ভিডিও EN
  1. Home/
  2. লাইফস্টাইল

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

সাজেদুর আবেদীন শান্ত | প্রকাশিত: ০৫:০৩ পিএম, ২১ জুন ২০২৫

একটা সময় পর্যন্ত সেলফি তোলা ছিল নিছক আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে প্রযুক্তির ব্যবহার ও সামাজিক আচরণ। এখন অনেকেই দিনে অসংখ্যবার নিজের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন। এটি কি কেবল আনন্দ? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে মনস্তাত্ত্বিক কোনো টানাপোড়েন?

২০১৪ সালের ৩১ মার্চ একটি কৌতুকনির্ভর ওয়েবসাইট অ্যাডোবো ক্রনিকলস-এ প্রকাশিত হয় এক ‘ভুয়া’ সংবাদ। সেখানে দাবি করা হয়েছিল, ‘সেলফাইটিস’ (Selfitis) নামের এক নতুন মানসিক সমস্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সংবাদ অনুযায়ী, সেলফাইটিস হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের আত্মসম্মানের ঘাটতি ও গভীর একাকীত্ব ঢাকতে বারবার নিজের ছবি তোলেন এবং তা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন।

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এই 'ভুয়া খবরেই' বলা হয়, সেলফাইটিসের রয়েছে তিনটি পর্যায়-

১. সীমান্তবর্তী সেলফাইটিস বা বর্ডারলাইন সেলফাইটিস: এ ক্যাটাগরির মানুষেরা দিনে অন্তত তিনবার সেলফি তোলা, তবে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট না করা।

২. তীব্র সেলফাইটিস: এই ক্যাটাগরির লোকেরা দিনে অন্তত তিনবার সেলফি তোলে এবং প্রতিটি ছবিই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে।

বিজ্ঞাপন

৩. জটিল সেলফাইটিস বা ক্রনিকলস সেলফাইটিস: সারাদিনে অনেকবার সেলফি তোলা এবং দিনে ছয়বার বা তার বেশি তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা।

যদিও এটি ছিল একটি রসিকতা, কিন্তু বিষয়টি মনোবিজ্ঞানীদের চিন্তায় ফেলে দেয়। যেমনটা ঘটেছিল ১৯৯৫ সালে – তখন ‘ইন্টারনেট আসক্তি’ বিষয়টিও প্রথমে কল্পিত মনে হয়েছিল, পরে সেটি পরিণত হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়ে।

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

বিজ্ঞাপন

গবেষণা যা বলছে

একটি ‘ভুয়া’ খবর থেকে সেলফি বিষয়টি চলে আসে বৈজ্ঞানিক ল্যাবে। ২০১৭ সালে ভারতের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২৫ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় এই ‘সেলফাইটিস’ বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষকরা ছিলেন বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী বিপিন বালাকৃষ্ণান এবং মার্ক গ্রিফিথস।

গবেষণার প্রথম ধাপে ২২৫ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আলাপচারিতা (ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন) করে সংগ্রহ করা হয় ৩৯টি সম্ভাব্য আচরণ। এরপর বেছে নেওয়া হয় ২২টি অভ্যাস বা প্রবণতা, যার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় একটি বিশেষ মূল্যায়ন পদ্ধতি – সেলফাইটিস আচরণ মাপকাঠি (Selfitis Behavior Scale)।

এই স্কেল ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির সেলফি তোলার প্রবণতা কোন পর্যায়ে আছে, তা নির্ধারণ করা যায়। গবেষণায় এমন ছয়টি মানসিক উপাদান শনাক্ত করা হয়, যেগুলোর কারণে কেউ সেলফি তুলতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যেমন-

বিজ্ঞাপন

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

১. পরিবেশ সুন্দরভাবে উপস্থাপন: এই ক্যাটাগরির মানুষেরা নিজের আশপাশকে আকর্ষণীয়ভাবে দেখাতেই মুলত সেলফি তোলে।

২. সামাজিক প্রতিযোগিতা: এনারা সাধারণত অন্যদের চেয়ে নিজেকে ভালো প্রমাণের চেষ্টা করার লক্ষ্যে সেলফি তোলে।

বিজ্ঞাপন

৩. মনোযোগ আকর্ষণের প্রবণতা: নিজের প্রতি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের ইচ্ছা থেকেও কেউ কেউ সেলফি তোলে।

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

৪. মেজাজ ঠিক করা: অনেকেই আবার বিষণ্নতা দূর করতে বা ভালো লাগার জন্যও সেলফি তোলে।

বিজ্ঞাপন

৫. আত্মবিশ্বাস অর্জন: নিজের ওপর বিশ্বাস বাড়াতেও কেউ কেউ নিজের ছবি বা সেলফি তোলে।

৬. সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো: সামাজিক বিভিন্ন ট্রেন্ড অনুসরণ কিংবা সমাজে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যও কেউ অনেকে সেলফি তোলে।

কিন্তু কেন এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ

এই গবেষণায় ভারতের শিক্ষার্থীদের বেছে নেওয়ার পেছনে ছিল দুটি কারণ। এক, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশ। দুই, সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণহানির দিক থেকেও ভারত শীর্ষে।

একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, সেলফি তুলতে গিয়ে বিশ্বের যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকের বেশি (৭৬ জনের মতো) মানুষ ভারতের। এর অর্থ দাঁড়ায় – সেলফির প্রতি আকর্ষণ অনেকের জন্য শুধু বিনোদন নয়, কখনও কখনও জীবনহানির কারণ। তাই মানব সভ্যতা নিয়ে ভাবতে হলে, তাদের আচরণ নিয়ে তো গবেষণা করতেই হবে।

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

আত্মপরিচয় ও সেলফি

‘সেলফি’ শব্দটি এখন কেবল ছবি তোলা নয়, একধরনের আত্মপ্রকাশ। অনেকের কাছে এটি আত্মবিশ্বাস তৈরির মাধ্যম, আবার কারও কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার প্ল্যাটফর্ম।

তবে অতিরিক্ত সেলফি তোলা যে মানসিক চাপে রূপ নিতে পারে, সে কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কেউ কেউ এটিকে আত্মরতি প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করছেন, যদিও এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমতও রয়েছে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, সেলফি তুলতে গিয়ে অনেকেই বিপজ্জনক জায়গায় উঠে যান; যেমন- ঝরনার কিনার, রেললাইন, উঁচু ভবনের ছাদ, চলন্ত গাড়ির ওপর – যা অনেক সময় মরণফাঁদে পরিণত হয়।

বারবার সেলফি তোলা কি সত্যিই মানসিক সমস্যা

তবে কি সেলফাইটিস একটি স্বীকৃত রোগ

এখনো ‘সেলফাইটিস’ নামক কোনো রোগকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সংগঠন স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে।

তবে গবেষকরা বলছেন, এই প্রবণতা সমাজে একটি বাস্তব সমস্যা হয়ে উঠছে এবং ‘সেলফাইটিস আচরণ স্কেল’ ব্যবহার করে এটি মূল্যায়নের চেষ্টা করা যেতে পারে। উদ্দেশ্য একটাই – সেলফি যেন আত্মমর্যাদা হারানোর পথে না নিয়ে যায়।

সুতরাং মনে রাখতে হবে, সেলফি তোলা মানেই ভুল কিছু নয়। এটি হতে পারে আনন্দ, সৃজনশীলতা বা আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু যখন এটি আপনার মনের শান্তি, সম্পর্ক, এমনকি নিরাপত্তার বদলে মুখ্য হয়ে ওঠে – তখনই সেলফি নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার।

আমরা কি সেলফির মাধ্যমে শুধু নিজেকে প্রকাশ করছি, নাকি এক অদৃশ্য মানসিক শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছি? আমাদের এই আত্মজিজ্ঞাসাই পারে ‘সেলফাইটিস’-এর ফাঁদ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে।

এএমপি/জেআইএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন