রবীন্দ্রনাথকে কি উত্তর-আধুনিক বলা যাবে: পর্ব-০১

রবীন্দ্রচিন্তার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে ১৯৪১ সালে। সাহিত্য ও দর্শন চিন্তায় যে কালের বিভাজন তার নিক্তিতে উত্তর-আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে তারও বছর বিশেক পর। সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, ১৯৬০ এর দশকে ফরাসি দেশে আধুনিক চিন্তার অবসান ঘটে। শুরু হয় উত্তর-আধুনিক চিন্তার সঙ্গহীন যাত্রা। আপেক্ষবাদী দর্শনের বিপুল তাড়নায় কাঠামোবন্দী চিন্তার ওপর যে আঘাত আসে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি দেখা দেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চরম উৎকর্ষতায়। ‘আমরা’ থেকে হয়ে পড়ি ‘আমি’। কবি Walt Witman যেমনটা বলছেন, ‘I celebrate myself and sing myself,/ And what I assume you shall assume,/ For every atom belonging to me as good belongs to you.’ (Song of Myself)। এ সময় আমিত্বের একটি স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে ইউরোপ জুড়ে। শুধু ইউরোপই নয়, এ বাতাস পৌঁছায় গিয়ে আটলান্টিকের ওপারে। ইউরোপ আমেরিকায় এ নতুন স্রোতের যারা কারিগর হয়ে ওঠেন, তাঁদের মধ্যে মিশেল ফুঁকো, লুসি ইরিগ্যারি, জ্যকুইস লাকা, জুডিথ বাটলার, লুইস অ্যালথুসার, গায়িত্রী স্পিভাক প্রমুখ যুক্ত হন। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ফেমিনিজম, সাইকোঅ্যানালিসিস, সমাজবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান, মনোচিকিৎসা, ইত্যাদি শাখায় ঘটে যায় বড় একটি বিপ্লব। সেখানে দেখা গেল, ‘সীমাহীন বিষয়ে সংখ্যাতীত পাঠসৃষ্টি এতে সম্ভব। নৃতত্ত্ব, শিল্প, ইতিহাস, চলচিত্রবিদ্যা, লিঙ্গ, জিজ্ঞাসা, ভাষাবিদ্যা, দর্শন এবং রাজনীতিতত্ত্ব ও মনোবিদ্যা ও বিশ্লেষণ, বিজ্ঞানচর্চায়, সমাজ ও বুদ্ধিবাদী ইতিহাস এবং সমাজ বিজ্ঞান—এ তাত্ত্বিক চিহ্নায়নের অন্তর্ভুক্ত।’ (নবেন্দু সেন, পোস্ট মডার্নইজম এবং অন্যান্য: তত্ত্ব ও প্রযুক্তি)।
তবে খুব নির্দিষ্ট করে বলা যায়, ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা বিনির্মাণ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে শত শত বছরের চিন্তার কাঠামো ভেঙে দিলেন; সাথে সাথে সেটা নতুন আঙ্গিকে পৌঁছে গেল ভাবনার এক ঝাপসা বারান্দায়। বাস্তব থেকেও বেশি বাস্তব হয়ে উঠলো ইমেজ বা সিম্বল। আর এরই সঙ্গে ধীরে ধীরে পাল্টে গেলো বাস্তবকে পেছনে ফেলে আত্মস্বীকৃত সত্যের জালে ধরা পড়া নতুন এক পরাবাস্তব। লেখকের অহংকার চূর্ণ হলো, জয় হলো পাঠকের। লেখক বা অথোর, রিডার বা পাঠক ও নতুন বোধ (টেক্সট) এই ত্রিমাতৃকতার সঙ্গমের মধ্য দিয়ে লেখকের পায়ের নিচে যে শক্ত মাটি ছিল, তা হয়ে গেল নড়বড়ে। লেখকের একচ্ছত্র আধিপত্যের জায়গাটা নষ্ট হয়ে চলে গেল পাঠকের হাতে। সবকিছু নতুন করে ভেঙে বানানো হলো ‘টেক্সট’। ঘুড়ি যেমন নাটাই থেকে ছিঁড়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না, লেখকের অবস্থা দাঁড়ালো ঠিক সেরকম। লেখক আর পাঠকের মাঝে অবধারিতভাবে যে টেক্সট ভিড়ে গেল, তা কিন্তু বহুতল ভবনে ওঠার সিঁড়ির মতন। এই আছে একরকম, পরক্ষণেই আরেক। ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বিড়াল’। বিশ বছর আগে পথের পাঁচালি পড়ে যে বোধ সৃষ্টি হয়েছিল, আজ সে বোধের ব্যাপক পরিবর্তন; প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত মানুষের এই বোধান্তর নিত্য ঘটনা। এই পরিবর্তন জীবনেরই ধর্ম। এটা ঠিক যদি সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল; ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁক প্যাঁকে হাঁস। এটা কেন হয়? এটাই হওয়া স্বাভাবিক না? মানুষের বোধ তো সময়-স্থানের তৈরি করা সম্পদ। আর সেটা তো চলমান বিশ্বভূমির ওপর কালের ছায়া । ‘পাতার ভেলা ভাসাই নীরে/ পিছন-পানে চাইনে ফিরে/ কর্ম আমার বোঝাই ফেলা, খেলা আমার চলার খেলা।/ হয়নি আমার আসন মেলা, ঘর বাঁধিনি স্রোতের তীরে।’ এটাই তো ক্রমন্বত বিশ্ববোধ। কাজেই তথাকথিত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা একই ছাতার নিচে নিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করার প্রবণতা হয়ে পড়ে বড্ড হাস্যকর।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া আরও কিছু ভাবনা সেখানে যোগ হলো, যেমন তথাকথিত বিভাজনের ফলে চিন্তার যে একটা দ্বিকটিক বিভেদ সৃষ্টি হয়, যার দরুন কোনটাকে উঁচু কোনটাকে নিচু ভাবার প্রবণতা গড়ে ওঠে, সেই বোধিক-অনাসৃষ্টিকে রোধ করার পথ দেখিয়েছেন দেরিদা। রবীন্দ্রনাথ ঠিক যেন এই কথাটাই বলে ফেললেন, ‘যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়/ সকলই দুর্লভ ব’লে আজি মনে হয়।’ উত্তম অধম মনে করে একটাকে বেছে নেওয়ার এই সেকেলে প্রবণতা বুঝি এখানে এসে থেমে গেল। গলা ফাটিয়ে বলতে শোনা গেল, ‘আমার চোখে তো সকলই শোভন,/ সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন।’ যাই হোক উত্তর-আধুনিক পর্বে প্রবেশের আগে দেখে নিই, আধুনিকতার রকমফের।
জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে/ আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি/ বলি আমি এই হৃদয়েরে/ সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!’ সাহিত্যে ও চিন্তার বিভিন্ন ডেরায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জয়রথের মধ্যদিয়ে আধুনিকতা জায়গা করে নেয়। তবে সেটা অবশ্যই সরল ও একমাত্রিক। একটা মজবুত শক্ত ভিতের উপর গড়ে ওঠা মোটামুটি একরৈখিক ভাবনার সরল প্রত্যাগমনের নামই আধুনিকতা। আধুনিকতা মানেই পুরোনোকে ছেড়ে নতুনকে গ্রহণের এক অব্যাহত চেষ্টা। আধুনিকতা প্রত্যয়টা বড্ড বেশি গোলমেলে। কেউ এটাকে জানিয়েছেন স্বাগত, কেউ আবার তুলনা করেছেন অন্ধকারের সাথে। কেউ আবার একটু অন্যপথ মাড়িয়েছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইভাবে যে আধুনিকতাবাদীরা ভিক্টোরিয়ান যুগের অনেক ভালোকিছু সম্পর্কেও উদাসীন। আইরিশ কবি Joseph Campbell ‘Darkness’ কবিতায় আধুনিকতার পেছনে যে অন্ধকারের ছায়া দীর্ঘ হতে থাকে তা বুঝিয়েছেন ছোট্ট কয়েকটা লাইনের মধ্যে, ‘I stop to watch a star shine/ in the boghole-/ A star no longer, but a silver/ ribbon of light/ I look at it and pass one’। নক্ষত্র হচ্ছে আলো ও ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক, আলো অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে পড়ে, মানুষকে মুক্ত করে। নক্ষত্র রাত্রির সৌন্দর্য, কিন্তু সেই সৌন্দর্য মানুষ না দেখে আধুনিকেরা নিঃশব্দে অতিক্রম করেছেন দ্রুত পদসংবাহনে। তবে মোটা দাগে আধুনিকতাকে অতিক্রম করতে হয় অনেক বন্ধকতার দেয়াল টপকিয়ে। নতুন বউ দেখতে আসা পাড়ার সবচেয়ে কুটনি বুড়ি যেমন ঘোমটা তুলে ভুরু বাঁকা করে নানারকম ভঙ্গী করতে থাকেন, আধুনিকতা শব্দটার সাথে অনেকের ভঙ্গিমার এ ধরনের মিল খুঁজলে বড্ড অশোভন হয় না। রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে তাকে যে চলতে হয়েছে! আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখছেন, ‘আমার অভিধানে ‘আধুনিকতা’ বহু বিচিত্র-অর্থবাহী, শুধুমাত্র প্রশংসা বা নিন্দা-সূচক শব্দ নয়।’ (আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, ১৫)। দীর্ঘকালের আচার ভেঙে ভিন্নমুখী বাঁক নেওয়ার প্রবৃত্তিকেই আধুনিকতা বললে হয়তো এর সঠিক ব্যঞ্জনা দাঁড়াবে।
সুইস ভাষা-দার্শনিক ফার্ডিন্যান্ড ডি স্যুসরকে আমরা বলি আধুনিক ভাষাতাত্বিক চিন্তার উদ্গাতা। ভাষার কাঠামোবাদ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্যুসর সাহেব জোর দিয়েছিলেন সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফাইডের ওপর। অর্থাৎ তিনি মনে করেন, ভাষার শব্দ ও অর্থের মধ্যে সম্পর্কটা সম্পূর্ণটা মানসিক, বাহ্যিক নয়। স্যুসর মারা যান ১৯১৩ সালে যে বছর রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। নয়া আমলে বিখ্যাত আমেরিকান দার্শনিক চমোস্কি কিন্তু ভাষার সহজাত কাঠামো ও অর্থের ওপর গুরুত্ব দিলেন। চমোস্কি পুরোনো কার্তেসীয় মোড়কে ভাষার উপাচার পরিবেশনের পক্ষপাতী। এতে কী দাঁড়াল? ভাষা যে সাহিত্যের বিচিত্র রং নিয়ে আমাদের চোখের সামনে হাজির হয় তাকে সূত্রের মধ্যে ফেলা স্বাভাবিক। বিশ শতকের শুরুতে ইউরোপে সাহিত্য ও শিল্পকলায় একের পর বিভিন্ন আন্দোলনের নামে পুরোনো ঐতিহ্য ভেঙে যায়।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুরেরিয়েলিজম নামে শিল্পের বিভিন্ন পরীক্ষা চলতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর দাদাইজমের প্রসার সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বদ্ধ ঘরের জানালা হুট করে খুলে দিলে যেভাবে বাতাস ঢোকে ঠিক যেন সেটাই এসব আন্দোলনের নিশ্বাস। জেমস জয়েসের ইউলিসিস কিংবা টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড আধুনিক সাহিত্যের চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে যায়। এজরা পাউন্ডের মতে, টি এস এলিয়ট আধুনিক চিন্তার গাছকে মাটিতে পুঁতে তাকে পরিপুষ্ট করেছিলেন। ১৯২২ সালে তাঁর ওয়েস্ট ল্যান্ড প্রকাশিত হলে এই ভাবনা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। বিশ্বযুদ্ধ মানুষের স্নায়ুকে ভেঙে দিয়েছিল। সেখান থেকে উঠে এলিয়ট তাঁর কবিতা সম্পর্কে লিখলেন, ‘জীবনের বিরুদ্ধে একটি ব্যক্তিগত এবং সম্পূর্ণ নগণ্য ক্ষোভের ত্রাণ... কেবলমাত্র ছন্দময় গুঞ্জনের একটি অংশ।’ সোজা কথায়, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য, মূল্যবোধ ও ইতিহাসের নানা বাঁকে মানুষের চিন্তার যে পরিবর্তন দেখা দেয়; সেটাই আধুনিকতা। কিন্তু কোনো ভাবনায়ই স্থায়ী নয়। ‘ওরে দেখ সেই স্রোতে হয়েছে মুখর,/ তরনী কাঁপছে থরথর।/ তীরের সঞ্চয় তোর পড়ে থাক তীরে,/ তাকাস নে ফিরে/ সম্মুখের বাণী/ নিক তোরে টানি/ মহাস্রোতে।’ সত্যি তাই, ‘সে সকল দিন সেও চলে যায়।’
চলবে...
বিজ্ঞাপন
এসইউ/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন