হতাশার লক্ষণ প্রকাশ পায় আপনার ঘরেও

জীবনে খারাপ সময় আসে, আবার দিন পাল্টে গিয়ে ভালো সময়ও আসে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যদি কেউ হতাশা বা অবসাদগ্রস্ত থাকে, তাহলে এটি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বা মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে। তবে অনেকসময় একজন মানুষ হতাশায় ভুগলেও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।
এর ফলে চিকিৎসা বা সাহায্য পেতে দেরি হয়ে যেতে পারে। তখন নিজের অজান্তে আরও বড় বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। তাই দ্রুততম সময়ে হতাশা চিহ্নিত করার জন্য অনেক মনোবিদ এখন লক্ষণ হিসেবে ‘ডিপ্রেশন রুম’ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু কী এই ডিপ্রেশন রুম?
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
সামাজিক যোগাযোগা মাধ্যমে এমন অনেক ছবি দেখতে পাবেন, যার সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত থাকা বা অবসাদের সম্পর্ক আছে। তাই মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, কোনো ব্যক্তি অবসাদে আক্রান্ত কি না, তা বোঝা সম্ভব তাদের ঘরবাড়ি দেখে। একে ‘ডিপ্রেশন রুম সিনড্রোম’ বলা হয়।
‘ডিপ্রেশন রুম সিনড্রোম’ কী?
ধরুন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলেন – কোনো একটা ঘরের বিছানা অগোছালো, মেঝেতে জামাকাপড় ছড়ানো, বাসনভর্তি সিংক, জানালায় ধুলোর আস্তরণ, টেবিলজুড়ে ফেলে রাখা ওষুধ, খাবারের প্যাকেট বা অর্ধেক খাওয়া খাবার। আপনি হয়তো ভাবলেন, ‘আরেহ্! কী অগোছালো!’ কিন্তু এই ঘরটি কেবল গৃহস্থালির অবহেলার প্রতীক নয়, এর মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে গভীর কোনো মানসিক সমস্যার লক্ষণ বা ডিপ্রেশন রুম সিনড্রোম।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ডিপ্রেশন রুম সিনড্রোম এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন মানুষ মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে নিজের ঘরের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন – যখন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে উদ্বিগ্নতা, হতাশা বা ক্লান্তিতে ভোগে, তখন তার জীবনযাপনেও এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। ঘর পরিষ্কার না রাখার পেছনে সবসময় আলস্য দায়ী নয়, এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে গভীর মানসিক ক্লান্তি।
বিজ্ঞাপন
কেন হয় এমন?
>> অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার কাছে এসব অর্থহীন মনে হয়।
>> মন বেশি ফাঁকা ফাঁকা বা অনেক বেশি ভারী মনে হয়, ফলে কাজ শুরু করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
>> এসময় ছোট কাজকেও বিশাল চাপ মনে হয়।
বিজ্ঞাপন
>> উদ্বেগ এবং আত্মসমালোচনার কারণে কাজ করতে ভয় বা অনিচ্ছা জন্মায়।
>> জীবন অর্থহীন বা শূন্য মনে হয়, ফলে চারপাশের যত্নও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
তাহলে শুধু এলামেলো ঘরে দেখলেই কি ধরে নেবেন যে, এ ঘরের বাসিন্দা অবসাদের রোগী? না বিষয়টা এমন নয়। ঘর একটি লক্ষণমাত্র। এছাড়া কী ধরনের এলোমেলো, কতোদিন ধরে এমন অবস্থা – এসবও বিশ্লেষণের বিষয়। তাই জেনে নিন ডিপ্রেশন রুম সিনড্রোমের লক্ষণসমূহ -
১. শোবার ঘর দিনের পর দিন পরিষ্কার না হওয়া।
২. মেঝেতে বা খাটে কাপড়, বই, চুলার ওপর বাসন ইত্যাদি আনেকদিন ধরে পড়ে থাকা।
বিজ্ঞাপন
৩. খাবারের প্যাকেট, প্লেট, পানির বোতল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা।
৪. নোংরা কাপড়ের স্তুপ জমে যাওয়া।
৫. টয়লেট অপরিচ্ছন্ন রাখা।
বিজ্ঞাপন
৬. ঘরে আলো-বাতাস চলাচলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৭. ফ্যান বা জানালা ধুলোময় থাকা
৮. ওষুধ, স্কিনকেয়ার, কাগজপত্র ছড়িয়ে থাকা।
৯. ব্যবহৃত কাপ, চামচ বা প্যাকেট দীর্ঘদিন পড়ে থাকা।
১০. ব্যালকনিতে শুকাতে দেওয়া কাপড় সপ্তাহের পর সপ্তাহ ফেলে রাখা।
১১. নিজের বিছানাও আরামদায়ক না লাগা।
১২. বাসায় কেউ আসলে উদ্বেগ কাজ করা।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে – কিছুদিন সব এলোমেলো থাকলেই বা কী এমন সমস্যা! কিন্তু সমস্যা আছে। জেনে নিন এর প্রভাব কী হতে পারে-
>> আত্মসম্মানবোধ কমে যেতে পারে।
>> সমাজে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে।
>> কাজের বা পড়াশোনার ওপর প্রভাব পড়ে।
>> পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে দূরত্ব তৈরি হয়।
>> আরও গভীর মানসিক অবসাদের জন্ম হয়।
লক্ষণগুলো যদি আপনার মধ্যে বা আপনার কাছের কারো মধ্যে দেখেন, তাহলে কী করা উচিত? সমাধানের উপায় কী?
১. ছোট থেকে শুরু করুন: পুরো ঘর না, প্রথমে শুধু বিছানা গুছিয়ে দিন। পরদিন একটি কোণা পরিষ্কার করুন।
২. সময় বেঁধে নিন: ১০-১৫ মিনিট পরিষ্কারের জন্য ঠিক করুন, বেশি চাপ নেবেন না।
৩. সহযোগিতা নিন: পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলুন পাশে থাকার জন্য।
৪. থেরাপিস্টের সাহায্য নিন: মানসিক চাপ বা উদ্বেগ বেড়ে গেলে অবশ্যই কাউন্সেলিং নিন।
৫. রুটিন তৈরি করুন: সকাল বা সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছোট ছোট কাজ করুন।
৬. নিজেকে দোষ দেবেন না: আপনি অলস নন, আপনি কষ্টে আছেন – এই সত্য মেনে নেওয়াই প্রথম ধাপ।
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে কারো ঘর অগোছালো মানেই তাকে ‘অলস’ বা ‘অপরিচ্ছন্ন’ মানুষ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ডিপ্রেশন রুম সিনড্রোম আসলে এক গভীর মানসিক অবস্থা তুলে ধরে। আমাদের উচিত এই লক্ষণগুলোকে বিচার না করে বোঝার চেষ্টা করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া।
ডিপ্রেশন রুম শুধুই একটি এলোমেলো ঘর নয় – এটি মনের গভীরের একটি কান্না। যদি আপনি নিজে বা আপনার কাছের কেউ এমন ঘরে থাকেন, তাহলে সাবধান হোন। সহানুভূতির হাত বাড়ান, কথায় নয়, কাজে পাশে থাকুন। কারণ ছোট একটা পরিষ্কার কোণা থেকেও শুরু হতে পারে নতুন জীবনের গল্প।
সূত্র: আনন্দবাজার, সাইকোলজি টুডে, ভেরিওয়েল মাইন্ড, হাফপোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান
এএমপি/জেআইএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন