গুলিতে পা হারিয়েও থেমে যাননি জুলাই যোদ্ধা রাইমুল
জুলাই যোদ্ধা কাজী রাইমুল ইসলাম/জাগো নিউজ
• বুলেট পা কেড়ে নিলেও স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারেনি
• পা হারালেও হারাননি প্রতিবাদের সাহস
• জীবন থামেনি রাইমুলের, পথ বদলেছে
২৪ বছর বয়সী কাজী রাইমুল ইসলাম ছিলেন একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। রাজধানীর জুরাইন এলাকায় থাকতেন। পড়তেন কম্পিউটার সায়েন্সে ডিআইআইটিতে। সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছিল ভবিষ্যৎ। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের এক বিকেল বদলে দেয় তার পুরো জীবন। পুলিশের গুলিতে হারান তার বাম পা।
‘শেখ হাসিনা পালিয়েছে’—এই খবরে রাস্তায় নেমেছিলেন
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল ঢেউ তখন ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর আনাচে-কানাচে। ৫ আগস্ট, রাইমুল বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেন শনির আখড়ার আন্দোলনে। মিছিল যাচ্ছিল কাজলামুখী, দুপুর তখন ২টা। হঠাৎ রটে যায়, ‘শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন’। তখনই যাত্রাবাড়ী থানার উল্টো দিক থেকে পুলিশ গুলি চালায়।
রাইমুল বলেন, ‘আমি একদম থানার সামনে ছিলাম। হঠাৎ দেখি গুলি ছুড়ছে। একটি গুলি এসে সরাসরি লাগে আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে।’
সোহাগ নামে এক ছেলেকে দেখি পুলিশ রাস্তায় ফেলে পায়ে ঠেকিয়ে গুলি করছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেই, এই সরকারের পতন চাই
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আশপাশের একটি বাসার নিচে দুই ঘণ্টা পড়ে থাকেন। বাইরে চলছিল লাগাতার গুলি, কেউ এগিয়ে আসেনি।
হাঁটু ছয়-সাত টুকরো, রাতেই কাটা পড়ে পা
দুই ঘণ্টা পর তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে এক্স-রে করাতে করাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এক্স-রেতে ধরা পড়ে, হাঁটুর হাড় গুঁড়িয়ে গেছে। দ্রুত অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর ধরা পড়ে ভাসকুলার ইনজুরি।
- আরও পড়ুন
- পরিবারের সদস্যদের মতো আহতদের পাশে ছিলেন চিকিৎসকরা
- দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা
- জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১ মামলা, গ্রেফতার মাত্র ৬১
তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। কিন্তু রাত ১০টায় ৮ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। নিচের পায়ের মাংসপেশি মরে গিয়েছিল, আর রাখার উপায় ছিল না।
‘পা কাটা পড়বে শুনে প্রথমে মানতে পারছিলাম না। পরে সহ্য করার মতো অবস্থা ছিল না—রাজি হয়ে যাই,’ বলেন রাইমুল।
তাদের মেসেজ দিলে বলে কাগজ নিয়ে আসতে। আমার মনে হয়েছে, দায়িত্ব তো আমার না, তাদের। অনেকে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পেয়েছে, অনেকে পায়নি
রাত ১টায় নিটোরে হয় চূড়ান্ত অস্ত্রোপচার। সেন্স ফেরে পরদিন দুপুর ১২টায়। এরপর কয়েক দফা ইনজেকশন দেওয়া হয়, মোট পাঁচটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। শেষ অপারেশন হয় ১২ সেপ্টেম্বর।
ব্র্যাক দিলো কৃত্রিম পা, ফিরলেন স্বপ্নে
নভেম্বরে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর ব্র্যাক তাকে কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেয়। বর্তমানে তিনি নিজে হাঁটতে পারেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারেন—তবে দৌড়ানো সম্ভব নয়। তবু হাল ছাড়েননি। এখন একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে ইন্টার্ন করছেন। বলেন, ‘সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন এখনো ধরে রেখেছি।’

আন্দোলনের পেছনের গল্প
সরকারি চাকরি বা কোটার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না রাইমুলের। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা ও ১৭ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুর পর প্রতিবাদে নামেন। ফেসবুকে পোস্ট দেন, আন্দোলনে যোগ দেন।
একটি ঘটনা এখনো তাড়া করে ফেরে তাকে— ‘সোহাগ নামে এক ছেলেকে দেখি পুলিশ রাস্তায় ফেলে পায়ে ঠেকিয়ে গুলি করছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেই, এই সরকারের পতন চাই।’
তার ভাষায়, ‘সরকার পতনের পর যদি অর্থনীতি ধসে পড়ে—এমন ভয় ছিল। আলহামদুলিল্লাহ, তা হয়নি। আর শেখ হাসিনা বেটার ছিল না—এটা এখন পরিষ্কার।’
সহযোগিতার তালিকায় নেই জুলাই ফাউন্ডেশন
হাসপাতালে অবস্থানকালীন বিভিন্ন সংগঠন সহযোগিতা করেছে তাকে। তবে জুলাই ফাউন্ডেশন প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাইমুল। ‘তাদের মেসেজ দিলে বলে কাগজ নিয়ে আসতে। আমার মনে হয়েছে, দায়িত্ব তো আমার না, তাদের। অনেকে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পেয়েছে, অনেকে পায়নি।’
সরকারি সহায়তা হিসেবে এক লাখ টাকা পেয়েছেন ডিসি অফিস থেকে। বাকি দুই লাখ পরের বাজেটে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। জুলাই মাস থেকে মাসিক ভাতা চালুর প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন তিনি।
‘তরুণদেরই রাজনীতিতে নেতৃত্ব নিতে হবে’
রাইমুল মনে করেন, তরুণদের রাজনীতিতে আসার সময় এসেছে। ‘তরুণদের নিয়ে আলাদা রাজনৈতিক দল হওয়া উচিত। যারা যুদ্ধ করে এসেছে, তারাই নেতৃত্ব দিক।’
রাইমুলের মতো আহত তরুণরা হারিয়েছেন অনেক কিছু। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা এখনো স্পষ্ট—এই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি যেন তরুণদের হাতেই গড়ে ওঠে, যাতে আর কাউকে নিজের দেশের পুলিশের গুলিতে পা হারাতে না হয়।
এসইউজে/এএসএ/জিকেএস