কেমন হলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পহেলা বৈশাখে আয়োজিত ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন এই শোভাযাত্রায়।
নতুন আমেজে, নতুন আঙ্গিকে হয়ে গেলো বাংলা ১৪৩২ বর্ষবরণের উৎসব। সমতল থেকে পাহাড় সবমিলে একাকার এবারের বর্ষবরণের এই উৎসবে। রাজধানীতে আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিল লাখো মানুষ। সবার কণ্ঠে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার। যদিও বর্ষবরণের প্রস্তুতির শেষ সময় পর্যন্ত সমালোচনা আর তর্ক-বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে দেশের রাজনীতিতে। জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবারই প্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলো দেশে। পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন, মোটিফ নিয়ে নানা বিতর্ক এরপর শোভাযাত্রায় সর্বসাধারণের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
- আরও পড়ুন
- পহেলা বৈশাখ আজ, স্বাগত ১৪৩২
- বদলে গেল মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম
- আনন্দ উল্লাসে শেষ হলো ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’
রাজধানীতে রমনার বটমূল থেকে চারুকলা, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ দেশের বিভাগীয় শহর, গ্রাম-গঞ্জেও বর্ষবরণের আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। বলা চলে, বাঙালির সর্বজনীন এই প্রাণের উৎসব ছড়িয়েছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। উৎসবের রঙে নিজেদের রাঙিয়েছেন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন। শোভাযাত্রা, লোকজ সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন ছিল এবারের বর্ষবরণে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা।

বর্ষবরণের দিন সোমবার সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা অংশ নেন। বাঙালিদের পাশাপাশি ২৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে অংশ নেন। মূলধারার এই আয়োজনে অংশ নিতে পেরে খুশি তারা। বর্ষবরণের দিনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ও তাদের চোখে-মুখে।
এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ সংবাদ সম্মেলন করে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম হবে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় আটটি মোটিফ রাখা হয়। এসবের মধ্যে তিনটিই ছিল গণঅভ্যুত্থান কেন্দ্রিক। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’।
এর আগে বর্ষবরণের প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে শনিবার ভোরে এই মোটিফে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কড়া পাহারায় আবারও সেটি তৈরি করা হয়। এই প্রতিকৃতির মাধ্যমে মূলত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার শাসনামলে ঘটা অন্যায়-অবিচার ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে এটিকে শুধু সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার কথা বলেন আয়োজকরা।

শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এইচ এম মেহরাব বলেন, ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ সময়ের সঙ্গে পরিচিত হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে। সময়ের সঙ্গে শোভাযাত্রার চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। এতে রাজনৈতিক প্রতীক ও বার্তা যুক্ত হওয়ার অভিযোগও ওঠে। তিনি বলেন, ২০২৫ সালে চারুকলা অনুষদ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন নামের মাধ্যমে মূলত শোভাযাত্রাকে আবারও উৎসব, ঐক্য এবং সর্বজনীন অংশগ্রহণের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস অবশ্য প্রশংসনীয়।
- আরও পড়ুন
- চারুকলায় ফ্যাসিস্টের মুখাকৃতিতে আগুন
- বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় ২১ মোটিফ
- নতুন বছরে ঐক্য আর সম্প্রীতির প্রত্যাশা
নাজমুস সাকিব নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমেই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে আনন্দ শোভাযাত্রা করাকে স্বাগত জানাই। ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে এই আনন্দ শোভাযাত্রা সব বিভাজন পেরিয়ে সমতা, মানবিকতা আর প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করছে।
আনন্দ শোভাযাত্রায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্যরাও অংশ নেন। এছাড়া অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিদেশি নাগরিকরা অংশ নেন এতে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকায় এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে আনন্দিত তারা।

বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই এই নববর্ষে আমাদের অঙ্গীকার হোক, দেশবাসীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে এমন মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আমাদের সামনে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান বৈষম্যহীন, সুখী-সমৃদ্ধ, শান্তিময় ও আনন্দপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের প্রেরণা দেয়।
- আরও পড়ুন
- বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা
- আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে উচ্ছ্বসিত বিদেশিরাও
- জাতীয় সংগীতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো বটমূলের বর্ষবরণ
অন্যদিকে, শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, অনেকদিন ধরে এটাকে আমরা বাঙালির প্রাণের উৎসব বানিয়ে রেখেছি। কিন্তু এটা বাংলাদেশের প্রাণের উৎসব। কারণ বাঙালি, চাকমা, মারমা, গারোসহ সব জাতিগোষ্ঠী বর্ষবরণ উদযাপন করে। শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, এখানে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। আগেই বরং চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নাম ছিল বর্ষবরণ শোভাযাত্রা, যশোরে। সেখান থেকে ঢাকায় আসার পর নাম হয় ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’।
এসএনআর/জিকেএস