পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
অমীমাংসিত বিষয় সমাধানে বাংলাদেশ-পাকিস্তান একমত
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন
একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিনটি বিষয়ে এরই মধ্যে দু’বার সমাধান হয়েছে- পাকিস্তানের এমন দাবির সঙ্গে বাংলাদেশ একমত নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটা ওদের মতো করেই মিটে যেতো।’
তবে অমীমাংসিত এসব বিষয়ে সমাধানের প্রয়োজন রয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একমত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রোববার (২৪ আগস্ট) রাজধানীতে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি এসব তথ্য জানান।
এর আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, ‘১৯৭৪ সালে প্রথম এবং পরে ২০০০ সালের শুরুর দিকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময়ে এসব বিষয় সমাধান হয়েছে।’
ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে ইসহাক দার বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সেই বার্তা দিয়েছিলেন। ধর্ম, কোরআন এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নাহ আমাদের শিখিয়েছে মানবিকতার সঙ্গে, হৃদয় খোলা রেখে পথ চলা উচিত। আমরা একটি পরিবার, আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।’
কয়েক মিনিটের জন্য সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, পরিবারে বা ভাইদের মধ্যে কোনো বিষয় একবার মীমাংসা হয়ে গেলে সেটিকে অতীতে রেখেই সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। ইসলামও আমাদের হৃদয় পরিশুদ্ধ করে একসঙ্গে চলতে শিক্ষা দেয়। তাই চলুন, আমরা অতীত পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাই, একসঙ্গে কাজ করি। আমাদের দুই দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’
‘আমার ভাই তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আমরা একমত হয়েছি যে, দুই দেশের জনগণের কল্যাণে যা কিছু সম্ভব, আমরা তা করবো।’ যোগ করেন ইসহাক দার।
তবে বাংলাদেশর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট। আমাদের চাওয়া, পাকিস্তানের কাছে আমাদের যেসব বকেয়া অর্থ রয়েছে, সেসবের হিসাব-নিকাশ ও নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তার জন্য পাকিস্তানকে দুঃখ প্রকাশ ও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। এবং বাংলাদেশের মাটিতে আজও যেসব পাকিস্তানি নাগরিক আটকে আছেন, তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
এ সময় এক সাংবাদিক জানতে চান- বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষ থেকে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কি না।
উত্তরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এই ধরনের স্পেসিফিক বিষয়ে যাওয়া উচিত নয়। এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি- বাংলাদেশের অবস্থান আমি খুবই স্পষ্ট ও শক্তভাবে উপস্থাপন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই আশা করেন না যে ৫৪ বছরের সমস্যা একদিনে মিটে যাবে। এটি ছিল গত ১২-১৩ বছর পর অনুষ্ঠিত প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, তাও আবার হিনা রব্বানী খার আমন্ত্রণে। এটি পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় সফরও ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে বসে আমরা এক ঘণ্টায় সমাধান করে ফেলতে পারবো- এটা নিশ্চয়ই কেউ আশা করবেন না। তবে বৈঠকে আমরা পরস্পরের অবস্থান তুলে ধরেছি।’
আরও পড়ুন
- একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যুর দুইবার সমাধান হয়েছে
- বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে যেসব চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হলো
- বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী পাকিস্তান
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেছি। দুই দেশের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত ঐতিহাসিক ইস্যু রয়েছে, সেগুলো নিয়েও কথা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বৈঠকে উভয়পক্ষ বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। বর্তমানে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারেরও কম, যেটি বাড়ানোর বিশাল সম্ভাবনা আছে। আমরা চাই, পাকিস্তানের বাজারে বিশেষ করে সাফটার অধীনে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার আরও সহজ হোক, বিশেষত টেক্সটাইল, জ্বালানি, ওষুধ, কৃষিপণ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। জ্বালানি খাতে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দরের মধ্যে জাহাজ চলাচল শুরু হলেও তা এখনো নিয়মিত নয়। আমরা চাই, এটি নিয়মিত হোক। পাশাপাশি ঢাকা-ইসলামাবাদ সরাসরি ফ্লাইট চালুর জন্য দুটি এয়ারলাইন্সকে প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটা হলে ব্যবসা, পর্যটন এবং অন্যান্য খাতে সুবিধা হবে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তি বিনিময়ের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তান আরও বৃত্তি দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে, যা শিক্ষামন্ত্রণালয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন হবে। সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রেও সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে।’
স্বাস্থ্যখাত প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষাসহ ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বাড়ানোর বিষয়ে উভয় দেশ একমত হয়েছে। কৃষি, সেচ, প্রকৌশল এবং বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করতে চায় বাংলাদেশ।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়াও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছি। সার্ক এখন কার্যত অচল, তবে অন্য প্ল্যাটফর্মেও আমরা একযোগে কাজ করছি।’
গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘উভয় দেশই মনে করে সেখানে গণহত্যা চলছে এবং ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আমরা তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছি।’
রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তারা নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠাতে চায়, আমরাও চাই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে আমরা পাকিস্তানের সহযোগিতা চেয়েছি।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘পাকিস্তান জানিয়েছে, তারা এখন সহজভাবে ও দ্রুত ভিসা দিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই একদিনে বা অন-অ্যারাইভাল ভিত্তিতে। আমরাও ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছি। দুপক্ষই মানুষের চলাচল সহজ করতে আগ্রহী।’
বাণিজ্যখাতে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সমঝোতা হয়েছে বলেও তিনি জানান। এছাড়া, পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী এখনো ঢাকায় অবস্থান করছেন এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বিস্তারিত বৈঠক হয়েছে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা চাই, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ইস্যুতে আমরা যেন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারি। পারস্পরিক সম্পূরকতা কাজে লাগিয়ে দুই দেশের জনগণের কল্যাণে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে চাই।’
তিনদিনের সফরে গতকাল শনিবার ঢাকায় পৌঁছান পাকিস্তানের উপ- প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। দুপুর ২টার দিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম।
সফরের প্রথমদিনে ইসহাক দার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেন এবং পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য পাকিস্তানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
রোববার সকালে তিনি বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠক করেন। এরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক শেষে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ইসহাক দার।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ইসহাক দারের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি, চারটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং একটি কর্মসূচি (প্রোগ্রাম) সই হয়।
জেপিআই/ইএ/জিকেএস