ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

ফারজানা অনন্যার গল্প: নরকের গান

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

রাত প্রায় নয়টা।
ঢাকার এক পুরোনো গলির ভেতর নেমেছে স্যাঁতসেঁতে কুয়াশা। রাস্তায় কুকুর ঘুরছে, দোকানগুলো আধখোলা, বাতাসে নিকোটিনের গন্ধ। একচিলতে টিনের ঘরে বসে আছে ইন্দিরা। দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকায় সে। আলোয় ভিজে ওঠা শহর, রিকশার টুংটাং আর দূরে মিলিয়ে যাওয়া গানের আওয়াজ।
‘আজও কেউ আসেনি?’
মাসি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘তোকে দেখে সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। কাল আরেকজন সাহেব আসবেন। আজ থাক।’
ইন্দিরা জানে, ‘থাক’ মানেই আজ উপোস। চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকায়। একটা বহু পুরোনো রুপার আংটি অনামিকা আঙুলে, চুড়ি ক’টা ফাটা, নখের কোণে কালচে দাগ। তারপর আয়নায় মুখ দেখে ইন্দিরা আপন মনে হাসে, ‘এই মুখটাই তো একদিন কলেজে সবাই সুন্দর বলতো!’

সাজতে বসলো ইন্দিরা। মানুষের চোখে ধাঁধা লাগাতে হলে সাজপোশাকের অন্তরালে জীবনের যন্ত্রণা আর কুশ্রীতাকে গোপন না করলে চলে না। সাজগোজ সমাপ্ত করে সে পথে বেরোল। অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হবে। অনেকদিন বাদে উঁচু জুতা পায়ে দিয়ে চলতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু একেবারে অনভ্যস্ত নয় বলে তার চলন নিতান্ত অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল না।

রাতের শহরটা যেন একটা জ্বলন্ত চুল্লি। নিয়ন আলোর ঝিকিমিকিতে লাল, নীল, সবুজ রং মিশে যায়, তার মাঝে ল্যাম্পপোস্টের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দিরা। ইন্দিরার চোখ দুটো জ্বলছে। জীবনের সমস্ত বিরস বিস্বাদ পাত্রে চুমুক দিয়ে তিক্ত মুখে কোনো অস্থিরতা যেন সে চোখকে আশ্রয় করেছে। বাইরে থেকে ইন্দিরার আচরণ প্রফুল্ল উদ্ধত হলেও অসহায় কাতরতাটুকু শুধু ওই চোখ দুটোতে স্পষ্ট! ইন্দিরার পরনের শাড়িটা লাল, রক্তের মতো লাল। শাড়িটি যে সমস্ত উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য খুইয়ে বীভৎস প্রৌঢ়ত্বে এসে পৌঁছেছে এটা সহজেই বোঝা যায়। ঠোঁট লাল, চোখে লাল রঙের প্রসাধনী। রক্তিম আভা যেন ইন্দিরার অন্তরে আর বাইরে। ইন্দিরার অন্তরাত্মা নিভৃতে চিৎকার করে। সে চিৎকারে বেদনা নেই। আছে শুধু যেন সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। গাল বেয়ে ঝরে পড়া পানি কান্না নয়—সৃষ্টির প্রতি অভিশাপ।

প্রতি রাতে পুরুষেরা আসে, টাকা দেয়, শরীরী উষ্ণতা নিয়ে চলে যায়। ইন্দিরার ব্যাগে আজ মাত্র পঞ্চাশ টাকা। কাল রাতে একজন খদ্দের এসেছিল, পাঁচশ টাকা দিয়েছিল। তার অর্ধেক গেছে দালালের পকেটে, বাকি গেছে ঘরভাড়ায়। হাতে এসেছে পঞ্চাশ। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। সকাল থেকে একমুঠো মুড়ি ছাড়া কিছু খায়নি। পাশের দোকানে চা-বিস্কুট দেখে লোভ হয় কিন্তু পঞ্চাশ টাকা দিয়ে চা খেলে কাল সকালে কী খাবে? ইন্দিরার বাস একখানা টিনের চালার ঘরে। ভেতরে একটা খাটিয়া, প্লাস্টিকের চেয়ার আর মেঝেতে একটা ছেঁড়া কাঁথা। দেওয়ালে ঝুলছে একটা পুরোনো ক্যালেন্ডার। তার ঘরে আরেকজন থাকে, মিনু। শরীর বেচতে ওরা ধর্মের ভেদাভেদ ভুলেছে। শরীর ওদের রাজপাট। মিনুকে দিদি ডাকে। মিনুর বয়স বেশি, শরীর ভেঙে গেছে। খদ্দের আসে না। ইন্দিরার কাছে থাকে মিনু, খাবার ভাগ করে খায়।

ভাগ্যদেবতার লিখন আর মানুষের দেওয়া প্রবঞ্চনাতে ইন্দিরা এ পেশায় এলেও নিষ্ফল দুঃখকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়নি কখনো। মাঝে মধ্যে চোখ আর অন্তরজ্বালা করলেও জীবনকে উপভোগ করে ইন্দিরা। জীবনের রূপ, রস, গন্ধ মেখে নেয় সমগ্র সত্তায়। তবে এক বিপুল অতৃপ্তি দিন-রাত ইন্দিরাকে পীড়া দেয়—বিয়ে, পরিপূর্ণ জীবন, বৈধ পুরুষের সাহচর্য, একটি একান্ত নিজস্ব সংসার রচনার আনন্দ, অস্পষ্টভাবে এ সমস্ত কিছুর জন্য ক্ষুধা তার অন্তরকে ব্যথিত করেছে। কেবলই অস্পষ্টভাবে মনে হয়েছে এই একক জীবন ব্যর্থ, পঙ্গু।

এই যে গৃহিণীরা, সকালে উঠে চা বানায়, বাচ্চার টিফিন সাজায়, স্বামীর শার্ট ইস্ত্রি করে—ওই জীবনকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল ইন্দিরা। প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে হাতে শাঁখা-পলা পরে সিঁথিভর্তি সিঁদুর নিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে পূজো সমাপনের একটা জীবন চেয়েছিল। কিংবা ওই যে মেয়েগুলো শাড়ি পরে ব্যাগ কাঁধে অফিসে যায়, ওই জীবনেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল। ভাবতে ভাবতে হাসি ফুটে ওঠে ইন্দিরার মুখে। এ যেন দীন সংসারের বুকে হতাশার হাসি। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথম যে লোকটা তাকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিল, সে-ই তাকে এই গলিতে এনে বিকিয়ে দিয়েছিল। বয়স তখন সতেরো। আজ সাতাশে পৌঁছে ইন্দিরার উপলব্ধি হয়— জীবন আসলে এক বিকৃত ক্ষুধার বাজার। কেবলই মনে হয়, জীবনের সঙ্গে তার একটা হিসাব বাকি রয়ে গেছে—যেন জন্মই তার ভুল ছিল।
মনোজগতে চলে ফেলে আসা বেদনার বিরুদ্ধে অভিশম্পাত।

পেছনের সিট থেকে ফিসফিসানি চলে। রেণু শুনেও কিছু শোনে না, বলে না। জানালা থেকে বাইরে তাকায়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। জানালা বন্ধ করে না রেণু। চলন্ত বাসে বৃষ্টির ঝাপটা চোখ-মুখ ভিজিয়ে দেয়। রেণু মুখ ঢাকে ওড়নায়।
অফিসের সেই দৃষ্টি—পুরুষ সহকর্মীদের ভ্রূকুটি, ম্যানেজারের কু-ইঙ্গিত, পাড়ার ছেলেদের ফিসফাস, সংসারের ঘানি—সব মিলিয়ে রেণুর শূন্য লাগে সব। বাস চলতে চলতে বৈদ্যুতিক বাতির তারগুলো সাপের মতো এগিয়ে আসে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেণুকে। রেণু ছটফট করে না, চিৎকার করে না, একটা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উল্লসিত হয়। রেণু ভাসতে থাকে বাতাসে। ‘আপা আইয়া পড়ছেন’—বাসের হেলপারের ডাকে ঘোর কাটে রেণুর। অফিসের বাস থেকে নামে।

রেণু একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জুনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সকাল সাতটায় বাস ধরে, রাত নয়টায় ফেরে। মাইনে? দশ হাজার টাকা। খাওয়া, ঘর ভাড়া, মায়ের ওষুধ, বোনদের পড়াশোনা—সব মিলিয়ে মাস শেষে হাতে থাকে শূন্য। এক পুরোনো গলির পলেস্তরা খসা জীর্ণ ভগ্নপ্রায় পাকা ঘরে থাকে রেণুর পরিবার। ভেতরে একটা খাটিয়া, ছোট টেবিল, চেয়ার আর দেওয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো পারিবারিক ছবি। যখন রেণুর বাবা বেঁচে ছিলেন, তখনকার। জমানো সম্পদের মধ্যে আছে কয়েকখানা শাড়ি, মা দিয়েছিল বিয়ের সময়। বিয়েটা হয়নি। শাড়িগুলো রয়ে গেছে। রেণুর সংসারে চারজন। বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক হলো। মা শয্যাশায়ী, আর এক ছোট দুটি বোন। পড়াশোনা করছে স্কুলে। দশ হাজার টাকায় ঢাকার শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে থেকে চার চারটে পেট চালানো। প্রতি রাতে সে হিসাব করে—কাল কী খাবে, কত টাকার ওষুধ কিনবে।
রেশন দোকান থেকে চাল তোলা যায়নি। টাকার অভাবে। মায়ের ইনহেলার শেষ, বোন কাশছে, রেণু বসে হিসাব করছে—মাসের শেষ পর্যন্ত কত ধার করলে চলা যাবে!

বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে রেণুর মনে হয়, শহর নয়তো যেন প্রেতপুরী। পথে-ঘাটে ময়লার ছড়াছড়ি। চারপাশে লোলুপ দৃষ্টি। মাঝে মধ্যে বিষণ্নতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে রেণু। কালো মেঘে ঢাকা গাঢ় অন্ধকার আকাশ বেয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন। ছাতাটা মেলে ধরে সারা রাজ্যের ক্লান্তি শরীরে নিয়ে সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চাদের মতো টলোমলো পায়ে চলছিল। ইচ্ছে নেই চলার, তবুও চলছে। চলতে হচ্ছে। হঠাৎ পেছনে কার পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল। ভালো করে দেখেও চিনতে পারলো না, তবে বুঝতে পারলো। হ্যাংলা-রোগাটে দেহ। তেলবিহীন রুক্ষ চুল। মুখজুড়ে উজ্জ্বল রঙের প্রসাধন। লম্বা নাক। খাদে ঢোকা দুটি বড় বড় চোখ। বৃষ্টিটা আরও একটু জোরে আসতেই মেয়েটা পা চালিয়ে রেণুর ছাতার নিচে এসে দাঁড়াল। ‘উহ্ এ বৃষ্টিতে ভেজা মানে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হইবো।’ একটা ম্লান হাসি ছড়িয়ে রেণুর দিকে তাকাল মেয়েটা। ঝেপে বৃষ্টি আসাতে ছাতা নিচে রাস্তার পাশে সরে দাঁড়ায় ওরা।

‘এসেছেন কোথা থেকে?’ সোজাভাবে জিজ্ঞেস করল রেণু।
‘ওই রেলব্রিজের নিচে দাঁড়ায়া আছিলাম।’
মনটা খারাপ হয়ে যায় রেণুর। ইন্দিরার সাজপোশাক, কথা বলার ধরনে বুঝতে পারে সব।
‘আপনে কী করেন?’
এবার রেণুর উত্তর দেওয়ার পালা।
‘একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জুনিয়র অ্যাকাউন্ট্যাট পদে আছি। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা। ওখান থেকে আর বাড়ি আসি না, অফিসের কাছেই দুটো টিউশনি করাই। টিউশনি শেষে অফিসের সাড়ে আটটার শিফটের গাড়িতেই বাড়ি ফিরি।’
‘তাইলে দিনে প্রায় বারো ঘণ্টা কাজ করেন? বলেন কী? তো বেশ সুখেই আছেন। অনেক টাকা রোজগার হয়। এত টাকা করেন কী?’ মুরুব্বিয়ানা চালে কথাগুলো বলল ইন্দিরা।
রেণু ম্লানভাবে হাসে। দিনগুলো কীভাবে কাটে, তা কেবল রেণুই জানে। বৃষ্টি থামলে রেণু হাঁটা শুরু করে, ইন্দিরা আবার রেলব্রিজের নিচে দাঁড়ায়।

রেণু ঘরে ফিরে গোসল সেরে মায়ের বিছানার কাপড়-চোপর ধুয়ে বারান্দায় মেলতে এসে দেখে হঠাৎই গোলমাল। রেলব্রিজের নিচে ভিড় জমেছে। রেণু দৌড়ে গিয়ে দেখে, এক মাতাল লোক ফেরার পথে দেখা হওয়া মেয়েটার চুল ধরে টানছে। মেয়েটা কাঁদছে, গায়ে রক্ত, কাপড় ছেঁড়া।
রেণু চিৎকার করে বললো, ‘ছাড়!’
লোকটা তাকালো। চোখ লাল, মুখে মদের কড়া গন্ধ।
‘তোকে কে বলছে বাঁচাতে?’
রেণু একটা ভাঙা ইট তুলে মারলো মাথায়। লোকটা ছুরি বের করেছিল কিন্তু ভিড় দেখে আর ঘাটাতে সাহস করলো না। দৌড়ে পালালো। ইন্দিরাকে রেণু ধরে দাঁড় করালো। ওরা পরস্পরের নাম জানে না। ইন্দিরার মাথা নিচু, ঠোঁটে শুকনো রক্ত।
রেণু জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার নাম?’
মেয়েটি ফিসফিস করে বললো, ‘ইন্দিরা।’

ইন্দিরাকে সে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। ঘরের অবস্থা দেখে ইন্দিরা থমকে গেল! মেঝেতে মায়ের কাশি, একপাশে জলের কলসি ফাঁকা, বোন দুটির চোখে ক্ষুধা। রেণু জলের গ্লাস এগিয়ে দিলো, ‘খান। ভয় পাবেন না।’

একটা অজানা পৃথিবী যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে ইন্দিরার চোখের পর্দায়। স্থির পাথরের মতো তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ‘আরে দাঁড়িয়ে রইলেন যে; বসুন, বসুন।’ অন্ধকারের ভেতর ওর দিকে একটা হাতলভাঙা চেয়ারটা এগিয়ে দিলো রেণু। ইন্দিরা বসলো। বাতি জ্বললো, ঘরের চারপাশে আলোতে চোখ বুলিয়ে নিলো ইন্দিরা। ছোট্ট পরিসরের ঘর। মাঝখানে একটা চাটাই দিয়ে দুভাগ করা হয়েছে ঘরটাকে। আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। একটা দড়ির খাটিয়া। একটা পুরোনো টেবিল, একটা প্লাস্টিকের হাতলভাঙা চেয়ার আর দেওয়ালে একটা পারিবারিক ছবি। বারকয়েক ভ্রূ কোঁচকালো ইন্দিরা।

‘অ্যা! মা, আমার টাকা! টাকা গেলো কোথায় মা?’ বুক ফাটা চাপা আর্তনাদে চমকে উঠে ফিরে তাকাল ইন্দিরা।
‘মেয়েটা কি হার্টফেল করবে নাকি? নইলে অমন করছে কেন?’
‘টাকা! টাকা! টাকা! কী সর্বনাশ হলো গো আমাদের। কী সর্বনাশ হলো!’ সরু মোটা অনেকগুলো কণ্ঠের চাপা গোঙানির শব্দ যেন চাবুক মেরে গেল ইন্দিরার বুকে, পিঠে, পেটে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
‘কী হইছে? আপনারা অমন করতাছেন ক্যান?’ ঠিক নিজেও বুঝতে পারল না ইন্দিরা। কখন সে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। রেণু কঁকিয়ে যা বললো, তা শুনে রীতিমতো ঘামিয়ে উঠল সে। আজ অফিসের বেতনের দশ হাজার টাকা বেমালুম উধাও হয়ে গেছে রেণুর ব্যাগ থেকে। বাসে করে যখন অফিস করে টিউশনে যাচ্ছিলো, তখন বোধ হয় কেউ ব্যাগ থেকে তুলে নিয়েছে বলে তার ধারণা।

‘ওই তো, আপনার ব্যাগে ছোট পকেটটাতেই তো আছে টাকাগুলো।’ আনন্দে আটখানা হয়ে পড়লো ইন্দিরা। যেন এভারেস্টর চূড়োয় উঠেছে।
‘না না, এটা এ মাসের চলার শেষ সম্বল একশ টাকার একটা নোট। গত মাসের টিউশনের বেতন থেকে কিছু রয়ে গিয়েছিলো।’ সরবে প্রতিবাদ জানায় রেণু। তারপর নির্বিকারভাবে মুখের লাগাম খুলে দিলো সে। পকেটমারের চৌদ্দ পুরুষের পিণ্ডি চটকাবার উদ্দেশ্যে। ইন্দিরা তখনো নির্বাক।

টাকার শোকে একেবারে মুষড়ে পড়লেও ইন্দিরার যত্ন নিতে ভুললো না রেণু। ছেঁড়া কাঁথার ওপর নিজের একখানা পুরোনো শাড়ি বিছিয়ে দিয়ে ইন্দিরার শোবার বন্দোবস্ত করে দিলো। হাঁ না কিছুই করলো না ইন্দিরা। সোজা শুয়ে পড়লো সে। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো ওর।

আরও পড়ুন
লাল শাড়ি ও রাতের গল্প
আয়েশা সিদ্দিকার গল্প: প্লান্টোফাইল

শুলো কিন্তু ঘুমালো না। জেগেই রইলো ইন্দিরা। আর অপেক্ষা করতে লাগল সবাই কতক্ষণে ঘুমায়। দেওয়ালের সাথে ঝুলানো ভ্যানিটি ব্যাগের সাইডপকেটে একশ টাকার নোট। কিছুতেই ভুলতে পারছিল না সে। ইন্দিরার সম্বল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুঁড়ি উঠে আসতে চাইছে ওর। দূরে কাদের দেওয়াল ঘড়িতে ঢং করে একটা শব্দ হলো। নিরালা পৃথিবী, নিঃশব্দ তন্দ্রায় নিমগ্ন। অতি সাবধানে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনে। আর একটু এগোতেই কান্না-মেশানো স্বরে কে যেন বললো, ‘রেণু মা, হাঁড়িতে কি একটা ভাতও নেই? পেটটা যে পুড়ে গেল।’

অজানা পৃথিবীর আরেক পাঠ! রীতিমতো শিউরে উঠলো ইন্দিরা। অথচ ও ভাবতো চাকরি করা মেয়েরা বড় সুখী। বৃদ্ধা মা এখনও ঘুমোয়নি। ছোট বোন দুটিও না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেমন করেই বা ঘুমোবে ওরা। রেণুর সান্ত্বনাবাক্য শোনা গেল একটু পরে। ‘মা, একটু সহ্য করো। রাতটা যে কোনোমতে কাটাতেই হবে। ধার করে হলেও ব্যবস্থা করবো।’

এই বৃদ্ধা অসুস্থ মা কিছু না-খেয়েই রাত কাটাবে? ব্যাগে হাত দিয়েও টাকাটা নিতে পারল না ইন্দিরা। মেয়েটার সারা মাসের মাইনে মোট হাজার দশেক টাকা। এ দিয়েই চারটা মুখ নিয়ে কোনোমতে মাস কাটাতে হয়। এবার এই দুইশ আর টিউশনের যৎসামান্য টাকা দিয়ে কেমন করে চলবে এরা? মরে যাবে, নির্ঘাত মরে যাবে। মরে যাবে এই কচি মেয়েটা। ওই হাড় বের করা মাটা। আর ওই বাকি ক’জনা আছে। সবাই ওরা মরে যাবে। উহ্! ভাবতে গিয়ে ইন্দিরার দুঃখ ভরা মনটা যেন শিউরে ওঠে। নিজের অভাব-ভরা জীবনের বেদনা ভুলে যায় ইন্দিরা।

দূরে কার দেওয়াল ঘড়িতে আরও দুটো শব্দ হলো। আর দেরি করলো না ইন্দিরা। ওর হাতের রুপার আংটিটা খুলে নিঃশব্দে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো সে। রুপার আংটিটা এ আঁধারের ভেতরও কেমন চিক্‌চিক্ করছে। দুহাতে আংটিটা অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করল সে। কৈশোরে মা পরিয়ে দিয়েছিল আঙুলে। শত অভাবেও কখনো বেচেনি। মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো চোখে। রেণুর মাই হয়তো ওর মা হয়ে এসেছে। ইন্দিরা চোখ বুজল। চোখ খুলল। তারপর আস্তে আংটিটা ছেড়ে দিলো, দেওয়ালে ঝোলানো ব্যাগের সাইডপকেটে। খস্ করে একটা শব্দ হলো সেখানে। তা-ও কান পেতে শুনল। তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিলো বোধহয়। রাস্তাঘাট ভেজা। বৃষ্টিটা কিছুক্ষণ আগে থেমে গেছে। রাতের আঁধার রাহুমুক্ত হয়ে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের শব্দ। এক পাগল ফকির ঘুম চোখে হাঁটতে হাঁটতে পাশ থেকে গেয়ে যাচ্ছে মীরা বাঈয়ের গান। ‘সাধন করনা চাহিয়ে মনবাঁ ভজন করনা চাই।/ প্রেম লগানা চাহিয়ে রে মনবাঁ প্রীত করনা চাই।’ আজান আর মীরার ভজন মিলেমিশে আরাধনার সুর। কিংবা পৃথিবীর গায়ে ভেসে বেড়ানো নরকের গান।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন