আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে করণীয়
আধুনিক পৃথিবীর প্রতিটি শহর যেন একেকটি শিল্পকর্ম। এখানে ভবন, সেতু ও অবকাঠামোগুলো কেবল দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য নির্মিত হয় না, অনেক সময় এগুলো হয়ে ওঠে সৌন্দর্য, পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির এক অপূর্ব সমন্বয়। এসব স্থাপনাকে যেমন দেখতে আকর্ষণীয় হওয়া জরুরি; তেমনই হতে হবে মজবুত ও নিরাপদ। এ দিকগুলো একসঙ্গে নিশ্চিত করার কাজটিই করে আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং। তাই দিন দিন বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এ টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী? এ টেকনোলজির কাজ কী? এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে? এ ছাড়া আরও অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন—
আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং কী?
আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং একটি আন্তঃবিভাগীয় শাখা, যা স্থাপত্য ও প্রকৌশলের সমন্বয়ে গঠিত। এ শাখার মূল উদ্দেশ্য ভবন নির্মাণ ও নকশার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত এবং নান্দনিক সৌন্দর্যকে একসঙ্গে নিশ্চিত করা। প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভবনের কাঠামোগত নকশা নির্ধারণ। এটি এমনভাবে তৈরি করতে হয়, যাতে ভবনটি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প বা ঘূর্ণিঝড়ের সময়েও টিকে থাকতে পারে। পাশাপাশি ভবনের ভেতরের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সুবিধা, যেমন- বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি), অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ইত্যাদিও সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পনা ও ডিজাইন করতে হয়, যাতে তা কার্যকর ও টেকসই হয়।
এ ছাড়া ভবনটিকে পরিবেশবান্ধব রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিক আলো ও বাতাস যেন ঘরের ভেতরে পর্যাপ্তভাবে প্রবেশ করতে পারে, অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং পানির অপচয় কম হয়—এসব বিষয়েও নজর রাখতে হয়। সব মিলিয়ে, একজন আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার কেবল একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মাণ করেন না বরং তা যেন আরামদায়ক, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হয়—এটি নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করেন।
যেসব বিষয়ে পড়ানো হয়
স্থাপত্য নকশা
কীভাবে একটি ভবনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নকশা তৈরি করতে হয়, সেটি শেখানো হয়। এতে হাতের আঁকা স্কেচ থেকে শুরু করে কম্পিউটারে ডিজাইন করাও শেখানো হয়।
ভবনের কাঠামো
ভবনের ভেতরে কোনো উপকরণ ব্যবহার করলে তা বেশি মজবুত হবে। কেমনভাবে স্তম্ভ, বিম বা ছাদ বানাতে হবে—এ বিষয়গুলো শেখানো হয়।
বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন
ভবন তৈরির ধাপগুলো, বিভিন্ন নির্মাণ উপকরণ ও প্রযুক্তি সম্পর্কে শেখানো হয়।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মৌলিক বিষয়
মাটি পরীক্ষা, পানি নিষ্কাশন, রাস্তা বা ব্রিজ নির্মাণের প্রাথমিক ধারণাও দেওয়া হয়।
বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক ব্যবস্থা
ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগ, লিফট, এসি, পানি সরবরাহ ইত্যাদি কীভাবে কাজ করে এবং এগুলো কীভাবে নকশা করতে হয়, তা শেখানো হয়।
পরিবেশগত নকশা
কীভাবে একটি ভবন তৈরি করলে সেটি পরিবেশবান্ধব হবে, কম জ্বালানি ব্যবহার করবে এবং প্রাকৃতিক আলো-বাতাস বেশি আসবে—এ বিষয়গুলো শেখানো হয়।
কম্পিউটার সফটওয়্যার ও ডিজাইন টুলস
অটোক্যাড, স্কেচআপ, রেভিট, থ্রিডিএস ম্যাক্স, ফটোশপ ইত্যাদি ডিজাইন সফটওয়্যার ব্যবহার শেখানো হয়।
ইতিহাস ও স্থাপত্যতত্ত্ব
বিভিন্ন সময় ও সংস্কৃতির স্থাপত্য সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয়, যাতে ভবনের নকশায় সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্যের ছাপ থাকে।
আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভবিষ্যৎ কেমন?
আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং হলো খুবই প্রয়োজনীয় ও চাহিদাসম্পন্ন পেশা। বর্তমান বিশ্বের নগরায়ন ও আধুনিকায়নের প্রেক্ষাপটে এ টেকনোলজির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। বর্তমানে শহরজুড়ে বহুতল ভবন, স্মার্ট বিল্ডিং, গ্রিন বিল্ডিংসহ বিভিন্ন চমৎকার ডিজাইন বাস্তবায়নে আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়াররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ভবিষ্যতে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ভবন নির্মাণের পদ্ধতিই বদলে যাবে। এসব ক্ষেত্রে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার হবেই। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। ভবিষ্যতের স্থাপত্য হবে এমন, যা কম শক্তি ব্যবহার করে, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে এবং বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করে। এ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা রাখেন এ টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়াররাই।
ক্যারিয়ার বা কর্মসংস্থান
বর্তমানে আধুনিক ভবন, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ও নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের হার ক্রমেই বাড়ছে। এ নির্মাণখাতে আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজনীয়তাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানেই তাদের জন্য রয়েছে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ। পাশাপাশি ডিজাইন ও আর্কিটেকচার ফার্মগুলোতেও চাকরি আছে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ ও আধুনিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ারদের কদর অনেক বেশি। এজন্য অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিদেশেও যান।
সরকারি চাকরি
> রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)
> পল্লী উন্নয়ন বিভাগ
> পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন
> সড়ক ও জনপথ বিভাগ
> বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষ
> বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ
> স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হাসপাতাল
> মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন।
বেসরকারি চাকরি
> আর্কিটেকচার ও ডিজাইন ফার্ম
> কনস্ট্রাকশন কোম্পানি
> রিয়েল এস্টেট কোম্পানি
> ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফার্ম
> ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি
> বাড়ি নির্মাণ ও হাউজিং সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান
> পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান।
অন্য ক্যারিয়ার
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং সেন্টারেও চাকরি করতে পারবেন। এ পেশায় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও আছে। কেউ চাইলে নিজস্ব ডিজাইন ফার্ম গড়ে তুলতে পারেন আবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও কাজ করতে পারেন। যা বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জনের পথ খুলে দেয়। ভালো দক্ষতা, নতুন প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা এবং ডিজাইনে সৃজনশীলতা থাকলে খুব সহজেই এ টেকনোলজি নিয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।
কারা পড়বেন
যারা নতুন কিছু তৈরি করতে ভালোবাসেন এবং নিজের চিন্তা-ভাবনা ও আইডিয়াগুলো দিয়ে সুন্দর ভবন ডিজাইন করতে চান, তাদের জন্য আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং একটি আদর্শ পেশা। এ ক্ষেত্রে সফল হতে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের ভালো ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘসময় ধরে পরিকল্পনা ও নকশায় মনোযোগ দিতে হয়। তাই ধৈর্য ধরে কাজ করার ইচ্ছা থাকা খুবই প্রয়োজন। যারা পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ, মানুষের জীবনকে সুন্দর ও আরামদায়ক করে তুলতে চান, তাদের জন্য আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং অত্যন্ত উপযোগী ক্যারিয়ার হতে পারে।
কোথায় পড়বেন?
যদি আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাহলে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ডিপ্লোমা ইন আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ডিপ্লোমা শেষে সরকারিভাবে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) বিএসসি করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি করা যাবে।
এসইউ/জিকেএস