ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর
আস্থা না পাওয়ায় অনেক গুমের ভুক্তভোগী মামলার সাহস পাচ্ছেন না
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম/ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, গুমের ঘটনায় অভিযুক্তরা এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। ফলে ভুক্তভোগীরা আস্থা পাচ্ছেন না। তারা মামলা করতে সাহস পাচ্ছেন না। প্রকৃত গুমের সংখ্যা ছয় হাজারেরও বেশি। ফেরত না আসার সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রোববার (১২ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনাল-১-এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে চিফ প্রসিকিউটর এসব কথা বলেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক ভিকটিম পরিবার মনে করে, গুমের অভিযোগ করলে পরবর্তীতে তাদের সমস্যা হবে। নিপীড়নের খড়্গ নেমে আসবে, পরিবারের অন্য সদস্যরাও নির্যাতনের শিকার হবেন। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গুমের ঘটনায় এ কারণে এখনো অনেক অভিযোগ আসেনি।’
‘অনেক পরিবার বলেছে, আমাদের সন্তান ফিরে আসেনি, কিন্তু আমরা এ নিয়ে অভিযোগ দিতে চাই না। একজন মাকে পেয়েছি। তিনি বলেছেন, আমার ছেলে মরে গেছে, আমি আর এ নিয়ে কিছু বলব না। কারণ যে অবস্থার মধ্য দিয়ে ওই পরিবারকে বছরের পর বছর যেতে হয়েছে, তারা মনে করছে- যাকে মেরে ফেলা হয়েছে, এরপর বাকি যে একটি বা দুটি সন্তান আছে, তাকে আর তারা হারাতে চান না। সেজন্য তারা এ বিষয় (গুম) প্রকাশই করতে চান না। সুতরাং এ বিচার কেন জরুরি তা যদি বলতে চাই, এ মানুষগুলোকে যদি আস্থায় আনতে চাই, এর যদি অবসান ঘটাতে হয়, তাহলে বিচার অবশ্যই করতে হবে,’ যোগ করেন তাজুল ইসলাম।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিচারক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ করা হয়েছে। খুনের মামলার আসামি, সুপ্রিম কোর্টে হামলায় জড়িত ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। এ বিচারকরা সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী যখন যে রকম রায় দেওয়ার দরকার, সে রকম রায় দিয়ে ১৫ বছর ধরে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রেখেছেন।
আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলমত দমন ও ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছে উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, এ ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করে এর আগে একসময় অতিবৃদ্ধ লোককেও আসামি করে আনা হতো, জামিন দেওয়া হতো না। আদালতের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা ছিল না। বিচারাঙ্গনকে তারা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার কাজে, মানুষকে দমন করার কাজে ব্যবহার করেছে। গুমের ঘটনায় গুম কমিশনে ১৮ শ অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ জমা না পড়ার সংখ্যা আরও তিনগুণ বেশি বলে গুম কমিশন জানিয়েছে।
তাজুল ইসলাম জানান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বৈঠক হতো। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হতো, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে কোথায় কোথায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেখানে প্রটোকলের বাইরেও অনেকে থাকতেন। সেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করার আলোচনা হয়। ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান কামাল ও সালমান এফ রহমানের সমন্বয়ে ‘গ্যাং অব ফোর’ এ সিদ্ধান্ত নেয়। সালমান এফ রহমান প্রতিমন্ত্রী পলককে বলেছেন, ‘ইন্টারনেট তো বন্ধ করেছই, টিভির সম্প্রচারও বন্ধ করে দাও, আমরা ক্রাকডাউনে যাবো।’
আরও পড়ুন
১৫ সেনা কর্মকর্তাকে অবশ্যই আদালতে আনতে হবে: চিফ প্রসিকিউটর
শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে
হাসিনার মামলার যুক্তিতর্ক সম্প্রচারকালে ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘৫ আগস্ট যদি হাসিনা সরকারের পতন না হতো, ৬ আগস্ট বাংলাদেশে আমরা যে কত মানুষের লাশ দেখতাম, তা কল্পনাও করতে পারি না। কারণ সালমান এফ রহমান উসকানি দিচ্ছিলেন বারবার। হাসিনা ও শেখ তাপসের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আমরা লেথাল উইপন ব্যবহারের বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে শুনিয়েছি। হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিল সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে।’
ট্রাইব্যুনালে পরে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অসমাপ্ত রেখে শুনানি সোমবার (১৩ অক্টোবর) পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
এর আগে ৮ অক্টোবর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য রোববার দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই অনুযায়ী আজ সকালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে প্রসিকিউশন। এসময় আদালতে আসামি শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
৮ অক্টোবর প্রসিকিউশন পক্ষের সর্বশেষ ও ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়। দুই আসামি পলাতক থাকায় আইন অনুযায়ী তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়েই এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এর পরের ধাপ অনুযায়ী এখন চলছে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্কের পরই মামলাটি রায়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজন আসামি। বাকি দুজন হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে মামুন পরে রাজসাক্ষী হিসেবে হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার সাক্ষ্য মামলায় অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে প্রসিকিউশন।
এফএইচ/একিউএফ/জেআইএম