ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

সালাহ উদ্দিন জসিম | প্রকাশিত: ০৮:১৮ এএম, ০২ আগস্ট ২০২৫

ঘড়ির কাঁটার মতো বছর ঘুরে ফের এলো আগস্ট মাস। বছর ঘুরলেও পরিবর্তন হয়নি পরিস্থিতির। এখনো সেই চব্বিশের মতোই উত্তাল পরিস্থিতি। এখনো বয়ে বেড়ানো লাগছে ১৬ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ। এখনো স্লোগান দিতে হচ্ছে, আমার ভাই মরলো কেন, অমুক তমুক জবাব চাই।

চব্বিশের স্বপ্ন নিয়ে এখনো কেউ রাজপথে। আশায় পথ চেয়ে আছে। আবার কেউ হতাশ হয়ে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু শিশু-কিশোর ও তরুণদের কাঁচা হাতে অব্যক্ত কথাগুলো দেওয়ালে রয়ে গেছে। এখনো কথা বলে নীরব দেওয়াল।

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

এক বছর আগে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেমে এসছিল সব স্তরের মানুষ। কচি-কাঁচার মেলার সাথী থেকে বয়োবৃদ্ধ নেমেছিল রাজপথে। শেখ হাসিনার টানা চার মেয়াদের শাসনের অবসান হয়েছে। সেই উত্তাল আন্দোলনে সবার স্বপ্ন ছিল, আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। কেউ বলেছে, কেউ বলেনি। চুপ করেই ফিরেছে। তবে, কচি হাতে কিছু শিক্ষার্থী সারাদেশের দেওয়ালে তাদের প্রত্যাশাগুলো জানিয়ে গেছে। যেগুলো বই আকারে দেশ-বিদেশে প্রচারও করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

বছর ঘুরে প্রশ্ন এসেছে, দেওয়ালের সেই প্রত্যাশাগুলো কি পূরণ হয়েছে? গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রগতি আছে? সবাই বলছে, দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা। তবে লিখতে পারা বা বলতে পারার স্বাধীনতাটুকু পেয়েও অনেকেই তৃপ্ত।

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন দেওয়ালে এখনো শোভা পায় অসাধারণ দেওয়াল লিখন, গ্রাফিতি ও ইসলামিক ক্যালিওগ্রাফি। এর মধ্যে আছে, ‘দেশ সংস্কার চলছে; শিক্ষা, নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইন, একতা, দুর্নীতিমুক্ত’, ‘আমি ৫২-তে জেগেছিলাম ফিরিয়ে এনে ছিলাম ভাষা, ২৪ শে জেগেছি আবারও কবর দিয়েছি কোটা’, ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’, ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’, ‘আমরা সবাই এক, স্বাধীন’, ‘ঘুষ দেব না ঘুষ নেব না, এই হোক আমাদের অঙ্গিকার’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনবো’, ‘হোক লড়াই আরেকবার, ধ্বংস হোক স্বৈরাচার’, ‘আসছে ফাগুন, আমরা হবো দ্বিগুণ’, ‘বিকল্প কে? তুমি আমি আমরা! ৫ আগস্ট নতুন স্বাধীনতা দিবস’, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান’, ‘যদি থাকি একত্র, ন্যায়বিচার সর্বত্র!!’, ‘বুকের মধ্যে তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘আঙ্কেল একটু গেইটটা খুলেন, প্লিজ!’, ‘দুর্নীতি তুমি সরে দাঁড়াও, ন্যায় মাথা তুলবে’, ‘আমরা কয়েকগুণ হয়েছি, স্যার!’, ‘৫২ দেখিনি, ৭১ দেখিনি, ২৪ দেখেছি’, ‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা মিলেছে’, ‘অর্জন তো করেছি, এবার রক্ষার পালা’, ‘দেশটা কারো বাপের না’, ‘আমরা হারবো না’ এবং ‘আমরা নতুন দেশ গড়বো’।

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

গাছের পাতাসহ ছবি এঁকে লিখে দিয়েছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। সঙ্গে পৃথক পৃথক পাতায় লেখা- মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান। দোকানির ছবি এঁকে লিখেছিল, ‘না থাকলে চাঁদাবাজি, দাম কমাতে সবাই রাজি।’

আরও পড়ুন

এই চাঁদাবাজি ও খুনের রাজনীতি এখনো চলমান। অথচ সেই আন্দোলনের এক বছরপূর্তি হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও ছাত্র নেতাদের মধ্যে। তারা বলছেন, ‘দরকার হলে আবার নামবো। আবার লিখবো।’

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে হত্যা করেন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এর প্রতিবাদে এরই মধ্যে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে ছাত্রদলের আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. লিসানুল আলম লিসান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি লেখেন, ‘...বিশেষ করে ৫ আগস্ট পরবর্তীতে, অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম, দেশ নতুন করে বিনির্মাণ হবে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, ৫ আগস্ট পরবর্তীতে দেশটাকে সুন্দরভাবে বিনির্মাণের পরিবর্তে, সবাই যে যার মতো করে নিজের স্বার্থ এবং ভোগের রাজনীতি করে গেছে। এই দায়ে জামায়াত, বিএনপি, এনসিপি সবাই দন্ডিত। সবাই নয়া বন্দোবস্তের কথা বললেও কেউ কথা রাখেনি। জুলাইকে কেউ স্মরণ করেনি। জুলাইকে কেউ মনে রাখেনি। শহীদদের রক্তের সাথে সবাই নির্বিচারে গাদ্দারি করেছে।’

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী অহনা আঞ্জুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জুলাইয়ের কিছু স্মৃতি দেওয়ালে রেখে এসেছি। কিছু নীতি কথা লিখে রেখেছি। এটা তো আর সবাই ধারণ করে না, বা করবেও না। তবে আমরা পরিবর্তন দেখছি। আগের থেকেও এখন ভালো। নীতিকথা যে বলতে পারছি, এটাই তো বেশি। আগে তো বলতেই পারতাম না। এখন প্রত্যাশা হচ্ছে, অভ্যুত্থানে যাদের আমরা নিয়ে এসেছি, সামনে যারা আসবেন- তারা যেন এগুলো দেখে, মানে। তারা যেন মন্দের ভালো না হয়। ভালোর ভালো হয়।’

আরও পড়ুন

‘দরকার হলে আবার লিখব। আবার নামবো রাস্তায়।’ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদ মুস্তাহিদ বলেন, ‘আমাদের আকাঙ্ক্ষা আমরা বলেছি। দেওয়ালে লিখেছি। এরকম বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম। ক্ষমতায় গিয়ে সেটা সবাই ভুলে গেছে।’

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

ফারজানা আক্তার নামের এক তরুণী বলেন, ‘তখন আমিও আন্দোলনে ছিলাম। কিন্তু রাজনীতিতে গিয়ে সবাই আমাদের ভুলে গেলো। ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত সবাই।’

গৃহিণী আফরোজা খানেরও আছে আক্ষেপ। তিনি বলেন, ‘আমরা মায়েরা সবাই আন্দোলনে ছিলাম। মেয়েরাও ছিল। কিছু বলার নাই। আন্দোলন শেষে মেয়েদের আর কেউ মনে রাখে নাই।’

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

ঢাকার রিকশাচালক বরগুনার ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘রিকশাওয়ালারা সবাই আন্দোলনে নামছিল। তাদেরই কেউ এখন আর ট্রাফিক আইন মানতে চায় না। মোটরসাইকেল ওয়ালারা হেলমেট পরে না। ভিআইপি গেলে এখনো রাস্তা বন্ধ কইরা দেয়। পরিবর্তন হইলো কই?’

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছোট ছোট বাচ্চারা কাঁচা হাতে তাদের প্রত্যাশাগুলো দেওয়ালে লিখে দিয়েছে। এগুলো বাস্তবে রূপ নেয়নি। আমি সন্তুষ্ট নই। এত রক্ত দেওয়ার পর ছাত্রদের মধ্যেও ফ্যাসিবাদ জায়গা করে নিলো কি না, তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে গেলো কি না, জানি না। তবে আগে যা ছিল, যেভাবে ছিল, তাই চলছে। প্রত্যাশিত মানের সংস্কার বা পরিবর্তন হয়নি। যেখানে চাঁদা দেওয়া লাগতো, সেটা দিতে হচ্ছে। এখনো বহু জায়গায় ঘুসের লেনদেন রয়ে গেছে। দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ হয়নি।’

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। আন্দোলনে যে স্পিরিট ছিল, সেটা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। যে কোটা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, সেই কোটায় ফিরে আসা বা আবারো কোটা দেওয়া, এটা আমার কাছে মনে হয় জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বা এক ধরনের চালাকি হলো।’

তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে অসংখ্য পক্ষ ছিল, সবাই এক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে আর এক থাকেনি। জনগণ ওই মুহূর্তে নেমে এসেছিল। আবার ঘরে ফিরে গেছে। আন্দোলনে কিছু ছিল জনগণের এজেন্ডা, আর কিছু ছিল সুসংগঠিত পলিটিক্যাল এজেন্ডা। যারা এখনো মাঠে আছে, তারাই তাদের পলিটিক্যাল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।’

দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেওয়ালের সেই কথাগুলো সবাই শুনতে পায় না। কেউ কেউ শুনতে পায়। তবে সংখ্যাটা অল্প। সর্বশেষ চব্বিশের যে আন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান হয়েছে এর চেতনা ছিল- যে অন্যায় হয়েছে, যে দূরত্ব হয়েছে, যে সামাজিক বৈষম্য হয়েছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, রাজনীতির নামে যে হানাহানি হয়েছে, চব্বিশের ৫ আগস্টের পর এগুলো আর থাকবে না। এগুলোই ছিল সবার সম আশা। আমরা প্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। কারণ হলো আন্দোলনের সময় যে সহাবস্থান ছিল, যে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম ছিল, তা রাজনৈতিকভাবে ভাগাভাগি হয়ে গেছে। কোনো আন্দোলন ভাগাভাগি হয়ে গেলে সাধারণ মানুষের আর কোনো স্বার্থ থাকে না। যারা সংখ্যার দিক থেকে, প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে, আধিপত্যের দিক থেকে এগিয়ে থাকে, তাদের ঘরেই যায় সুফল। ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা সাধারণ মানুষকে হতে হয় দিশেহারা।’

এসইউজে/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস

আরও পড়ুন