ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘নারী পুলিশ সদস্য হয়েও সফল পাইলট হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছি’

তৌহিদুজ্জামান তন্ময় | প্রকাশিত: ১২:১০ এএম, ০৯ মার্চ ২০২৩

ফাতেমা-তুজ-জোহ্‌রা। পুলিশ এভিয়েশন উইংয়ের প্রথম নারী পাইলট। ২০২২ সালের ১৬ মার্চ সফলভাবে একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছেন তিনি। ২০২১ সালের জুলাইয়ে আর্মি এভিয়েশন স্কুলে চারজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে শুরু হয় এভিয়েশন বেসিক ট্রেনিং কোর্স। সেখানে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর ১০ কর্মকর্তার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৩৬তম বিসিএসের ফাতেমা। মানসিক, শারীরিক সুস্থতা, দক্ষতা, সক্ষমতা ও তৎপরতাসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চূড়ান্ত অ্যাপটিটিউড টেস্ট দিয়ে উড়োজাহাজের ককপিটে পাইলটের সিটে বসেন পুলিশের প্রথম এ নারী পাইলট। এভিয়েশন বেসিক কোর্সে বিভিন্ন বাহিনীর ১০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে তাত্ত্বিক বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন ফাতেমা-তুজ-জোহ্‌রা।

ফাতেমার জন্ম পাবনায়। নানাবাড়ি রাজবাড়ীর পাংশা গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং পাংশা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ফিজিকস, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগে। শিক্ষাজীবনে তিনি ভেবেছিলেন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় ক্যারিয়ার গড়বেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরোতেই বদলে যায় প্রেক্ষাপট ও ভাবনা। মনোযোগ দেন ক্যারিয়ার গড়ায়। বসেন বিসিএস পরীক্ষায়। প্রিয় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় পছন্দের তালিকার শুরুতেই রাখেন পুলিশ ক্যাডার।

৩৬তম বিসিএস দিয়ে ২০১৮ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন সিআইডি সাইবার পুলিশ ইউনিটে। সেখানে কাজ করতে গিয়ে সাইবার প্ল্যাটফর্মে সংঘটিত অপরাধ ও অসচেতনতার কারণে সাধারণ মানুষের ভিকটিমে পরিণত হওয়ার অসহায় চিত্র মনে দাগ কাটে ফাতেমার। তখন তিনি একজন অ্যাডিশনাল এসপির নেতৃত্বে আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা নিয়ে চেষ্টা করতেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। কর্মক্লান্ত প্রতিটি দিনের শেষে টিমের সদস্যদের মুখে তখনই হাসি দেখা যেতো, যখন একজন ভিকটিমের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠতো।

এয়ার উইংয়ের অংশ হওয়াকে একটি বড় সুযোগ হিসেবেই দেখেন ৩৬তম ব্যাচের সহকারী পুলিশ সুপার ফাতেমা-তুজ-জোহ্‌রা। কারণ এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগত। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে সরাসরি কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।

জাগো নিউজ: আপনার জন্ম পাবনায়, রাজবাড়ী থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা। তখনকার বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই...

ফাতেমা: আমার পরিবার থেকে অনুপ্রাণিত বলেই আজ আমি ফাতেমা-তুজ-জোহরা। পরিবারের দিকনির্দেশনা ও তাদের দেখানো পথে হেঁটে আজকে আমি এই পর্যন্ত এসেছি। আমি একজন মেয়ে হিসেবে সৌভাগ্যবান। কারণ প্রতিটি পদক্ষেপে সুনির্দিষ্টভাবে গাইডলাইন পেয়েছি এবং সব সময় পূর্ণ সাপোর্ট ছিল। বিশেষ করে বলতে হয় আমার মায়ের কথা। আমার মা তার নিজের জীবনে অবহেলার শিকার ছিলেন। তার নিজের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। সে কারণেই তার সন্তানদের বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আমার মায়ের প্রথম সন্তান আমি। জন্মের পর থেকেই মা এতটা সচেতন ছিলেন যে, প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি যেন ঠিক করে রেখেছিলেন। আর বাবা সব সময় মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়ে গেছেন। এছাড়াও আমার শিক্ষকরা আমাকে উৎসাহিত করতেন।

জাগো নিউজ: পুলিশ এভিয়েশন উইংয়ের প্রথম নারী পাইলট আপনি। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

ফাতেমা: নিজের কাছে মনে হয় আমি অনেক সৌভাগ্যবান একজন মানুষ। প্রথমত আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য। পুলিশের একজন সদস্য হিসেবে অভূতপূর্ব একটি সুযোগ লাভ করেছি। এজন্য ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা, পরিবার ও আমার প্রতিষ্ঠানের প্রতি। তাদের সবটুকু সহযোগিতা থাকার ফলেই পুলিশ এভিয়েশন উইংয়ের প্রথম নারী পাইলট আমি।

জাগো নিউজ: এভিয়েশন বেসিক ট্রেনিং কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

ফাতেমা: এক কথায়, যিনি পাইলট হতে চান তার জন্য এভিয়েশন ট্রেনিং বেশ চ্যালেঞ্জিং। শুরুটা বেশ কঠিন। আমার সব ইনস্ট্রাক্টর ও পুলিশ সদর দপ্তরের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থনে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং জার্নিটা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি। আমার মতো একজন মানুষ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে আজকে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি এজন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।

জাগো নিউজ: ককপিটে পাইলটের সিটে বসার সময়ের অনুভূতি এবং উড়োজাহাজ চালানো সময়টা কেমন ছিল?

ফাতেমা: আমি যখন ককপিটে পাইলটের সিটে বসেছি তখন ফ্লাইং শেখার জন্য অথবা আমার নিজের কন্ট্রোলে একটা প্লেন মুভ করছে, এটা প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। প্রথম দিন ফ্লাই করে আসার পর অনেক আনন্দের দিন ছিল আমার জন্য। ককপিটের সিটে বসে আকাশ থেকে নিচে দেখতে একটা অচেনা পৃথিবী মনে হয়, সেই অচেনা পৃথিবী দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি।

জাগো নিউজ: পুলিশে যোগদানের পর পাইলট হওয়ার স্বপ্ন কীভাবে?

ফাতেমা: পুলিশে যোগদানের সঙ্গে পাইলট হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। স্বপ্নটি ছোটবেলার। ছোটবেলায় অন্যান্য শিশুদের মতো আমার মনেও দূর আকাশে উড়ে যাওয়া প্লেনটির রহস্য-রোমাঞ্চের অনুভূতি তৈরি করতো। তখন প্লেনের শব্দ শুনে বাড়ির উঠানে ছুটে যেতাম, আঙুল তুলে দেখাতাম প্লেন যাচ্ছে। তখন থেকেই আকাশে উড়ে যাওয়া প্লেনটির পাইলট হতে ইচ্ছা করতো। আর ছোটবেলায় কেউ যদি বলতো বড় হয়ে কী হতে চাও, একটা দম্ভ নিয়ে বলতাম ‘আমি পাইলট হবো’। এরপর সময় গড়িয়ে বহুদূর গেছে। সে জায়গা থেকে সরে এলেও কোথায় যেন ছোটবেলার ইচ্ছাটা হামাগুড়ি দিচ্ছিল। সে কারণে যে মুহূর্তে জানতে পারলাম পুলিশে এভিয়েশন উইং যুক্ত হচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি করিনি। আগ্রহী অফিসার হিসেবে তখনই নামটি পাঠাই। আলহামদুলিল্লাহ্‌ সুযোগটা পেয়ে যাই।

জাগো নিউজ: পাইলট হওয়ার পেছনে কার অনুপ্রেরণা ছিল অথবা পাইলট হওয়ার পেছনের গল্প শুনতে চাই...

ফাতেমা: মা খুব আগ্রহী হন শোনার পরে। ছোটবেলা থেকে আমাদের কখনো বুঝতে দেননি ছেলে আর মেয়ে আলাদা বিষয়। কোনো কাজ, কোনোকিছু শেখা অথবা দক্ষতা অর্জন করা কোনো ক্ষেত্রেই এই বিভেদটা বুঝতে দেননি মা। পরে পারিপার্শ্বিক সমাজ দেখে বুঝতে হয়েছে ছেলে আর মেয়ে আলাদা ব্যাপার। আমরা দুই ভাই-বোন। আমার ছোট একজন ভাই আছে। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান হিসেবে আমার পাওয়াটা একটু বেশিই। চ্যালেঞ্জ ও সাহসসহ যে কোনো কিছুর আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ মা থেকেই তৈরি হয়েছিল। পাইলট হওয়ার পেছনে প্রথম কৃতিত্বটা আমার মায়ের। পরবর্তী সময়ে সহকর্মী, সিনিয়র সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষিরা আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। তারা বলেন, ‘উই আর প্রাউড অব ইউ’। এই মানুষগুলোই আমার শক্তি। যাদের শক্তিতে আমি পথ চলি।

জাগো নিউজ: একা একা সলো ফ্লাইট টেকঅফ করা, ল্যান্ড করে নেমে আসার পর কেমন লেগেছিল সময়টা?

ফাতেমা: উৎকণ্ঠা ঠিক কোন চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছায়, এটা ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারবো না। একই সঙ্গে প্রচণ্ড আনন্দ, কারণ আমি একা যাচ্ছি। সেই সঙ্গে যখন এয়ারক্রাফট নিয়ে টেকঅফ করি তখন একটা অনিশ্চিয়তা ভর করে। যখন প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা-উত্তেজনার চাপ নিয়ে পুরোটা সার্কিট শেষ করে সেফলি ল্যান্ড করা হলো, সে মুহূর্তটা অনেকগুলো অনুভূতি একসঙ্গে দেয়। সঙ্গে একটা স্বস্তিও দেয়। এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, সেই চ্যালেঞ্জ আমি নিতে পেরেছি সফলভাবে।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে যে মেয়েরা পুলিশে পাইলট হিসেবে আসতে চান তাদের কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে?

ফাতেমা: বাংলাদেশের সামাজিকতায় অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সময়ের সঙ্গে আমরাও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা প্রতিবন্ধকতাগুলো জয় করতে পেরেছি। বিশেষভাবে বলবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা। তিনি যেভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন সেক্ষেত্রে যে কোনো পরিবার, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজের যে কোনো অংশকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ফ্লাইং একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। একটা মেয়ে যখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়ে উঠবে খুব সহজেই এ চ্যালেঞ্জটি সে নিতে শিখবে। সেই সঙ্গে মনোযোগ সহকারে নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য দক্ষতা অর্জনের দিকেও মেয়েদেরকে আর বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

জাগো নিউজ: পাইলট হওয়ার পরে আপনার বাবা-মায়ের অনুভূতি কেমন?

ফাতেমা: পাইলট হিসেবে আমার নিজের যে অনুভূতি তার চেয়েও কয়েক স্তরে বেশি ভালো লাগা কাজ করে আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মী বন্ধুদের মধ্যে। আকাশে যখন আমি উড়ি তাদের তখন অনুভূতি আকাশে তারা উড়ছেন। আমি কখন কোন এয়ারক্র্যাফট ফ্লাই করছি সে তথ্য সব আত্মীয়দের কাছে থাকে না। কিন্তু আকাশে এয়ারক্র্যাফট উড়ে গেলেই আমার আত্মীয়ারা মনে মনে আশা করেন পাইলট হিসেবে আমিই আছি ওই এয়ারক্রাফটে। একই সঙ্গে মজার বিষয় অন্যদিকে নিজের কাছে গর্ববোধ হয়।

জাগো নিউজ: পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের স্বাবলম্বী হতে আপনার বার্তা কী?

ফাতেমা: প্রথমত বলতে চাই সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের নারীরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এসএ গেমসে নারী ক্রীড়াবিদরা স্বর্ণ জিতেছে, ক্রিকেটেও সাফল্য রয়েছে বাঙ্গালদেশি নারী দলের। বর্তমান সময়ে প্রতিটি মেয়ের তার নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষা করে সেটাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সবদিকে রয়েছে। মেয়েরা এখন রাইড শেয়ার করছেন। মেয়েরা এখন আর কোনোদিক থেকেই পিছিয়ে নেই। শিক্ষাগত কাজ এছাড়াও কায়িক কাজসহ সব জায়গায় পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিটি মেয়ে চলতে পারছে। সামাজিকভাবে কোনো মেয়ে বৈষম্যের শিকার হলে তাকে আওয়াজ তুলতে হবে।

টিটি/এমএইচআর