সত্য কথাটাও আ’লীগ ঠিকমতো বলতে পারে না: ডিএমপি কমিশনার
মুজিববর্ষ স্মারকগ্রন্থ ‘অনশ্বর পিতা’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ যেভাবে বলেছেন, এরপরে আর স্বাধীনতার ঘোষণার তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তিনি বলেন, একটি দলের নেতারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ নাকি দিগভ্রান্ত হয়েছিল। মানুষ বুঝতে পারছিল না, কী করবে। তাহলে রাজারবাগের পুলিশ কীভাবে বুঝেছিল, সারাদেশের পুলিশ কীভাবে বুঝেছিল কী করতে হবে। আওয়ামী লীগের দোষ হলো, সত্য কথাটাও ঠিকমতো বলতে পারে না। একটি দল (বিএনপিকে ইঙ্গিত করে) মিথ্যা বলতে বলতে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যায়, যেন মনে হয় এটাই সত্য।
শনিবার (২৬ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে মুজিববর্ষ স্মারকগ্রন্থ ‘অনশ্বর পিতা’র মোড়ক উন্মোচন ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ রাজারবাগের পুলিশকে উজ্জীবিত করেছিল। একটি দলের সিনিয়র নেতারা বলা শুরু করেছেন, তাদের নেত্রী নাকি এক নম্বর মুক্তিযোদ্ধা। এটা হাস্যকর...।
তিনি বলেন, কিন্তু সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রমাণ করেছে আমরা ৭ মার্চের ভাষণের পর শপথ নিয়েছিলাম দেশমাতৃকার জন্য প্রয়োজনে রক্ত দেবো, জীবন দেবো। সেই সত্যের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু সারা বাংলাদেশেই ঘটেছিল। শুধু রাজারবাগ পুলিশ লাইন নয়।
মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল। অন্যকেউ হলে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণার দাবিদার তারাই করতো। কিন্তু আমরা পুলিশ, আমরা এই দাবিটি সাহস করে করতে পারিনি। আমার রাইফেলের গুলি যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের দিকে নিক্ষিপ্ত হয় তখনই যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি। তখন তো আর কারো ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করিনি।
তিনি বলেন, জাতির পিতা ৭ মার্চ যেভাবে বলেছেন, এরপরে আনুষ্ঠানিকভাবে আর স্বাধীনতার ঘোষণার তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না। হয়তো আন্তর্জাতিক কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে জাতির পিতা এটি ঘোষণা করেছেন। রাজারবাগে যে পুলিশ কনস্টেবলরা গুলি করেছিলেন, কোন ঘোষণা তাদেরকে উজ্জীবিত করেছিল?
ডিএমপি কমিশনার বলেন, যুদ্ধ তখনও শুরু হবে হবে এরকম সময়ে চুয়াডাঙ্গায় ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চে আমাদের এলাকার যতো পুলিশ ছিল, আনসার বাহিনীর যতো সদস্য ছিল সবাই যার যার মতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কুষ্টিয়া গেলেন। মানুষের প্রশ্ন কী ব্যাপার কুষ্টিয়া কেন? তখন তারা বলেছেন, কুষ্টিয়ায় খান সেনারা এসেছে। তাদের মারতে যাবো। আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য কোনো সেক্টরে যুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি।
তিনি বলেন, কিন্তু এরকম একটি জনরোষের সৃষ্টি হলো। পাকিস্তানি সেনাদের কেউ কেউ আলমডাঙ্গার রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে যশোরে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। গ্রামের মানুষেরা হাসুয়া নিয়ে ধাওয়া করে ৫ পাকিস্তানি সেনাকে কুপিয়ে মারে। গ্রামের সাধারণ মানুষদের বলে দিতে হয়নি যুদ্ধ শুরু করো। তাদের ঘোষণা লাগেনি। তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ঠিকমতো পেয়ে গিয়েছিলেন।
মোহা. শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, রাজারবাগ থেকে ওয়ারলেসে সারাদেশে ঘোষণা হয়েছিল রাজারবাগে আক্রমণ হয়েছে। রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ইপিআর সব জায়গায় যখন আক্রমণ হলো। এ বিষয়টি জানিয়ে যুদ্ধের জন্য একেবারে প্রস্তুতির চূড়ান্ত যে কাজটি পুলিশের পক্ষ থেকে তা শুরু হয়েছে।
‘প্রায় প্রতিটি জেলায় পুলিশ লাইন্সে যতো অস্ত্র ছিল সব অস্ত্র-গুলি সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন, মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইন্স থেকে অস্ত্র পেয়েছেন এবং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।’
তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যতো পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশের আর কোনো বাহিনীর এতো সংখ্যক প্রাণহানি হয়নি। এটার দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, আমাদের যে সদস্যরা ছিলেন তাদের প্রশিক্ষণটা মূলত পুলিশ হিসেবে। যুদ্ধের উপযোগী হিসেবে পুলিশের প্রশিক্ষণ ছিল না। আমাদের কাছে ওরকম ভারী অস্ত্রের অভাব ছিল। ফলে আমরা যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক জায়গায় আবেগের বশবর্তী হয়ে আগ বাড়িয়ে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছি। এছাড়াও আমাদের ১৪ হাজার সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
অত্যন্ত ছোট একটি বাহিনী ছিল আমাদের, ৩৩ থেকে ৩৪ হাজারের মতো। তার মধ্যে ১৪ হাজার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধে ডিআইজি থেকে শুরু করে পুলিশ সুপাররা যোগ দেন। আমরা জানি চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার, কুমিল্লার পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে একজন ডিসট্রিক্ট অ্যান্টি করাপশন অফিসার ছিলেন সেখানে শহীদ হয়েছিলেন, যোগ করেন ডিএমপি কমিশনার।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের কনস্টেবল ও এসআইদের অবদান সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে ডিএমপি কমিশনার বলেন, রাজশাহীতে ডিআইজি থেকে শুরু করে পুলিশের সিনিয়র সহকর্মী যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। কিন্তু জুনিয়র সদস্য যারা বিশেষ করে কনস্টেবল, এসআই তাদের আত্মত্যাগের বিষয় আসলে আমাদের জানাশোনা খুবই কম ছিল।
হলি আর্টিজান হামলার ঘটনা স্বরণ করে পুলিশের এ ঊধ্র্বতন কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন দেশ স্বাধীন করেছি, একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করেন যদি হলি আর্টিজানের মতো এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কোথায় থাকতো। বাংলাদেশের সব মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে পারতাম না। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এদেশে কাজ করতেন না।
ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, আমাদের অনেক সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশকে জঙ্গি-সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করেছেন। আগুন সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করেছেন। আমরা তাদের বীরত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাদের দেখানো পথে যেন চলতে পারি এবং বুকে সাহস নিয়ে সামনের দিকে যে পরিস্থিতি আসুক না কেন আমরা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব সেই প্রত্যাশা করি।
টিটি/কেএসআর/জেআইএম