ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

শিকল-হাতকড়ায় ৬০ ঘণ্টা

কেউ স্বেচ্ছায় না ফিরলে বাধ্যতামূলকভাবে ফেরত, কঠোর যুক্তরাষ্ট্র

জেসমিন পাপড়ি | প্রকাশিত: ১০:৫৬ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দুই পায়ে লোহার বেড়ি। কোমরে মোটা শিকল বাঁধা। দুই হাতের হাতকড়া সেই শিকলের সঙ্গেই আটকানো— এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়োজাহাজে তোলা হয় ৩০ জন বাংলাদেশিকে।

এ অবস্থায় টানা ৬০ ঘণ্টা কাটানোর পর উড়োজাহাজটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উড়োজাহাজ থেকে নামার কয়েক মিনিট আগে তাদের হাতকড়া ও শিকল খোলা হয়।

জাগো নিউজকে নির্মম এ অভিজ্ঞতার কথা জানান যুক্তরাষ্ট্র থেকে জোরপূর্বক দেশে ফেরা বাংলাদেশি হাসান তানজিল। গত ৫ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরা ৩০ বাংলাদেশির একজন তিনি। সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাদের বহনকারী বিশেষ ভাড়া করা উড়োজাহাজটি ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়।

নথি ঠিক না থাকলে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে।- ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান

দেশে ফেরার বর্ণনা দিয়ে তানজিল বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে আমাদের হাতকড়া-বেড়ি-শিকল পরানো হয়। সারাদিন ওই অবস্থায় রাখার পরে রাত ৯টার দিকে আমাদের উড়োজাহাজে তোলে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা ঢাকায় পৌঁছাই। এই পুরোটা সময় তো একই অবস্থায় ছিলাম।’

‘তবে এর আগের দিন সোমবার সকালেও আমাদের বেড়ি-শিকল-হাতকড়া পরানো হয়। সারাদিন সেভাবে রাখা হয় উড়োজাহাজে তোলার অপেক্ষায়। তবে ফ্লাইটটি মিস হয়। বিমানবন্দরে অপেক্ষারত অবস্থায় খোলা জায়গায় গোসল ছাড়া দিন কাটাতে হয়।’ জানান তিনি।

তবে খাবারের ব্যবস্থা ছিল জানিয়ে তানজিল বলেন, ‘তিন বেলা শুকনো খাবার দিতো। হাতে হাতকড়া অবস্থায় খেতে হয়েছে। দীর্ঘসময় হাতকড়া পরে থাকায় হাতে ঘা হয়ে গেছে।’

কেউ স্বেচ্ছায় না ফিরলে বাধ্যতামূলকভাবে ফেরত, কঠোর যুক্তরাষ্ট্র

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করা বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট ভাড়া নিয়ে তা বিশেষ ফ্লাইটে রূপান্তর করা হয়। এ ফ্লাইটে ৩০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও চিকিৎসকসহ মোট ৫০ জন ছিলেন।

এর আগে গত ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উড়োজাহাজে ৩৯ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়।

যদি কেউ স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি না হন, তাহলে অভিবাসন আইন অনুযায়ী তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ফেরত পাঠানো হয়। জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনের সময় যাত্রী, বিমানের ক্রু এবং ফ্লাইট কোম্পানির কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।–ঢাকার মার্কিন দূতাবাস

তানজিল অবশ্য মেক্সিকো বর্ডার ক্রস করে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পথেই আটক হয়ে জেলে যান। কয়েক মাস জেল খেটে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

তার সঙ্গে ফেরা অন্তত ১২ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তাদের বেশিরভাগই এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগীদের একজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ফেরার আগে এবং ডিপোর্টেশনের সময় তাদের অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হাতকড়া, পায়ে বেড়ি, কোমরে শিকল এমনভাবে বাধা ছিল, যার জন্য খাবারও ঠিকমতো খাওয়া যাচ্ছিল না। টয়লেটে যাওয়ার সময় তারা (পুলিশ) জিজ্ঞাসা করছিল ১ নম্বর (প্রস্রাব) নাকি ২ নম্বর (পায়খানা)। দুই নম্বর হলে এক হাত খুলে দিয়েছিল। না হলে ওই অবস্থায় টয়লেটে যেতে হয়।’

ফেরত পাঠানো ৩০ বাংলাদেশির আরও একজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কত অমানবিকভাবে আমাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে সে কথা এখন জিজ্ঞাস করে কী করবেন? কারও ক্ষমতা নেই আমেরিকার এই মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার।’

পাচারের শিকার
জানা যায়, যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে এদের বেশিরভাগই অবৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশ করেছিলেন।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত তানজিল জানান, তার স্বপ্ন ছিল একটি উন্নত জীবনের সন্ধানে কানাডায় যাওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ছাড়েন। একটি এজেন্সির মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকার চুক্তি হয়, তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, বৈধ ভিসায় তিনি কানাডা পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর পর থেকেই বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।

প্রথমে তাকে নেওয়া হয় ইথিওপিয়ায়। সেখান থেকেই শুরু হয় প্রতারণা। ইথিওপিয়ার ভেতরেই তার পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয় এবং দেওয়া হয় ভুয়া কানাডার ভিসা। তারপর একের পর এক মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে তাকে কানাডা পৌঁছে দেওয়ার নাটক চালানো হয়। কিছুদিন পর তাকে পাঠানো হয় ব্রাজিলে। ব্রাজিলে পৌঁছানোর পর ১৭ দিন ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় মানবপাচারকারীরা। বাধ্য হয়ে আরও টাকা পাঠায় তার পরিবার।

ব্রাজিল থেকে তানজিলকে মাফিয়াদের সহায়তায় পাঠানো হয় কলম্বিয়া, পেরু এবং তারপর পানামার গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার পর্যন্ত। এই যাত্রাপথ ছিল বিপদসংকুল ও মানবেতর। পাহাড়ে পড়ে গিয়ে ভিনদেশি এক মা-মেয়ে মারা যান তার চোখের সামনে। বন্দুকধারী পাচারকারীরা তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। শেষমেশ এক রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে তানজিলসহ আরও ১০-১১ জন বাংলাদেশিকে মেক্সিকো সীমান্ত পার করিয়ে আমেরিকার সীমান্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

তানজিল জানান, ২০২৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি আমেরিকার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এরপর তাকে কারাগারে নিয়ে ১২ দিন আটক রাখা হয়। এরপর শুরু হয় আরও দীর্ঘ ডিটেনশনের সময়। তাকে পাঠানো হয় আমেরিকার একটি আইস ডিটেনশন সেন্টারে, যেখানে ছয় মাস পর্যন্ত আটকে রাখা হয়।

হাসান তানজিল বলেন, ‘কানাডা যাওয়ার আশায় তিনি জমি থেকে শুরু করে স্ত্রী ও বোনদের গহনা বিক্রি করেন, সুদে ধার নিয়েছেন, সবমিলিয়ে ৫২ লাখ টাকা খুইয়েছেন। অথচ তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে প্রতারক চক্রের কারণে।’

অপর এক বাংলাদেশি জানান, তিনি ১৩ বছর ধরে ব্রাজিলে বসবাস করছিলেন এবং ব্রাজিলের নাগরিকত্বও পেয়েছিলেন। তার পরিবারও সেখানে ছিল। ২০২৪ সালের শেষ দিকে তিনি ও তার স্ত্রী একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করা এবং পরিবারসহ সেখানেই স্থায়ী হওয়া।

দালালের মাধ্যমে তারা মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করেন। তবে সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পরপরই তারাও বর্ডার পেট্রোল বাহিনীর হাতে আটক হন।

আটকের সময় তার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট (গর্ভবতী) ছিলেন, যার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মানবিক বিবেচনায় তার স্ত্রীকে সেখানে তার স্বজনদের জিম্মায় মুক্তি দেয়। তার স্ত্রী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন এবং সেখানে একটি শিশুসন্তানের জন্ম দিয়েছেন।

অন্যদিকে, ভুক্তভোগী নিজে কয়েক মাস আটক থাকেন এবং পরবর্তীসময়ে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় তিন মাস পর তাকে ডিপোর্ট করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

এছাড়া তিনি আগেই উল্লেখ করেন, ব্রাজিল থেকে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি বড় মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যেখানে তিনিসহ অনেক বাংলাদেশিকে মারধর করে, ভয় দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়।

বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তিনি চান, তার অভিজ্ঞতা যেন আর কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ভাগ্যে না ঘটে। এজন্য তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়া ও সরকারের সহায়তা কামনা করছেন যেন আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী এ চক্রটি চিহ্নিত ও বিচারের আওতায় আনা যায়।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রত্যাবাসনের সময় হাতকড়া ও শিকল পরানো উচিত নয়। সাধারণ অভিবাসীদের হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি।

অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় পাচারের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা বা মেক্সিকো হয়ে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে লোকজনকে অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।’

‘নথি ঠিক না থাকলে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে,’ বলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র কী বলছে
শিকল-বেড়ি পয়ে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জাগো নিউজকে জানায়, ‘যদি কেউ স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি না হন, তাহলে অভিবাসন আইন অনুযায়ী তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ফেরত পাঠানো হয়।’

যদিও তারা নিশ্চিত করেছে, জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনের সময় যাত্রী, বিমানের ক্রু এবং ফ্লাইট কোম্পানির কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক নিয়ম ও বিমা সংক্রান্ত নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নেওয়া হয়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অবৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসীদের জন্য নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার একটি সুযোগ দেয় বলেও জানায় মার্কিন দূতাবাস।

এর অংশ হিসেবে ‘অপারেশন হোমকামিং’র মতো কর্মসূচি চালু আছে, যা ফেরার প্রক্রিয়া সহজ করে তোলে। কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়, যাতে তারা ইচ্ছা করলে সম্মানের সঙ্গে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারেন,’ জাগো নিউজকে জানায় মার্কিন দূতাবাস।

‘সরকার সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে, যেন প্রত্যাবাসনের পুরো প্রক্রিয়া হয় নিরাপদ, মানবিক ও সম্মানজনক।’

যারা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করছেন তাদের স্বেচ্ছায় ফিরে আসার সুযোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। এতে শুধু তাদের অভিবাসন সমস্যা মিটবে না, বরং তারা সম্মানের সঙ্গে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারবেন।

জেপিআই/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম