ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

খন্দকার মাহবুব হোসেন: এক অনন্য জীবনের অবসান

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৫:০৫ পিএম, ০১ জানুয়ারি ২০২৩

না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি ছিলেন একাধারে আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। ৮৪ বছর বয়সী এ ব্যক্তিত্বের কর্মময় জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। তিনি চার দফায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব যেমন পালন করেছেন, একই সঙ্গে দুবার ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানও। পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে অন্যতম আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘদিন আদালতে মামলা লড়েছেন।

প্রখ্যাত ফৌজদারি অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও তৎকালীন দালাল আইনে রাজাকারদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। পরবর্তীকালে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আদালতে তিনি ছিলেন আইনজীবীদের প্রধান। ছাত্রজীবনে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালীন আলমারিতে রাখা মোটা আইনি বইয়ের পেছনে তিনি গ্রেনেড লুকিয়ে রাখতেন বলেও কথিত আছে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন ১৯৩৮ সালের ২০ মার্চ বরগুনার বামনা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খন্দকার আবুল হাসান ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। বাবার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি।

পরবর্তীকালে লেখাপড়ার উদ্দেশে ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। এসময় তিনি খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারে অবস্থান করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন। নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন। পরবর্তী সময়ে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী নটর ডেম কলেজে।

১৯৫৮ সালে খন্দকার মাহবুব হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল অ্যাসোসিয়েশনের ভিপি নির্বাচিত হন। তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করায় কয়েকজন সহযোগীসহ তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি নিজেই নিজের মামলা পরিচালনা করেন এবং মামলা থেকে অব্যাহতি পান। তবে সামরিক শাসক তাকে এমএ পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়নি। ১৯৬৪ সালে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন খন্দকার মাহবুব হোসেন নেপথ্যে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি হাইকোর্টে আইনজীবীদের একটি মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (প্রেসিডেন্ট) জিল্লুর রহমানসহ আইনজীবীদের নিয়ে জেলা কোর্টে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বক্তব্য দেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধারা তার বাসাকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। আলমারিতে রাখা মোটা আইনি বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রাখতেন গ্রেনেড।

১৯৬৭ সালে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানবতাবিরোধীদের অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদে চারবার নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান (সহ-সভাপতির) পদে দুবার (২০০৭-২০০৮ ও ২০১২-২০১৫ সাল) দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে খন্দকার মাহবুব হোসেন অধ্যাপক ফারহাত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে।

সমাজসেবায় বিভিন্ন বিষয়ে অবদান রেখেছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। অন্ধ ও পঙ্গুদের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (ভিটিসিবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি তিনি। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার উপদেষ্টা এবং জসীমউদ্দীন পরিষদের সম্মানীত পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন।

ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ইউনিয়ন, এশিয়ান ব্লাইন্ড ইউনিয়ন ও ঢাকা রোটারি ক্লাবের সদস্য ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। এরমধ্যে জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক (২০০৬), কবি নজরুল স্বর্ণপদক (২০০৭), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক (২০০৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আইনজীবী হিসেবে খন্দকার মাহবুব হোসেন অসংখ্য যুগান্তকারী মামলা পরিচালনা করেছেন। এরমধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সম্পর্কিত মামলা (আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র, ৭৩ ডিএলআর (এডি) ২৯৮), শাজনীন হত্যা মামলা (সৈয়দ সাজ্জাদ মাইনুদ্দিন হাসান বনাম রাষ্ট্র, ৭০ ডিএলআর (এডি) ৭০), চাপা হত্যা মামলা (রাষ্ট্র বনাম খন্দকার জিল্লুর বারী, ৭০ ডিএলআর (এডি) ৭০), সালেহা খুকি হত্যা মামলা (এহতেশামুদ্দিন বনাম বাংলাদেশ, ৩৩ ডিএলআর (এডি) ১৫৪), আজম রেজা মামলা (রাষ্ট্র বনাম আজম রেজা, ৬২ ডিএলআর ৩৯৯), এরশাদ শিকদার বনাম রাষ্ট্র, ভিডিও ক্যাসেট মামলা, (খালেদা আকতার বনাম রাষ্ট্র, ৩৭ ডিএলআর ২৭৫) অন্যতম।

এর আগে গতকাল শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) দিনগত রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান প্রখ্যাত এ আইনজীবী। তার মৃত্যুতে দেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নুর দুলাল শোক প্রকাশ করেছেন। দেশের আইন অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস