ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ফারদিন স্থান পরিবর্তন করেন বারবার, যা দেখা গেছে সিসিটিভি ফুটেজে

তৌহিদুজ্জামান তন্ময় | প্রকাশিত: ০৯:৩৭ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০২২

ফারদিন হত্যার ঘটনা প্রতিদিন বাঁক নিচ্ছে। একেক দিন উঠে আসছে একেক প্রশ্ন। তার সবশেষ অবস্থান, হত্যার স্থান নিয়েও নির্দিষ্ট গতিপথে থাকছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন ঘটনার দিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিট থেকে রাত ২টা পর্যন্ত প্রায় সাত থেকে আটটি জায়গায় যান। তিনি মুহূর্তে মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করছিলেন। কিন্তু তিনি এভাবে কেন স্থান পরিবর্তন করছিলেন তার সঠিক কোনো ক্লু পাচ্ছেন না তদন্তকারীরা। সবশেষ পাওয়া একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, রাত সোয়া ২টার দিকে সাদা গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে তিনি লেগুনায় ওঠেন।

এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্তের পর হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য বের হবে বলে জানিয়েছে ডিএমপির ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। রামপুরার পর ফারদিন কেন একাধিক স্থান ঘুরে যাত্রাবাড়ী গেলেন এবং সেখান থেকে কেন তারাবোর লেগুনায় উঠলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো জানতে পারেনি ডিবি।

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন নূর পরশ (২৪) থাকতেন পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়ায়। তিন ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। গত ৪ নভেম্বর দুপুরে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বুশরার সঙ্গেই ছিলেন ফারদিন, রাতে এক রিকশায় তারা রওনা হয়েছিলেন বনশ্রীতে বুশরার মেসের পথে। রামপুরায় রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পর পরিচিত আর কেউ ফারদিনকে দেখেনি। তার বুয়েটের হলে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে ফেরেননি, পরদিন পরীক্ষায় অনুপস্থিত দেখে সহপাঠীরা তার বাসায় খবর দেয়।

jagonews24

পরিবার জিডি করার পর রামপুরা থানা পুলিশ ফারদিনের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে তার সদরঘাটের দিকে যাওয়ার তথ্যটি পায়। জানা যায়, রাতে ফারদিনের মোবাইলের অবস্থান ছিল কেরানীগঞ্জে। এরপর তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়, যা পরে তার মরদেহের সঙ্গে উদ্ধার হয়।

জাগো নিউজের কাছে ফারদিনের ঘোরাফেরার কিছু সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে। সেসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে বুশরাকে রামপুরায় নামিয়ে দেন ফারদিন। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে বংশাল। এরপর গুলিস্তান স্টেডিয়াম থেকে যাত্রাবাড়ী লেগুনাস্ট্যান্ড। সবশেষ রাত সোয়া ২টার কাছাকাছি সময় ফারদিনকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়।

ফারদিন নিখোঁজের ১৩ দিন পার হলেও হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। সম্প্রতি র‍্যাব বলছে, ফারদিনকে চনপাড়ার শীর্ষ মাদক কারবারি রায়হান ওরফে হিরো রায়হান গ্যাং জড়িত থাকতে পারে এবং রায়হানের গ্যাং চনপাড়ার আশপাশে ফারদিনকে হত্যা করে।

তবে বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগ ফারদিনের সবশেষ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হত্যাকাণ্ডের জট খুলতে পারে বলে ধারণা করছে।

এদিন দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাত-দিন ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে। আসলে কী কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। হত্যার সঠিক কারণ জানা না গেলেও খুলতে শুরু করেছে জট।

jagonews24

ডিবি প্রধান বলেন, ফারদিনকে সবশেষ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে তারাবোর দিকে যেতে দেখা গেছে। সাদা গেঞ্জি পরা একজনের সঙ্গে কথা বলে ফারদিন লেগুনায় ওঠেন। লেগুনায় চার-পাঁচজন লোক ছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি লেগুনাটি সোজা সুলতানা কামাল সেতু পার হয়ে বিশ্বরোডের দিকে গেছে। লেগুনার চালক ও সহকারীকে খোঁজা হচ্ছে।

‘লেগুনার ক্লু ছাড়াও ফারদিনের মোবাইল ফোন, বুশরাকে জিজ্ঞাসাবাদ, সে সময় বুশরা ঢাকার শহরে কোথায় ছিলেন, কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন সব বিষয় তদন্তে আনা হচ্ছে।’ যোগ করেন হারুন অর রশীদ।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেখলাম ফারদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে রামপুরায় বুশরাকে নামিয়ে দিলেন। এরপর রাত ১১টার কাছাকাছি কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় গেলেন। গুলিস্তানে পৌঁছালেন রাত ১টার কাছাকাছি সময়ে। ফারদিন মুহূর্তে মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করছিলেন, তিনি কেন সেসব জায়গায় যাচ্ছিলেন, তার মন মানসিকতা খারাপ ছিল কি না, স্পেনে যাওয়ার টাকা-পয়সা সংগ্রহ হয়েছিল কি না, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন কি না, সোয়া ২টার দিকে সাদা গেঞ্জি পরিহিত লোকের সঙ্গে কী কথা বলে তিনি লেগুনায় উঠলেন- এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্তের পর মূল রহস্য বের হবে। রাত-দিন ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে।

ফারদিন কোথায় মারা গেছেন? চনপাড়ায় রায়হান গ্যাং নামে একটি গ্যাংয়ের কথা শোনা যাচ্ছে-- এমন এক প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা প্রধান বলেন, রাত সোয়া ২টার কাছাকাছি সময় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা দেখলাম ফারদিন লেগুনায় উঠছেন। তাহলে আড়াইটায় চনপাড়ায় যাওয়ার কথা না। কারণ তারাবো থেকে চনপাড়ার দূরত্ব অনেক বেশি।

ফারদিনকে জোর করে লেগুনায় তোলা হয়েছিল কি- জানতে চাইলে হারুন বলেন, আমাদের কাছে দেখে মনে হয়েছে স্বাভাবিক কথাবার্তা বা তাকে কোনোভাবে প্ররোচিত দিয়েছে। আর সে একাই ছিল।

মাদক বিক্রেতাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন- এমন তথ্য আসার বিষয়টি তুলে ধরা হলে হারুন বলেন, আমি আমারটাই বলছি। অন্যরা কে কী বললো, তা জানি না।

হত্যার ঘটনা কি চনপাড়াতেই ঘটেছিল- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এখনো এমন মনে হচ্ছে না। আমরা আমাদের তদন্তটা করছি।

বুশরাকে এরই মধ্যে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। কিন্তু তাকে জিজ্ঞাসাবাদে খুনের বিষয়ে কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানান ডিবি প্রধান।

তিনি বলেন, বুশরার বক্তব্য হচ্ছে, তারা যতক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন, ততক্ষণ ফারদিন স্বাভাবিকই ছিলেন। তারা রেস্টুরেন্টে খেয়ে যার যার বিল সেই সেই দিয়েছেন। বুশরাকে রামপুরা নামিয়ে দিয়ে ফারদিন চলে যান।

jagonews24

ফারদিন নূর পরশ হত্যার ঘটনায় সন্দেহের তালিকা থেকে বুশরাকে বাদ দিতে চাচ্ছেন না ফারদিনের বাবা। তিনি বলছেন, যত কিছুই বলা হোক- সন্দেহের তালিকা থেকে বুশরাকে বাদ দেওয়া যায় না।

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ গত ৫ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ওইদিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। নিখোঁজের দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।

এরপরই তার দুই বন্ধু বুশরা ও শীর্ষ সংশপ্তককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর গত বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) রামপুরার বাসা থেকে বুশরাকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিনই ফারদিন হত্যা মামলায় তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। বুশরা রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বুধবার (৯ নভেম্বর) দিনগত রাতে ফারদিনের বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে ‘হত্যা করে লাশ গুম’ করার অভিযোগে রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা সাংবাদিক নূর উদ্দিন রানা।

ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের পরদিন গত ৮ নভেম্বর ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ বলেছিলেন, ময়নাতদন্তে আমরা দেখতে পেয়েছি, ফারদিনের মাথায় এবং বুকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে সেই আঘাত কোনো ধারালো অস্ত্রের নয়। আঘাতের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি হত্যাকাণ্ড। পুলিশের চাহিদা ও অধিকতর তথ্যের জন্য তথ্য-উপাত্ত ও আলামত মহাখালী ভিসিআরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পেলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে ফারদিনকে কীভাবে খুন করা হয়েছে।

ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার নয়ামাটিতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফারদিন ছিলেন সবার বড়। তার মেজ ভাই আবদুল্লাহ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।

টিটি/এএসএ/এমএস