হাসান হাফিজের কবিতা: আধখানা চাঁদের কুহক
এমরান কবির
নানা কারণে সত্তর দশক আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কবি হাসান হাফিজের আবির্ভাব। একদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তন; অন্যদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের একটি ব্যাপক পরিবর্তনের সন্ধি-সময়। ষাটের জাতীয়তাবাদী চেতনা সত্তরে এসে হোচট খাওয়ার পরপরই দেখা যায় দীর্ঘ সামরিক শাসন। বিশ্বব্যাপী শিল্প-চিন্তা আর কাঠামো নিয়ে ব্যাপক নিরীক্ষার কাল। সময়ের সাথে তাল রেখে যারা বিশ্বব্যাপী শিল্প-কাঠামোর খোঁজ রাখছিলেন; তারা ষাট এবং চলতি সত্তর নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। একদিকে ছিল টানাপোড়েন; অন্যদিকে সাহস দেখানোর স্পর্ধা। এই দ্বিধা কাটিয়ে যে ক’জন তরুণ কবি কবিতায় আপন স্বর ও সুর স্থাপন করেছিলেন কবি হাসান হাফিজ তাদের অন্যতম।
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার উন্মেষকাল থেকে অনেকগুলো বিষয়ের চর্চা হয়ে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সবকিছু পরিষ্কার না করিয়ে কিছু আড়াল, কিছু রহস্য, কিছু ধরা কিছু না-ধরা, কিছু মায়া, কিছু কুহক সৃষ্টি করা। এমনকি কবিতায় প্রচ্ছন্ন সমাপ্তিবিন্দু না টেনে পাঠকের জন্য রেখে দেওয়া। কবি শুধু একাই ভাববেন কেন। যদি কবিতার সাথে পাঠক একটু হলেও সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারেন, তাহলে সমাপ্তিবিন্দুর নামে উপসংহারে না গিয়ে পাঠকের জন্য একটু দরজা খুলে রাখা। ষাট এবং আশির মাঝখানে যারা এগুলো নিয়ে চর্চা করেছেন, পরবর্তীতে দেখা গেছে তারাই হয়ে উঠেছেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কবি হাসান হাফিজের কবিতায় উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো তার কাব্যযাত্রার শুরু থেকেই বিদ্যমান। ফলে ওই সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে তার শিল্প-প্রকরণের অন্যতম বিষয় হিসেবে রেখেও তিনি ধরা আর না-ধরার কুহকী মায়াজাল কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় ও উদাহরণীয় এবং পুনঃ পুনঃ পাঠের বৈচিত্র-বেষ্ঠিত শিল্প-মাধ্যম। যা সময়ের পরিক্রমায় এখনও চলমান।
তত্ত্বকথা ছেড়ে আমরা এখন তার একটি কবিতায় অবগাহন করতে পারি—‘আধফোটা কলি আধখানা চাঁদ/ ভ্রমে ও কুহকে পাতা ছিল ফাঁদ।/ তুমিই গোপনে পিছলিয়ে পা/ পড়েছিলে ভুলে? জানাই হলো না!/ আধফোটা ভ্রূণ এক ফালি শ্বাস/ গুমরিয়ে কাঁদে একা বারো মাস/ তুমি সেই চোখে দেখেছিলে জল/ দেখে ভুলে গেছে বেশ জানো ছল।’ (বেশ জানো বেশ)
কবিতাটি পড়ার পর সেই চিরায়ত প্রশ্ন উঠে আসে বারবার। কবিতার অধরা আলোর কাছে আমরা আসলে কী চাই? ব্যক্তিভেদে এর উত্তর নিশ্চয়ই আলাদা আলাদা হয়ে যাবে। আমি যা চাই আরেকজন তা চাইবেন কেন? একজন যদি দেশকে নিয়ে ভাবিত থাকেন তার কাছে প্রেমের কবিতা অর্থহীন। এদিকে প্রেমে পড়ে বা ব্যর্থ হয়ে যে ব্যক্তি উথাল-পাথাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তার কাছে দেশপ্রেম বা দেশের সংকট গুরুত্বহীন। এ তো গেল পরিস্থিতিজনিত কারণ। ব্যক্তিভেদে রুচির যে ভিন্নতা সেখানেও তো প্রার্থিত বস্তুর ভিন্নতা থাকবে। দিনে দিনে যে রুচির পরিবর্তন হচ্ছে সেখানেও কবিতার দায় থাকছে। পরিবর্তিত রুচি নিয়ে কবি কতটা যেতে পারছেন এর ভূগোলের কাছে? দেশ বা ভূগোলের ভিন্নতা কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও কবিতার কাছে আমাদের প্রার্থিত বস্তুর পরিবর্তন হয়ে যায়। আজ বাংলাদেশের মানুষের কবিতার কাছে যে গড়-চাহিদা প্যালেস্টাইনের জনগণের এই চাহিদা অন্যরকম। সোমালিয়ার জনগণের কাছে এই দুই দেশের জনগণের চাহিদার চেয়ে অন্যতর চাহিদা।
তার মানে ব্যক্তিভেদে, সময়ভেদে, পরিস্থিতিভেদে, দেশকালভেদে কবিতার অধরা আলোর কাছে আমাদের চাওয়া ভিন্ন। তবুও কবিতা নামক শিল্প-মাধ্যমের কাছে আমাদের সাধারণ একটি চাওয়া থাকে। তা হলো কবিতায় যা উপস্থাপিত তার সাথে ন্যূনতম সংযোগ। বলতে রূঢ় শোনালেও এ কথা খুবই সত্যি যে এই ন্যূনতম সংযোগ ঘটাতে অধিকাংশ কবিই ব্যর্থ। এর কারণ কী? এর কারণ হলো কবির ভাবনার অস্থিরতা ও উল্লম্ফনতাজনিত কারণে যথাযথ প্রতিস্থাপনের ব্যর্থতা এবং জারিত ভাবের সাথে ভাষার সংশ্লেষণজনিত কারণে যথারূপে কবিতায় উপস্থাপনের দৌর্বল্য। ফলে কবির প্রাথমিক ভাবনার বিচ্যুতি নিয়ে যে কবিতার জন্ম হলো, পাঠক পড়তে গিয়ে ওই মিসিং অংশের ব্যাপকতার জন্য তার সাথে সংযোগ ঘটাতেও ব্যর্থ হলো। এতে প্রথমেই পাঠকের পাঠ-পিপাসা নিহত হয়ে যায়। এভাবে অধিকাংশ কবিতা পাঠ শুরু করলেও শেষোব্দি পৌঁছায় না। পাঠ-আগ্রহ নিহত হয়ে যাওয়ার কারণে। বাংলা কবিতার এ এক দুঃখজনক নিয়তি।
আরও পড়ুন
আমিনুল ইসলামের কবিতা: বিষয় ও মানস
জসীম উদ্দীনের সাহিত্য ও বাংলার লোকজ চেতনা
নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আমি হাসান হাফিজের কবিতার পাঠক। তার কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কখনোই আগ্রহ হারিয়ে ফেলিনি। (আগ্রহ জেগে থাকাটাও কবিতা মূল্যায়নের একটি মাপকাঠি। যদিও তা একাডেমিক নয় বা প্রচলিত মূল্যায়নের কোনো অনুমোদিত মাপকাঠিও নয়। কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।) বোধকরি নগণ্য পাঠক হিসেবে একজন কবির কবিতার শেষোব্দি পাঠ এবং পুনঃ পুনঃ পাঠের আগ্রহ রক্ষিত হওয়া তার কবিতার এক বিশেষ গুণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। হাসান হাফিজের কবিতা এরকমই। আরেকটি কবিতা পড়া যাক—‘তৃণলতা তৃণলতা বোঝো না তুমি মনোব্যাথা/ সে কারণে চোখ ভেজে শিশিরে ফোঁটায়/ তৃণলতা ক্ষুদ্র তুমি কিন্তু মনে বড়ো/ আবেগের উষ্ণ ঢেউ দীপ্র থরোথরো/ সর্বাঙ্গে বিষের তাপ ছিন্ন জরোজরো/ তৃণলতা আমি তার অভাবে অচল হয়ে/ আছি পড়ে চলচ্ছক্তিহীন জরোজরো/ তৃণলতা তৃণলতা উহাকে ফিরিয়ে আনো/ সে এসে তাচ্ছিল্য দিক তারপরও ফিরে আসুক/ ও বন্ধু দোহাই তোমার তুমি কিছু একটা করো’ (কিছু করো তৃণলতা)
প্রেমে আবিষ্ঠ হয়ে তৃণলতার কাছে আকুতি—নিশ্চয়ই প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে নুতন আবহ। প্রেমাষ্পদের ফিরে আসার অনুরোধ ও আকুতির মধ্যে কবির মনের অস্থিরতা দীপ্যমান হয়ে উঠছে। পাঠ শুরুর পর এই কাব্যের শেষোব্দি না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বস্তি মেলে না। কারণ হলো ওই পাঠ পিপাসার জন্ম দিয়ে আগ্রহ ধরে রাখা। আর এমন গতিময় এর ভাষা, এমন যথার্থ এর শব্দচয়ন, এমন ভঙ্গি আর মনোলোগ—এমন কবিতার কাছে তো পাঠক ফিরতেই চাইবে বারবার।
কবিতার অধরা আলোর কাছে আমাদের আরও কিছু চাওয়া থাকে। যেমন অন্য অনেকেই যে চোখে দেখে, যেভাবে ভাবে—কোনো একজন কবির দেখা এবং ভাবা ঠিক সেরকম হবে না। ভিন্ন হবে। ভিন্ন আঙ্গিক থেকে তিনি দেখবেন, ভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে তিনি আলো ফেলবেন। এসব করলেই না তাকে আমরা স্বতন্ত্র স্বরের কবি বলবো। কবি হিসেবে নিজেকে মহাকালের অংশ করার ক্ষেত্রে গুণটি অপরিহার্য। এটা না থাকলে ঝাঁকের কইয়ের মতো উত্থান হয়ে নিমিষেই হারিয়ে যায়। হাসান হাফিজ কবি হিসেবে এখানেও উদাহরণীয়। ভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখার, ভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে আলো ফেলার এক অপূর্ব পর্যবেক্ষণীয় ক্ষমতা রয়েছে তার। অসংখ্য কবিতায় তার এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এ রকম একটি কবিতা পড়া যাক—‘গোলাপ ফুল পাখি নয়/ তারপরও উড়তে চায় অনন্ত আকাশে।/ মেঘলোকে উড়তে পারে না বলে/ তার মনে বিষাদ পাথর হয়ে জমে/ তার প্রিয় ঠাঁই হচ্ছে তরুণীর খোঁপা/ চুলের চুম্বনে হবে সম্পন্ন সার্থক।/ তরুণীর মনে ঢেউ অশান্তির মুখ ভার—গোলাপের বিকশিত সৌন্দর্য সে/ এক পলক চেয়েও দেখে না,/ প্রেমিকের সঙ্গে তার হঠাৎ-বিচ্ছেদে/ দুই চোখ হয়ে উঠছে নোনাজলে সমুদ্র সমান/ ব্যথিত তরঙ্গরাশি স্বপ্নচূড়া ভেদ করে/ নিজের দেশের সীমা পার হয়ে উর্ধ্বাকাশে/ আশেপাশে তাকানোর সময় কোথায়?’ (গোলাপ যখন উপেক্ষিত)।
গোলাপ ফুল ফুল হলেও সে পাখি-রূপ পেতে চায়। উড়তে চায় আকাশে। গোলাপের নিকট থেকে তার কোনো মনোবাঞ্ছা না জানা গেলেও কবির কল্পনায় তাকে পাখি-রূপ দেওয়ার বাসনা লক্ষ্য করা যায়। ওই যে ভিন্ন চোখে দেখা ও দেখানোর যে গভীর ক্ষমতার কথা বলা হলো, কবিতাটিতে হাসান হাফিজের সে-লক্ষ্যই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
সেই সত্তরের দশক থেকে লিখে আসছেন কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ষাটের ওপরে। এখনও লিখে চলেছেন সমানতালে। লেখার সংখ্যার দিকে তাকালে তাকে অবিরল প্রসবী বলতেই হবে। শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে, পেশাগত ও সামাজিক ব্যস্ততা পেরিয়ে সমানতালে অবিরল কবিতা লিখে যাওয়া সহজ কথা নয়। একজন শিল্পীর শিল্প-প্রয়াসের এই সহজতা তার স্বতস্ফূর্ততার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। খুব বেশি শিল্পীর এই ক্ষমতা থাকে না। হাসান হাফিজের এই ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। কবির জন্মদিনে তাকে অফুরন্ত অভিবাদন জানাই।
এসইউ/এএসএম