনের পর থেকে তারা তার সঙ্গে কাজ করার পথ খুঁজতে শুরু করেছেন। এর আগেও শহরটি ডেভিড ডিঙ্কিন্সের মতো ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজমের সঙ্গে যুক্ত এক মেয়র পেয়েছিল। যদিও তিনি ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক খুব একটা সামনে আনেননি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তার মেয়াদে বাজেট ঘাটতি সামাল দেওয়া ও বেসরকারি ব্যবসাগুলোকে নিউইয়র্কে ধরে রাখতে তিনি সফল হয়েছিলেন- এমনটাই বলছেন নগরীর আর্কাইভবিদরা।
সূত্র: রয়টার্স
এসএএইচ