ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

দেশের গণ্ডিতেই আটকা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ০৪:৩৯ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

• দক্ষ জনবল সংকট
• ১০ বছরেও হয়নি নৃগোষ্ঠী সমীক্ষা
• কাজ হয়েছে ৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে
• ১১ ভাষার পকেট অভিধান তৈরি
• কাজ নেই বিদেশি কোনো ভাষা নিয়ে

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বিপদাপন্ন, বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও বিকাশের লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠার পর ১৪ বছর পার হলেও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীতে সাত হাজারের অধিক ভাষা থাকলেও বিলুপ্তপ্রায় বিদেশি (বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশের) কোনো ভাষা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঝুড়িতে নেই কোনো কার্যক্রম। এমনকি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছে তারা। দক্ষ লোকবল সংকট, যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে ঢিমেতালে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও গত এক বছরে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

এক বছরে যা করেছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
মূলত গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হলেও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের। তবে গত এক বছরে ১১টি ভাষার পকেট অভিধান তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। জার্মান, রাশিয়া, স্প্যানিশ, চাইনিজ, কোরিয়ান, আরবি, ফার্সি, তুর্কি ও বাংলা-ইংরেজি ভাষায় পকেট অভিধান তৈরি করেছেন তারা। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অনুবাদ করা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ছয়টি ভাষায়। বিশেষ করে তিনটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজ হয়েছে। বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা ঠার ও কোচ বাংলা এবং ঢাকাইয়া উর্দু নিয়ে হয়েছে অভিধান। সিলেটের চা বাগানে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাদের অধিকাংশই ভোজপুরি ভাষায় কথা বলেন। তাদের ভাষা পুনরুদ্ধারে কাজ চলছে। বিলুপ্তপ্রায় সিলেটের নাগরিলিপি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

দেশের গণ্ডিতেই আটকা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
ইনস্টিটিউটের ভাষা জাদুঘরে রয়েছে ১০১ দেশের ভাষার পরিচিতি

দক্ষ জনবল সংকট
প্রতিষ্ঠানের কাঠামোতে আছে ৯০টি পদ। বর্তমানে এর ২৫ পদই ফাঁকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, লোকবল সংকট তো আছেই, দক্ষ জনবলেরও অভাব। ভাষার বিষয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ও গবেষকের সংকট আছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে অধিকাংশই আসেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে। ভাষা নিয়ে কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা তাদের থাকে না। তবে এখন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। দক্ষ জনবল নিয়োগের চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন
খুঁড়িয়ে চলছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, পরিচিতি নেই ভাষা জাদুঘরের
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ভাষা গবেষণা ট্রাস্ট

দর্শনার্থী কম ভাষা জাদুঘরে
পৃথিবীর ১৯৯ দেশের ভাষার নমুনা, জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত এবং ছবি নিয়ে তৈরি হয় ভাষা জাদুঘর। ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অন্যতম আকর্ষণ ভাষা জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এর আগে এই জাদুঘর চালু থাকলেও দর্শনার্থী টানতে পারেনি। গত এক বছরে আশানুরূপ দর্শনার্থী টানতে পারেনি ভাষা জাদুঘর। যদিও মানুষের সমাগম বাড়াতে গত বছর উদ্বোধনের পর থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে চিঠি দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

১০ বছরেও প্রকাশ হয়নি ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’
২০১৩ সালে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’র কাজ শুরু করে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। পরিকল্পনা ছিল এ সমীক্ষার ১০ খণ্ড বাংলায় এবং ১০ খণ্ড ইংরেজিতে প্রকাশ করার। ২০১৮ সালে মাত্র একটি খণ্ড ছাপালেও সেটি বাজারে আনা সম্ভব হয়নি।

ওইসময় দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় ৪১টি ভাষা শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১৪ ভাষাকে ঘোষণা করা হয় বিপন্ন হিসেবে। সেগুলো হলো- কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুণ্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিতচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং (পাত্র)।

লোকবল সংকট তো আছেই, দক্ষ জনবলেরও অভাব। ভাষার বিষয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ও গবেষকের সংকট আছে। এখানে অধিকাংশই আসেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে। ভাষা নিয়ে কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা তাদের থাকে না।

তবে প্রতিষ্ঠানটির এসব সংকটের কারণ হিসেবে যথাযথ পরিকল্পনা ও দক্ষ লোকবল সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানটি (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট) এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে দক্ষ জনবল তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এখানে যারা কাজ করেন গুটিকয়েক ছাড়া কেউই ভাষাবিজ্ঞানী বা ভাষা গবেষক নন। আমি মনে করি সেখানে দক্ষ লোকবলের অভাব আছে। এটা একটা বড় ঘাটতি। দ্রুত এটা পূরণ করতে হবে।’

দেশের গণ্ডিতেই আটকা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
ইনস্টিটিউটের ভিতরে একটি জাদুঘর থাকলেও প্রচার-প্রচারণার অভাবে পরিচিতি নেই সাধারণ মানুষের কাছে

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মূল কাজ বিশ্বের ভাষাগুলো নিয়ে গবেষণা এবং বিপন্ন ভাষা কী অবস্থায় আছে সেটা জানা। পৃথিবীতে এখন ৭ হাজার ১৬৮টি ভাষা আছে। বাংলাদেশেও বিপন্ন ভাষা আছে ১৪টি। এসব ভাষা পুনরুদ্ধার কীভাবে হবে সে বিষয়ে তাদের গবেষণা করতে হবে।’

আরও পড়ুন
‘স্মৃতি’ নেই সালাম স্মৃতি জাদুঘরে, গ্রন্থাগারে বই সংকট
ভাষাশহীদ রফিকের নামে জাদুঘর থাকলেও নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার জন্য যে সমীক্ষার কাজ শুরু করেছিল, সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রত্যাশা অনুযায়ী যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।’

এই ভাষাবিজ্ঞানী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কিছু ভালো কাজ করেছে। যেমন, পকেট অভিধান, লিঙ্গুইস্টিক অলিম্পিয়াড ও বিভিন্ন ভাষার লিপি নিয়ে কাজ করেছে। আমি মনে করি তাদের কিছু প্রকাশনা বের করা উচিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য। যদিও এরই মধ্যে সরকার তাদের জন্য বই বের করেছে। বই বের করাই কিন্তু সমাধান নয়। এসব বই পড়ানোর জন্য দক্ষ লোকবল দরকার। যে কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’

লোকবল সংকট ও নৃগোষ্ঠীর সমীক্ষার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফের কাছে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি বছর দেড়েক হবে। চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করার। আমাদের একটা সমীক্ষার কাজ শেষ। শিগগির বাকিগুলোর কাজ শেষ হবে।’

আন্তর্জাতিক কোনো ভাষা নিয়ে গবেষণা করার মতো বাজেট নেই। ভাষার গবেষণা করতে হলে অনেক বাজেট দরকার। আমরা এখন দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় ভাষার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। আমাদের দেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ শেষ হলে তখন বিদেশি ভাষা নিয়ে কাজ করবো।

তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে বিশ্বের ১১টি ভাষা নিয়ে পকেট ডিকশনারির কাজ শেষ হয়েছে। এতে প্রবাসীরা খুবই উপকৃত হবেন। যেমন- কেউ সৌদি আরব গেলেন, পকেট অভিধান দেখেই কিন্তু তিনি প্রাথমিক কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী নৃগোষ্ঠীদের ভাষায় অনুবাদ করেছি। এছাড়া তিনটি নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে অভিধান হয়েছে। সিলেটের হারিয়ে যাওয়া নাগরিলিপি নিয়ে বই বের করেছি।’

বিদেশি কোনো মাতৃভাষা নিয়ে কাজ হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. হাকিম আরিফ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোনো ভাষা নিয়ে আমাদের আসলে গবেষণা করার মতো বাজেট নেই। ভাষার গবেষণা করতে হলে অনেক বাজেট দরকার। সেক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা এখন দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় ভাষার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। আমাদের দেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ শেষ হলে তখন বিদেশি ভাষা নিয়ে কাজ করবো। আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে, আমেরিকার তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালিদের বাংলা শেখাতে কাজ করবো। তারা বাংলা ভাষা ভুলেই যাচ্ছে।’

১৯৯৯ সালে ইউনেসকো মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের ঘোষণা দেন। এরপর ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

আরএএস/কেএসআর/জেআইএম