‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুখ চেনা কবির কবিতা ছাপা হয়’
দেখতে দেখতে শেষ সপ্তাহে পা রেখেছে বইমেলা। এবার নতুন কোনো বই নেই কবি জাহানারা পারভীনের। আগের ছয়টি বই মেলায় পাওয়া যাচ্ছে। উপমহাদেশে বাংলা ভাষার অন্যতম এই কবির অভিযোগ গণমাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল কবিতার বদলে মুখ চেনা কবির কবিতা ছাপা হয়। কবিতার চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কই বা পরিচিতিই লেখা ছাপানোর প্রধান মাপকাঠি।
জীবনান্দ দাশে প্রভাবিত এই কবির সঙ্গে আলাপনের বিস্তারিত জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
বইমেলায় আপনার নতুন কোনো বই আসছে?
জাহানারা পারভীন : দুবছর ধরে কাজ করছি আমেরিকান কবি টি এস এলিয়টকে নিয়ে। তাকে নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছি। প্রুফ্রক, ওয়েস্টল্যান্ড, এজরা পাউন্ডের সাথে তার সম্পর্ক, কবি হিসেবে গড়ে ওঠার সংগ্রাম, বিয়ে, মনস্তাত্তিক সংকট, প্রথম বিয়ের ব্যর্থতা, পেশাগত সংকট, ৬৮ বছর বয়সে এসে দ্বিতীয় বিয়ের স্বস্তি ইত্যাদি। এই বইটির কাজ শেষ হলেও এবছর নয়, সামনের মেলায় পাওয়া যাবে বইটি। তবে মেলায় আছে আমার আগের বইগুলো, বিশেষ করে নালন্দায় আছে গতবছর মেলায় প্রকাশিত কবিতার বই ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’।
আপনার লেখালেখির শুরুটা কখন থেকে? প্রথম বই কবে প্রকাশিত হয়? প্রথম বই প্রকাশের কোনো মজার ঘটনা পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চান?
জাহানারা পারভীন : ১৪ বছর বয়সে প্রথম লেখা শুরু। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর পড়াশোনায় বিরতি আসে। তিন মাসের অবসরে টের পাই প্রতিদিন কাগজে কিছু একটা লিখছি। কবিতা, ছড়া। কিশোরদের জন্য একটা উপন্যাসও লিখে ফেলেছিলাম যা পরে আর খুঁজে পাইনি। নিজের অজান্তেই লেখার একটা প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তির পর প্রথম লেখা কবিতা হয় ডাকসু থেকে প্রকাশিত সংকলনে। এরপর লেখা ছাপা হতে থাকে জাতীয় দৈনিকে। যোগ দিতে থাকি সাহিত্য, আড্ডায়। প্রথম বই ‘নোঙরের গল্প বাচাচ্ছি’ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে বর্নায়ন থেকে। তখন কবি হিসেবে আমার পরিচিতি নেই।
নালন্দা’র প্রকাশক বন্ধু জুয়েলের বড় ভাই লিয়াকত ভাই সে সময় ব্যবসায়ীক ক্ষতি স্বীকার করে আমার বই করেন। আমার তখনো পাঠক তৈরি হয়নি। ছোট ভাইয়ের অনুরোধে লিকায়ত ভাই আমার বই করলেও বিক্রি নেই। যে কয়েক কপি বিক্রি হয়েছিল তার প্রধান ক্রেতা বাংলা বিভাগের সহপাঠী আর বন্ধুরা। তরুণ কবির জন্য সেই বা কম কি? তবে একদিন বিখ্যাত এক লেখক আমার প্রথম বইটি কিনেছিলেন। কবি, কথশিল্পী আনসিুল হক এক বিকেলে মেলায় বর্নায়নের স্টলে এসে আমার বইটি কেনেন। খুব ভাল লেগেছিল।
বাংলাদেশের সমাজে নানা রকম আন্দোলন সংগ্রাম হচ্ছে। কিন্তু কবিতায় এর কোনো প্রভাব পড়ছে না কেন?
জাহানারা পারভীন : কবিতা আজকাল অনেকটাই গণ বিচ্ছিন্ন, সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আন্দোলনের কথাও লেখা হচ্ছে। তাদের লেখা হয়ত চোখে পড়ছে না। গণমাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল কবিতার বদলে মুখ চেনা কবির কবিতা ছাপা হয়। কবিতার চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কই বা পরিচিতিই লেখা ছাপানোর প্রধান মাপকাঠি।
প্রকৃত কবিতা চর্চার মানুষ কি কমে যাচ্ছে?
জাহানারা পারভীন : কবিতা শিল্পের সবচেয়ে উচ্চাঙ্গ শাখা। কবিতা সবার জন্য নয়। প্রকৃত কবি যেমন কম, কবিতার পাঠকও কম। পৃথিবীর সব দেশেই এমনটা দেখা যায়। তবে আগে কবিতা পাঠকের মনরোঞ্জণ করত। এখন তা কমে যাচ্ছে। তাই হয়ত কবিতা জনপ্রিয় হচ্ছে না। নব্বইয়ের দশকে বইমেলায় আবৃত্তির স্টল বরাদ্ধ বাতিলের পর আর আবৃত্তিকারদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রচলিত কবিতা মানুষের কাছে কম যাচ্ছে। এটাও কিন্তু একটা মাধ্যম পাঠকের কাছে যাওয়ার।
কবিতা লেখার চেয়ে কবিরা অনেক বেশি মিডিয়া নির্ভর হয়ে যাচ্ছেন, মিডিয়া কী আসলে কাউকে বড় কবি বানাতে পারে?
জাহানারা পারভীন : আসলে এটা হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। পরিচিতির জন্য মিডিয়া একটা বড় নির্ভরতার মাধ্যম, এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু ভালো লেখার পরিবর্তে মিডিয়ায় গুরুত্ব পাচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ কবিরা। ফসলের চেয়ে আগাছার পরিচিতি বেশি। এটা কবিতার জন্য ভাল ফল বয়ে আনবে না। এর ফলে প্রতারিত হচ্ছে পাঠক। একটি ভালো বইয়ের কাভার, ভাল কবিতা না ছেপে, কম গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রচার করে, দূর্বল প্রচারপটু লেখককে পুরস্কার দেয়ায় দলাদলি বাড়ছে সাহিত্যে। মিডিয়া পরিচিতি বাড়তে পারে মাত্র, বড় কবি বানানোর ক্ষমতা মিডিয়ার নেই। মিডিয়া খ্যাতি বাড়াতে পারে। খ্যাতিমান কবিমাত্রই বড় কবি নন।
সাম্প্রতিক সময়ে কবিতার বইয়ের পাঠক প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে, এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দায়ী কে? এক্ষেত্রে পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?
জাহানারা পারভীন : কবিতা আসলে খুব বেশি বিক্রি হয়নি কখনো। কবিতার পাঠক বরাবরই কম ছিল। তবে ওই যে বললাম নব্বইয়ের দশকে আবৃত্তিশিল্পীদের কল্যাণে জনপ্রিয় বা বিখ্যাত কবিদের কবিতা বিক্রি কিছুটা বেশি হয়েছে। এই বিক্রির ফলে কবিতার উপকার কতটা হয়েছে বলা মুশকিল। সবচেয়ে ভাল কবিতার বই কম কপি বিক্রি হয় মেলায়। এজন্য লেখককে দায়ি করা যাবে না। কবিতা বোঝা যায় না বলে লেখককে গালি না দিয়ে পাঠকেকেও প্রস্তুতি নিতে হবে কবিতা বোঝার জন্য। শিল্পবোদ্ধা পাঠকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। রুচিশীল মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে দামি ফার্নিচার দেখা গেলেও একটি লাইব্রেরি বা অন্তত একটি বুক শেলফ দেখা যায় না।
একটি ভাল ভারতীয় বা নতুন ছবি যতজন দর্শক দেখেন, ভাল মানের কবিতার বই কতজন পাঠক পড়েন? যদিও চলচ্চিত্রের সাথে বইয়ের তুলনা চলে না। এটা আসলে রুচির সংকট। এখানে কবির কিছু করার নেই। আর পাঠকের মনোরঞ্জন করা প্রকৃত কবির কাজ নয়। যারা করেন তাতে প্রকৃত কবিতার উপকার হয় না।
আপনার প্রিয় কবি কে? কোন কবিতার বই আপনাকে প্রভাবিত করেছে?
জাহানারা পারভীন : আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। আমার ওপর তার কিছুটা প্রভাব আছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের
বইমেলা নিয়ে কবি হিসেবে আপনারর কোনো পরামর্শ আছে?
জাহানারা পারভীন : আমি মনে করি জায়গা কম বলে ভিড় থাকলেও বাংলা একাডেমি চত্বরের মেলাই ছিল প্রাণের মেলা। মেলার পরিসর বাড়িয়ে মূল প্রকাশনাগুলো উদ্যোনে নেয়ার পর মেলার জায়গা বাড়লেও, ঘোরাঘুরি করার সুযোগ তৈরি হলেও মেলা হারিয়েছে তার মূল চরিত্র। আমি মেলায় গিয়ে সবচেয়ে বেশি আড্ডা দিতাম লিটলম্যাগ চত্বরে। এখন ওখানে গেলে মনে হয় আগের সেই চত্বর আর নেই। কি যেন হারিয়ে গেছে। আর গত কয়েক বছরে উদ্যানে প্রবেশ করে মিস করেছি আগের সেই মেলাকে।
এমএম/এসকেডি/এবিএস