মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা
হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ ১৪ ডিসেম্বর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল/ফাইল ছবি
জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে (জেআইসি) গুমের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে ১৪ ডিসেম্বর আদেশ দেওয়ার দিন ধার্য করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দিন ঠিক করেন।
আদালতের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু, মাহিন এম রহমান, মাসুদ সালাউদ্দিন ও মো. আমির হোসেন।
এর আগে, দুপরে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। শুনানি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। এর কিছুক্ষণ পরে চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি দুই সদস্য এজলাসে আসেন। সেই দুই সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালেই পরবর্তী শুনানি শেষ করা হয়।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউর তাজুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার হওয়া তিন সেনা কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদনের সুযোগই আইনে নেই।
তিন সেনা কর্মকর্তার পক্ষে আইনজীবী দুলু বলেন, এই আসামিদের বিরুদ্ধে আটক, অপহরণ, আয়নাঘরে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। ডিজিএফআইয়ের নয়টি ব্যুরোর মধ্যে কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) অন্যতম। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমী যখন বন্দি হন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী তখন সিটিআইবির পরিচালক ছিলেন না।
এসময় ইসলাম তাজুল বলেন, উনি (আইনজীবী দুলু) বলছেন, ওই সময় আসামি ওই পদে ছিলেন না। আমি বলেছি ছিলেন। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ট্রায়াল (বিচার) প্রয়োজন। সেই সময় এখন নয়। এখন আসামিপক্ষের আবেদন পড়তে গেলে সারাদিনেও শেষ হবে না। উনি তো ট্রাইব্যুনাল আইনটাই বোঝেননি। অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় প্রাইমাফেসি (অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা) দেখতে হবে। মামলার এ পর্যায়ে পুরো সাক্ষ্য, ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই।
আইনজীবী দুলু বলেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আযমী গুম অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ঘটনায় ১১ জনকে দায়ী করে সেনাবাহিনীর কাছে একটি অভিযোগ দেন। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেনা আইনে গঠিত তদন্ত আদালতের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আটজনকে দায়ী করে শাস্তি দেওয়া হয়।
তিনি জানান, আযমীকে অপহরণের ঘটনায় এই ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা প্রসিকিউশনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগে সেই আটজনের মধ্যে ছয়জন আসামি হলেও দুজনকে আসামি করা হয়নি। এর মানে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অসম্পূর্ণ।
প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত আদালতের রিপোর্ট মানা বাধ্যতামূলক নয়। তাজুল বলেন, আর্মির রিপোর্ট মানা বাধ্যতামূলক না। আর্মি তো তাদের বাঁচানোরও চেষ্টা করতে পারে। তদন্ত আদালতের যে ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে আসামিপক্ষের আইনজীবী কথা বলছেন, সেটি আদালতে হাজির করা হয়নি। এর ভিত্তিতে তিনি কথা বলেন কীভাবে?
আসামিদের আইনজীবী দুলু বলেন, যারা আযমীর গুম চলমান রেখেছেন, সেই রিপোর্টে তাদের নাম আছে; আমার মক্কেলের নাম নেই। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, জেআইসিতে আপনার মক্কেলের কন্ট্রোল ছিলো। সেখানে আপনি জড়িত কি না, তা কি আমরা এখন বলতে পারি?
উল্লেখ্য, তদন্ত আদালতের সেই রিপোর্ট আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে হাজির করতে পারেননি। সেই রিপোর্টের অংশবিশেষ হুবহু তুলে এনে তারা আদালতে অব্যাহতির আবেদন করেছেন।
আইনজীবী দুলু বলেন, কোর্ট অব ইনকোয়ারি রিপোর্ট হুবহু আমরা তুলে ধরেছি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আযমী তদন্ত আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন; সেখানে আছে যে, তাকে যে রুমে রাখা হয়েছিলো, সেই রুমে এসি ছিলো। রুমের সাইজ ২১/২৭ ফুট। দরজা দুটি, একটি খাট, এসি একটি। অর্থাৎ (প্রসিকিউশনের দাবি অনুযায়ী) এটি আয়নাঘর নয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মাহিন এম রহমান বলেন, যেহেতু এখানে প্রতিটি আদেশ নিয়ে আপিলে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেহেতু প্রাইমাফেসি না থাকলে আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। কাউকে ধরে আনা, ছেড়ে দেওয়া সিটিআইবির কাজ নয়। দুলু বলেন, গুমের ঘটনায় ডিজিএফআইয়ের ডিজি দায়ী, সিটিআইবি নয়।
প্রসিকিউটর শাইখ মাহদী বলেন, সিটিআইবির অধীনে জেআইসি পরিচালিত হয়। সেখানে কী হয়, হয়েছে; সেটা জানা কাজেরই অংশ। জাতিসংঘের একটি ঘোষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, যেদিন কেউ গুম হয়, নিখোঁজ হয়; মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তিনি গুম বলে বিবেচিত হবেন। ওই সময় দায়িত্ব পালনকালে তিনি এর বন্ধে ব্যবস্থা নেননি, এটাই তার অপরাধ। পলাতক হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন শুনানি করেন।
গ্রেফতার তিন সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজহার সিদ্দিকীকে শুনানির সময় কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। তাদের বিষয়ে আইনজীবীদের যুক্তি ও বক্তব্য ছিলো প্রায় একই।
এফএইচ/এমএমকে