ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

গুম কমিশনের প্রতিবেদন

র‌্যাব সরাসরি গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশিত: ০৮:২৩ পিএম, ০৫ জুন ২০২৫

সন্ত্রাসবাদ, মাদকপাচার ও সংঘটিত অপরাধ দমনে ২০০৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠিত হয়। প্রথমদিকে র‌্যাব অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও অল্প সময়েই এটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে র‌্যাব সরাসরি গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে।

গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বুধবার (৪ জুন) প্রধান উপদেষ্টা ড, মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় ধাপের প্রতিবেদন জমা দেয় গুম কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার (৫ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রতিবেদনের দুটি অধ্যায় প্রকাশ করে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

প্রকাশিত প্রতিবেদনে র‌্যাবের বিস্তারিত ভূমিকা তুলে ধরে বলা হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বহু ব্যক্তি র‌্যাব কর্তৃক আটক হওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছেন বা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এতে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি র‌্যাবের দায়বদ্ধতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিষেধাজ্ঞা

র‌্যাবকে সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী হিসেবে গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময় এটি একটি রাজনৈতিক মৃত্যুদল হিসেবে অভিযুক্ত হয়। বাহিনীটি উল্লেখযোগ্য স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে পরিচালিত হতো, যা দৃঢ় পর্যবেক্ষণহীনতার ফলে ব্যাপক অপব্যবহার ঘটায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মানবাধিকার রেকর্ডের অবনতির কারণে যুক্তরাজ্য এক দশকের বেশি সময় আগে র‌্যাবের প্রতি সমর্থন ও প্রশিক্ষণ প্রত্যাহার করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও এর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

প্রথমদিকে র‌্যাব অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও অল্প সময়েই এটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক হয়ে ওঠে। গুম কমিশন শত শত অভিযোগ পেয়েছে যেখানে র‌্যাব সরাসরি গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বহু ব্যক্তি র‌্যাব কর্তৃক আটক হওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছেন বা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এতে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি র‌্যাবের দায়বদ্ধতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও গোপন আটক

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা তার অপারেশনাল ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতো এবং অনেক গোপন অপারেশন পরিচালনা করতো। এই অপারেশনের মধ্যে ছিল অপহরণ, দীর্ঘমেয়াদি গোপন আটক, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও অস্ত্রপাচারবিরোধী অভিযান নামে অভিযুক্তদের নির্যাতন। সবচেয়ে কুখ্যাত স্থানগুলোর একটি ছিল টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল, যা র‌্যাব-১ কম্পাউন্ডে অবস্থিত। যদিও এটি প্রকাশ্যে আন্তঃসংস্থাগত একটি কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত, বাস্তবে এটি র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার নিয়ন্ত্রণে ছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হাজার হাজার ব্যক্তি এই সেলে সপ্তাহ বা মাসব্যাপী আটক থাকতেন, যেখানে তাদের অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো, চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরা অবস্থায় রাখা হতো এবং তীব্র শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এ কর্মকাণ্ড র‌্যাবকে একটি অবৈধ ও সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে পরিচালিত বাহিনীতে পরিণত করেছে, যা নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের জন্য চরম হুমকি।

বিজ্ঞাপন

নির্যাতনের সাক্ষ্য-প্রমাণ ধ্বংস ও র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি

সাক্ষ্য অনুযায়ী, টিএফআই সেলে আটক ব্যক্তিদের বিশেষ কক্ষে লাগাতার ভয়াবহ নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের কৌশলের মধ্যে ছিল বেধড়ক মারধর, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা, সিলিং থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, বারবার ঘুরিয়ে দিশাহারা করে ফেলা, এমনকি শারীরিক অঙ্গচ্ছেদও করা। শিশু এবং মানসিকভাবে অসুস্থ বন্দিরাও এই নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি। যদিও কেন্দ্রটি মূলত সেনাসদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হতো, সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারাও সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন।

বন্দিদের দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আনা হতো—কাউকে র‌্যাব গোয়েন্দা শাখা সরাসরি অপহরণ করে আনতো, কেউ ডিজিএফআই বা স্থানীয় র‌্যাব ব্যাটালিয়ন থেকে স্থানান্তর হয়ে আসতেন। অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যক্তিদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো, যাতে মরদেহ উদ্ধার ও শনাক্তকরণ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। কমিশন এখনো প্রায় প্রতিদিনই এই সাইটে নির্যাতনের নতুন তথ্য পাচ্ছে, যা এর ব্যবহারিক পরিসর ও ধারাবাহিকতার ভয়াবহতা তুলে ধরে।

প্রমাণ মুছে ফেলার প্রচেষ্টা

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর, র‌্যাব এই সেলের প্রকৃত রূপ আড়াল করতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। সেলগুলোকে বড় দেখানোর জন্য আধুনিকীকরণ করা হয়, নির্যাতন কক্ষ ভেঙে ফেলা হয়, সিসিটিভি ও নজরদারি যন্ত্র সরিয়ে ফেলা হয়, মেঝের টাইলস তুলে ফরেনসিক চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালানো হয়। এসব ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ ছিল প্রমাণ নষ্টের একটি সুপরিকল্পিত প্যাটার্ন, যাতে দায়মুক্তি নিশ্চিত করা যায়।

বিজ্ঞাপন

জনআস্থার পতন ও রাজনৈতিক নির্যাতনে র‌্যাবের ব্যবহার

র‌্যাবের কর্মকাণ্ডে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি জনআস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। র‌্যাবের রাজনৈতিক দমনপীড়নে ব্যবহৃত হওয়া—বিশেষ করে বিরোধী দল, আন্দোলনকারী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে—একটি অপরাধ দমন বাহিনীকে পরিণত করেছে রাজনৈতিক দমনযন্ত্রে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী, র‌্যাব কর্মকর্তারা জেনেশুনেই নির্যাতন ও হত্যার পথ বেছে নিতেন, কারণ তারা জানতেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা হবে না।

এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ প্রভাব

জনগণের নিরাপত্তাবোধ কমেছে, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীরা অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির সংস্কৃতি আরও দুর্বল হয়েছে।

র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি

সরকার পরিবর্তনের পরও প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‌্যাব এখনো টিকে আছে। তবে এর অতীত অপারেশন ও গভীর অবিশ্বাসের ধারা এখনো গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে বড় বাধা। কমিশনের মতে, অর্থবহ পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হলে র‌্যাব বিলুপ্ত করা আবশ্যক। এটি দায়মুক্তির চক্র ভাঙার, জনআস্থা পুনরুদ্ধারের এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ।

বিজ্ঞাপন

এমইউ/বিএ/জেআইএম

বিজ্ঞাপন