ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

কবির হোসেন মিজির গল্প

লাল জামায় ফেরা ঈদ

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৮:৪৯ এএম, ০৬ জুন ২০২৫

ঈদের আগের দিন বিকেল। গাঁয়ের মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে ফিরছিল ছোট্ট রাহেল। কাঁধে একটা পুরোনো পাটের ব্যাগ, ভেতরে কাগজে মোড়ানো একটা সস্তা সেমাইয়ের প্যাকেট। তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক আলোর রেখা, যেটা শহরের কারো চোখে ধরা পড়ে না।

রাহেলের বয়স মাত্র আট বছর। বাবা একজন হকার ছিলেন, তিনি শহরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান দুই বছর আগে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তিন বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ঈদ এলে তার মনটা খুশিতে ভরে যায়, আবার কোনো কোনো রাতে বিছানার চাদরে কান্নার ছাপ রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এবার ঈদের আগে তার মা তাকে কেবল একটি কথা বলেছিলেন, ‘রাহেল, তোরা জামা চাইবি না। তোর বাপ নাই—আমি যা পারি খাবারটাই জোগাড় করি।’
সে রাতে রাহেল কিছু বলে না। কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ।

ঈদের দিন সকালে। পুরো গ্রামে ঈদের আনন্দ। কারো ঘরে গরুর গোস্ত, কারো ঘরে পোলাও, কোথাও গানের শব্দ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা পরে দৌড়াচ্ছে। রাহেল ঘরের কোণে বসে আছে। তার শরীরে একটা পুরোনো জামা, যার গলার নিচে ছোট একটা ছেঁড়ার দাগ। কিন্তু মুখে আজ অদ্ভুত এক হাসি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসছিস কেন রে? কষ্ট লাগতেছে না?’
রাহেল কাঁপা গলায় বলল, ‘না মা। আমার জামা পুরোনোটা ঠিক কিন্তু তুমি তো আছো। ঈদ মানে নতুন জামা না, ঈদ মানে আমার মা আজও বেঁচে আছে, আমার পাশে আছে।’
মায়ের চোখ ভিজে ওঠে। তিনি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সেই মুহূর্তে পুরোনো জামার ছেঁড়া দাগটার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ভালোবাসার নতুন একটা দাগ—যেটা সারাজীবন থাকবে, রাহেলের ঈদের স্মৃতির পাতায়।

ঈদের নামাজ শেষ হতেই গ্রামের মসজিদের বাইরে জটলা জমে ওঠে। ছোট-বড় পুরুষেরা একে একে পরস্পরকে কোলাকুলি করে বাড়ি ফিরছে। কারো হাতে গরুর মাংস, কারো হাতে পোলাওর গন্ধমাখা পাত্র। রাহেল দূর থেকে দেখছিল। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একজনের দিকে—মহসিন চাচা, গ্রামে সদ্য আসা এক সমাজকর্মী, যিনি শহর থেকে গ্রামে ফিরে ছোটদের জন্য একটা পাঠশালা খুলেছেন।

বিজ্ঞাপন

মহসিন চাচা হঠাৎ রাহেলকে দেখে ডাকলেন, ‘এই যে রাহেল! ঈদের সকাল কেমন গেল?’
রাহেল একটু হাসলো। ভেতরে ভেতরে সে অনেক কথাই বলতে চায় কিন্তু তার ঠোঁট কাঁপে।
চাচা এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত রাখলেন। ‘তুই তো আমার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী। আমি শুনেছি তুই লেখাপড়ার মাঝে ভালো থাকিস।’
রাহেল মাথা নিচু করে বলল, ‘ভালো আছি কিন্তু আজ নতুন জামা নাই, তাই স্কুলের বন্ধুরা ডাকে না।’
মহসিন চাচার চোখ কিছুটা ভারী হলো। তিনি ব্যাগ থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করলেন, রঙিন কাগজে মোড়ানো। ‘এটা তোর জন্য, আজ ঈদের দিন। কেউ যেন খালি হাতে না থাকে, এই চেষ্টাটুকু তো আমাদের থাকা উচিত, না?’

রাহেল হকচকিয়ে খুশি মনে প্যাকেটটা নিলো। খুলে দেখে লাল রঙের একটা জামা! সাদা সেলাই, কলারে ছোট ফুলের নকশা। সে কিছুক্ষণ চুপ। তারপর হঠাৎ দৌড়ে চলে গেল ঘরে। মা তখন মাটির চুলায় খিচুড়ি নামাচ্ছিলেন। রাহেল এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো,
‘মা! দেখো, আমি নতুন জামা পেয়েছি! দেখো কত সুন্দর!’
মা কাঁপা হাতে জামাটা ছুঁয়ে দেখেন। চোখে জল, ঠোঁটে একটুখানি হাসি। ‘আজ মনে হচ্ছে তোর বাপরে যদি আবার একবার দেখতে পারতাম। এই জামা গায়ে দিয়ে তুই তার সামনে দাঁড়াইতে পারতিস।’
রাহেল চুপ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ বলে, ‘মা, জানো? একদিন আমি বড় হবো। সবাইকে জামা কিনে দেবো। তখন আর কেউ কাঁদবে না ঈদের দিন!’

বছর পেরিয়ে যায়। সময় চলে যায় নদীর জলের মতো। মহসিন চাচার পাঠশালায় রাহেল পরীক্ষায় প্রথম হয়। তারপর বৃত্তি পায়, শহরে যায় পড়তে। ঈদের দিন গাঁয়ে ফিরে আসে সে এক বছর পর পর। এবার আর কেউ তাকে পুরোনো জামার মেয়েটা বলে না। সে একখানি ব্যাগ থেকে ছোট ছোট প্যাকেট বের করে, ‘এগুলো ফারজানার জন্য, ওটা নুরুলের জন্য, ওটা জাহেদের জন্য।’
সবাই অবাক। রাহেল সবার মাঝে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আজ থেকে এই গ্রামে কেউ আর ঈদের দিন নতুন জামার জন্য মন খারাপ করবে না। আমি চাই, তোমরা সবাই হাসো, যেরকম আমি একদিন চেয়েছিলাম।’
মায়ের চোখ ভিজে ওঠে আবার। পুরোনো ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি, মনে মনে বলেন, ‘বেঁচে থাকলে ওর বাপটা আজ নিশ্চয়ই গর্বে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতো। মেয়েটা আমাদের ঈদ ফিরিয়ে এনেছে।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকার গলিতে ঈদের রোদের একটা আলাদা গন্ধ থাকে। রাহেল এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পড়ালেখা, টিউশনি, ছোটখাটো লেখালেখি—সব মিলিয়ে তার জীবন এখন এক অন্য লড়াইয়ের নাম। তবুও প্রতিটা ঈদ তার কাছে স্মৃতির খাতা উল্টে দেখার মতো কিছু।
চল্লিশ দিন আগেই বাসায় ফোন করে মাকে বলেছে, ‘ঈদে বাড়ি ফিরবো। তোমার জন্য একটা শাড়ি আনবো, ঠিক আগেরবারের জামার মতোই লাল রঙের।’ মায়ের কণ্ঠে হাসি লুকানো আনন্দ—‘তুই আয় মা, শাড়ির দরকার নেই। তুই শুধু আমার সামনে দাঁড়াস, সেটাই যথেষ্ট।’

রাহেল এবার ভিন্ন কিছু করতে চায়। তার ছাত্রছাত্রীদের বাচ্চাগুলোর জন্য ঈদের আগে নতুন জামা কিনে দিলো। তারপর একদিন হঠাৎ একটা পুরোনো প্যাকেট খুঁজে পেল তার ট্রাঙ্কে—বাবার মৃত্যুর পর রেখে দেওয়া একটা পুরোনো সাদা পাঞ্জাবি, যা ছোটবেলায় সে কোলে নিয়ে ঘুমাতো। জামাটা নেওয়ার সময় তার চোখ ভিজে ওঠে।
সে জানে, ঈদে বাবারা ফেরে না কিন্তু তাদের গন্ধ থেকে যায়। ঠিক যেমন রাহেলের ঈদ মানে নতুন জামা নয় বরং মাটির সেই গন্ধ, মায়ের কপালের ঘাম আর বাবার স্নেহমাখা ছায়া।

ঈদের দিন সকালে সে গাঁয়ে ফিরে এলো। গ্রামের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল ছোটরা, হাত বাড়িয়ে বলল, ‘রাহেল আপু এসেছে! আমাদের আপু।’
সে সবার হাতে হাতে জামার প্যাকেট দেয়। নিজেও একটা সাদা জামা পরে। ঠিক বাবার মতো। কেউ টের পায় না, তার চোখের কোণে জমে থাকা জলটা এই মাটির জন্য, তার বাবার জন্য।
সেই সন্ধ্যায় মা চুপচাপ তার কাঁধে মাথা রেখে বললেন, ‘তুই আসলে আমাদের ঈদের দিনটা ফিরিয়ে এনেছিস রে। শুধু বাড়িতে না, এই গোটা গ্রামেই।’
রাহেল ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি জানো মা? আমি বাবার জামাটা আজ আমার বুকে জড়িয়ে ঘুমাবো। মনে হবে যেন আজও বাবা আমায় একবার আদর করছেন।’

বিজ্ঞাপন

ঈদের দিন পার হয় কিন্তু গ্রামে একটা আলো থেকে যায়। মহসিন চাচা এখন আর শুধু পাঠশালার শিক্ষক নন—রাহেলের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তিনি একদিন রাহেলকে ডেকে বলেন, ‘তুই শুধু নিজের জন্য নয়, একটা প্রজন্মের জন্য কিছু করছিস রে। জানিস, ছোট্ট রাহেল, পুরোনো জামা পরে যে ঈদের দিন কাঁদতো। আজ সেই মেয়েটার নামেই আমরা একটা পাঠাগার চালু করবো, রাহেল স্মৃতি পাঠাগার।’
রাহেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আমি চাই ওখানে এমন সব গল্প থাকুক, যেখানে কেউ জামা না পেয়ে ঈদের দিন কাঁদবে না। আমি চাই, আমার বাবার মতো কেউ যেন হারিয়ে না যায় কোনো সড়কে। আমার মতো কোনো বাচ্চার ঈদ যেন না হয় চোখের জলে ভেজা।’
তারপর সে আকাশের দিকে তাকায়। ঈদের চাঁদ তখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে। তবুও চাঁদের পাশে একখানি তারা জ্বলছে মিটমিট করে।
রাহেল মনে মনে ভাবে—সেই তারাটার নামই বুঝি বাবা রেখেছেন আমার নামে, ঈদের তারাটা—‘রাহেল’।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন