ঝুলতে ঝুলতে গুলি খাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি আমির
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণ আমির হোসেনকে গুলি করে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর মেরাদিয়ার নোয়াপাড়ার বাসিন্দা আমির হোসেন (২০)। ২০২৪ সালের আজকের দিনে (১৯ জুলাই) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের গুলি থেকে প্রাণে বাঁচতে মেরাদিয়ার নির্মাণাধীন একটি ভবনের রড ধরে ঝুলে থাকেন তিনি। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
একে একে পুলিশের ছয়টি গুলি আমির হোসেনের দুই পায়ে বিদ্ধ হয়। তার সেই গুলিবিদ্ধ হওয়ার নির্মম মুহূর্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
নেটিজেনরা ভেবেছিলেন, সেই তরুণ আমির হোসেন বেঁচে নেই। তবে আশার আলো জাগিয়ে আহত হওয়ার সাতদিন পর মোটামুটি শঙ্কামুক্ত হয়েই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন আমির হোসেন।
- আরও পড়ুন
- পুলিশ ৬টা গুলি করে, এরপর ৩ তলায় পড়ে যাই
- কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি, এসআই গ্রেফতার
- জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার-আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি বরাদ্দ
- জুলাই বিপ্লবে আহত ১০০ জন পাচ্ছেন সরকারি চাকরি
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হতে চললো। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি আমির। আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা, আয়-রোজগারে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা আমির হোসেন এখন বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি।

আমিরের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। কয়েক বছর আগে মাকে হারিয়ে তারা তিন ভাই-বোন ঢাকায় মেরাদিয়ার নোয়াপাড়ায় ফুপুর বাসায় চলে আসেন। বাবা বিল্লাল মিয়া গ্রামে অটোরিকশা চালান। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে হোটেলে কাজ করে সংসার চালাতেন আমির হোসেন। ঢাকায় কাজ করতে না পেরে দুই মাস আগে আবার গ্রামে চলে যান তিনি।
এক বছর ধরে কেমন আছেন আমির হোসেন? কতটুকু সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন? সেই বিষয়ে জানতে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হয় আমির হোসেনের কাছে।
- আরও পড়ুন
- জুলাই বিপ্লবে আহত আরও ৬ জন যাচ্ছেন ব্যাংকক
- অভ্যুত্থানে নিহতরা জুলাই শহীদ, আহতরা জুলাই যোদ্ধা
- জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
- আরও ৭৭২ জন ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকার গেজেট প্রকাশ
আমির হোসেন বলেন, ‘একটাই কষ্ট, আগের মতো চলাফেরা করতে পারি না। ভারী কোনো বোঝা বহন করতে পারি না। জীবনে আর ভারী কোনো কাজ করতে পারব না। এখন দোকানদারি করা ছাড়া উপায় নাই।’
‘ওই সময়ের স্মৃতি মনে করে ভয় পাই না তেমন। ভয় দিয়ে জীবন চলে না। কিন্তু মাঝেমধ্যে গুলি খাওয়ার স্মৃতি চোখে ভেসে আসে। আমার কষ্ট এই, আমি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারি না। সামনে কীভাবে চলব জানি না। অনেকে দোকান দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু আমার কাছে সেই পুঁজি নেই।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমির হোসেন বলেন, ‘এক বছর ধরে আমার কোনো খোঁজ নেয়নি কেউ। এক বছর হলো গুলি খেয়েছি, কিন্তু তেমন কোনো সহায়তা পাইনি। এখন পর্যন্ত মাত্র দুই লাখ টাকা পেয়েছি। আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে একটা রিকশা দিয়েছিল, কিন্তু কিছুদিন চালানোর পর পায়ে ব্যথা হয়। ডাক্তার বলেছেন, বেশি রিকশা চালানো যাবে না।’

পায়ের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে আমির হোসেন বলেন, ‘আমার তো পায়ের রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়েছিল। ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতালে অপারেশন হয়েছিল। পায়ের একটা রগ অন্য একটা রগের সঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, পায়ে বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। এখনো ছয়টা গুলির দাগ আছে।’
অভ্যুত্থান হলো, সরকার পরিবর্তন হলো। পুলিশ আপনাকে যে হত্যার চেষ্টা করলো, এই ঘটনার বিচার চান কি না? আমির হোসেন বলেন, ‘যারা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, যারা গুলি করেছিল, তাদের বিচার হোক। আমাকে একদিন হাইকোর্টেও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।’
- আরও পড়ুন
- উন্নত চিকিৎসার জন্য তুরস্কে গেলেন ৭ জুলাই আহত
- জুলাই বিপ্লবে আহত ১৮ ছাত্র-জনতাকে বিজিবির সহায়তা
- আন্দোলনে নিহতরা ‘জুলাই শহীদ’, আহতরা ‘জুলাইযোদ্ধা’র পরিচিতি পাবেন
- জুলাই বিপ্লবে আহত আরও ৭ জনকে পাঠানো হলো ব্যাংককে
বিচার প্রক্রিয়া কতদূর, কোনো মামলা করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে? আমির হোসেন বলেন, ‘কিছু বলার নেই। যারা আমাকে গুলি করেছিল, তাদের মধ্যে মাত্র একজন গ্রেফতার হয়েছে। আরেকজন এখনো পলাতক। অথচ তাদের ছবি, ফুটেজ সবই আছে। তারা তো রামপুরা থানার পুলিশ ছিল। তথ্যও সবার জানা। তাহলে কেন গ্রেফতার করা যায় না, সেটা আমার প্রশ্ন। অনেকে বলেছিল মামলা করতে, কিন্তু মামলা করতে গেলে খরচ, ঝামেলা। আর আমার ওপর যদি উল্টো চাপ সৃষ্টি হয়? এজন্য মামলা করিনি।’
গ্রেফতার হওয়া সেই পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন জানিয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে সুযোগও দেওয়া হয়নি।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন দেখছেন, জানতে চাইলে আমির হোসেন বলেন, ‘ভাবছিলাম জিনিসপত্রের দাম কমবে। কিন্তু আমরা যারা দিন এনে দিন খাই, তাদের কষ্ট আগের মতোই। চালের দাম এখনো বেশি। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল অন্তত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সস্তায় পাব, কিন্তু তা তো হয়নি।’

বর্তমানে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এখন আমি বাবা ও বড় ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। ভারী কাজ করতে পারি না। যদি সবার সহযোগিতা পাই, তাহলে ছোটখাটো একটা দোকান দেওয়ার ইচ্ছা আছে।’
সবশেষ জানতে চাওয়া হয় ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ। উত্তরে আমির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় আর যাব না। যদি গুলি না খেতাম, অক্ষম না হতাম তাহলে ঢাকায়ই কাজ করতাম। সেখানে রিকশা চালিয়ে বা অন্য কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু এখন আর ইচ্ছা হয় না। আমি গ্রামে চলে এসেছি, এখানেই থাকব।’
গত বছরের ১৯ জুলাই আমির হোসেনের সঙ্গে যা ঘটে
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। সেদিন বিকেল ৩টা কিংবা তার একটু বেশি সময়ে বনশ্রীতে থমথমে পরিস্থিতি। হোটেলে কাজ করে বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। বনশ্রী-মেরাদিয়া রাস্তায় দুই পাশে পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে পেয়ে যান তিনি। একপর্যায়ে পাশে থাকা নির্মাণাধীন চারতলা একটি ভবনের ছাদে ওঠেন আমির। তার পিছু পিছু পুলিশও যায়। একপর্যায়ে প্রাণে বাঁচতে রড ধরে ঝুলতে থাকেন তিনি। পুলিশ সদস্যরা তাকে দেখেই গুলি শুরু করেন। আর নিচে লাফ দিতে বলেন।
- আরও পড়ুন
- প্রতারণা করে জুলাই অভ্যুত্থানের সুবিধা নিলে ২ বছরের কারাদণ্ড
- আরও ১২৪২ জন ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকার গেজেট প্রকাশ
- স্কুলে ভর্তিতে ৫% কোটা পাবে অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের সন্তানরা
- জুলাই-আগস্টের আহত যোদ্ধাদের দেওয়া হবে ইউনিক আইডি কার্ড
আমির হোসেন বলেন, ‘আমি নিচে লাফ দেই নাই। এরপরেও পুলিশ গুলি করে। প্রথমে গুলি আমার গায়ে লাগে নাই, পাশ দিয়ে চলে যায়। আমাকে বার বার ভয় দেখাচ্ছিল যাতে আমি লাফ দেই। এরপর আরেকজন পুলিশ তিনতলায় গিয়ে ছয়টা গুলি করে, সেই গুলি আমার দুই পা ও উরুতে লাগে। সবগুলো গুলি এক জায়গা দিয়ে ঢুকে অন্য জায়গা দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর আমি তিনতলায় পড়ে যাই।’

‘আমি তখন পুলিশকে বার বার বলার চেষ্টা করছিলাম, আমি কোনো আন্দোলনের সাথে যুক্ত নই। তারা আমার কথা না শুনে বার বার নিচে লাফ দিতে বলে। কিন্তু নিচে ইট আর রড ছিল। ঝাঁপ দিলে আমি মনে হয় মরে যেতাম। যার কারণে আমি লাফ দেই নাই।’ বলছিলেন আমির হোসেন।
আরএএস/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম