হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের একই আইনজীবী কেন, প্রশ্ন বার্গম্যানের
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান/ফাইল ছবি
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই রোববার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ বিচার নিয়ে এবার প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান।
রোববার (৩ আগস্ট) এ নিয়ে তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আজ (রোববার) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হয়েছে। একটি স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিতের স্বার্থে আমার বেশ কয়েকটি বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
১. আসামিপক্ষে রাষ্ট্রের নিযুক্ত এক আইনজীবী, দুই মক্কেল
শেখ হাসিনার হয়ে মামলা লড়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল যে আইনজীবীকে নিযুক্ত করেছেন তিনি শুধু সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হয়েই মামলা লড়ছেন না, তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানেরও আইনজীবী। আসাদুজ্জামান খান নিজেও পলাতক। এতে বড় ধরনের ‘স্বার্থের সংঘাত’ তৈরি হচ্ছে, যেটি অভিযুক্ত দুজনেরই যথাযথ আইনি সুরক্ষাপ্রাপ্তির পথে বাধা। তাদের দুজনেরই স্পষ্টতই ভিন্ন আইনি স্বার্থ থাকতে পারে। যেমন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দিষ্ট কিছু কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করতেই পারেন আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। পলাতক দুজনেরই তাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য আলাদা আইনজীবী থাকা উচিত। এই সিদ্ধান্তটা ট্রাইব্যুনালকে নিতে হবে।
২. আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রস্তুতির সময়
অভিযুক্ত দুজনের আইনজীবী চলতি বছরের ২৫ জুন কেবল প্রসিকিউশনের দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণই হাতে পেয়েছেন, অর্থাৎ তিনি এগুলো পেয়েছেন শুনানি শুরুর পাঁচ সপ্তাহ আগে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, (এই সময়ের মধ্যে) দুই মক্কেলের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতির জন্য যথাযথ গবেষণা ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করাটা যে কোনো আইনজীবীর জন্যই অসম্ভব। বিশেষত যখন তার মক্কেলদের সঙ্গে ওই আইনজীবীর কোনো যোগাযোগই হচ্ছে না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের আইনজীবী তার প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়ে ট্রাইব্যুনালে কোনো আবেদনও করেননি। কেন তিনি শুনানি মুলতবির আবেদন করেননি- যখন আমি তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি তখন তিনি জানান, যখন তার শুনানি মুলতবির প্রয়োজন হবে তখন তিনি তার আবেদন করবেন এবং তিনি আজই (রোববার) প্রথম সাক্ষীকে জেরা করার জন্য প্রস্তুত।
আমার মনে হয়, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হাসিনার যদি এক্ষেত্রে নিজস্ব আইনজীবী থাকতো তবে তারা অবশ্যই শুনানি মুলতবির আবেদন করতেন। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী যে সে পদক্ষেপটা নেননি সেটা উল্লেখযোগ্য।
৩. সাক্ষ্য-প্রমাণে ‘বিতর্কিত বিষয়গুলো’ নিয়ে জেরার সুযোগ বন্ধ করেছেন প্রসিকিউটর/ট্রাইব্যুনাল
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় (যেখানে বলা হয়েছিল যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত এবং এই রায় দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে) ব্যবহার করে প্রসিকিউটররা রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীকে প্রথম সাক্ষীকে জেরা করা থেকে বিরত রাখেন। এই জেরা ছিল পূর্বে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে যা বলেছিলেন এবং আজ আদালতে যা বলেছেন, দুই বক্তব্যের মধ্যে বৈপরিত্য নিয়ে। এ ধরনের জেরা বাংলাদেশের সাধারণ ফৌজদারি আদালতগুলোয় একটি প্রচলিত প্রথা।
মজার ব্যাপার হলো- আরও উপযুক্ত শব্দ দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে- প্রসিকিউশনের আইনজীবীরা যা করছেন তা খুবই চোখে পড়ার মতো। এক দশক আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে হওয়া মামলার শুনানিতে, যেখানে মূলত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার হয়েছিল, সেখানেও প্রসিকিউটররা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দুটি সাক্ষ্যের মধ্যে থাকা বৈপরীত্য তুলে ধরা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলেন।
ওই সময় জামায়াতের আইনজীবীরা, যাদের মধ্যে তাজুল ইসলাম ও অন্য যারা বর্তমানে প্রসিকিউটর দলের অংশ, তারা তখন প্রসিকিউশনের বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, এটি খুবই অন্যায়, কারণ, এটি তাদের সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। যখন কাদের মোল্লার মামলায় বিষয়টি আপিল বিভাগে আসে, তখন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার রায়ে প্রসিকিউশনের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, আইসিটি আইন ও বিধিতে এ সুযোগ নেই।
ডেভিড বার্গম্যান বলেন, সুতরাং, এখন আমরা এমন একটি পরিস্থিতি দেখছি, যেখানে বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সেই একই আপিল বিভাগের রায় ব্যবহার করছেন, যে রায়ের ফলে তিনি একসময় যেসব ব্যক্তির পক্ষে আইনি লড়াই করেছেন তাদের একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। সেই একই নিয়ম তিনি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন, যা তিনি অতীতে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জন্য অত্যন্ত অন্যায্য বলে মনে করেছিলেন এবং ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা তা মেনে নিয়েছেন।
যখন আমি তাজুল ইসলামকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম তখন তিনি বলেন, এটাই আপিল বিভাগের নির্দেশনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না আইন পরিবর্তিত হচ্ছে।
জেরা শেষে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান আসামিপক্ষের আইনজীবীকে ‘ভালো জেরা’ করার জন্য অভিনন্দন জানান, যেটা বরং অদ্ভুত ছিল। যখন উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে, তখন তিনি কীভাবে এমন মন্তব্য করতে পারেন, তা পরিষ্কার নয়।
যদি ট্রাইব্যুনাল আপিল বিভাগের সেসব রায় অনুসরণ করতে থাকেন, যা এখন সাধারণত অত্যন্ত বিতর্কিত ও অন্যায্য বলে বিবেচিত, তাহলে সরকারের উচিত আইন পরিবর্তন করা। যেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সাক্ষীরা যা বলেছিলেন ও আদালতে তারা যা বলেছেন, দুটোর মধ্যে বৈপরীত্যের ভিত্তিতে তাদের জেরা করার সুযোগ পান।
এএমএ/জেআইএম