ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রাকৃতিক ধকলে বাজেট

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ১০:২৮ এএম, ০৩ জুন ২০২৫

ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা, ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি, এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ, টানা তিন অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ে ঘোষণা হলো ২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট। কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি এখন গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গণ-অভ্যুত্থানের পর গেল বছরের ৮ আগস্ট শপথ নেয়া সরকারটিকে নিদারুণ এক বাস্তবতায় বাজেট দিতে হয়েছে মাত্র ১০ মাসেরও কম  সময়ের মধ্যে। বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতি ও কাঠামো নিয়ে অনেক দিন ধরে চলা সমালোচনা থাকলেও প্রথার বাইরে যাওয়া হলো না।

ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে সেই কাজটা কিছুটা করতে পারতো। কারণ দেশ সেরা অর্থনীতিবিদরা আছেন তার সরকারে বা সরকারের সাথে। অর্থনীতির নামকরা শিক্ষক রয়েছেন বেশ কয়েকজন। অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সালেহউদ্দীন আহমেদ, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যরা এ সরকারের হার্ডকোরের ব্যক্তি। রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। নোবেল লরিয়েট প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস তো  নিজেই অর্থনীতির বিশ্বতারকা।  

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর এটা প্রথম বাজেট। নির্বাচনের যে তাড়া তাতে এটাই সম্ভবত এ সরকারের শেষ বাজেটও। নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানোসহ বহু ছড়ানো ছিটানো কাজের কারণে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতি হয়ে গেছে বেশি মুখ্য। দলীয় সরকারগুলো যে বাজেট দেয়, তার বাইরে বেরিয়ে একটা বৈষম্যবিরোধী, উন্নয়নমুখী বাজেট দেয়ার উদাহরণ  তৈরির সুযোগ পেলো না অর্থনীতির অ্যাকাডেমিক বিশারদদের  সরকার। নিতে পারেনি আয়-রোজগার, বিত্ত-বৈভব, কর্মসংস্থানে বৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ। অথচ বৈষম্যের অবসান ঘটানোর আন্দোলন দিয়েই গেল সরকারের করুণ বিদায় এবং এ সরকারের অভিষেক।

টানা তিন বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রভাবের পাশাপাশি গত প্রায় এক বছরের বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি অর্থনীতির সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সন্ত্রাসের মতো ঘটনার কারণে বেসরকারি খাত হাবুডুবু খাচ্ছে। বিনিয়োগ কমে চলে গেছে তলানিতে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় টানা ৩৯ মাস ধরে কম, ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্মসংস্থান কমে গেছে। মিলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাঁটাইয়ের ফলে চলতি বেকারের সঙ্গে যোগ হয়েছে লাখ খানেক কর্মহারা নতুন বেকার।  

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এ রকম এক পরিস্থিতিতেই পেশ হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি মেনে ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে বাজেট বাস্তবায়নে সরকার সময় পাবে ছয় মাস। আর প্রধান উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী জুনে নির্বাচন হলে এক বছর। অর্থনীতির জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে মোট বিনিয়োগ ও মোট দেশজ সঞ্চয়। দুটোই কমে গেছে। এবার মোট বিনিয়োগের হার হচ্ছে জিডিপির ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর আগে এর তুলনায় কম বিনিয়োগের অর্থবছর ছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছর, ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর মোট দেশজ সঞ্চয় তো কমছে ধারাবাহিকভাবে।

অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশে মোট দেশজ সঞ্চয় কমে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক সংকেত, যার প্রভাব বহুমাত্রিক। বেসরকারি খাকে ঋণ কমে যাওয়া হচ্ছে আরেকটি দুশ্চিন্তার সূচক। এ খাতে বৃদ্ধির হার হচ্ছে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টানা পাঁচ মাস ধরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের কম থাকার কোনো তথ্য বাংলাদেশে নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানি সংকট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে। তারওপর ছোট-বড় বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক কারণে। সেখানকার হাহাকার জানেন কেবল ভুক্তভোগীরা। 

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে ঘোষণা ও আলোচনা চলছে এতে সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকারের এটাই হবে একমাত্র বা শেষ বাজেট। সময়ের এ টাইমফ্রেমের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে আগের সরকারের বা বিদ্যমান যে বাজেট–কাঠামো, সেই পথেই হাঁটতে হয়েছে। যে কারণে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের যে-সব সুপারিশ এসেছে, সেগুলোর তেমন প্রতিফলন ঘটেনি ঘোষিত বাজেটে। অর্থনৈতিক সংস্কারে দুটি বড় কমিটির প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আছে। একটি শ্বেতপত্র কমিটি, আরেকটি  টাস্কফোর্স কমিটি।

বিশ্বব্যাংকের গত এপ্রিলে বাংলাদেশের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে শ্রমবাজারের এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবের কারণে অনেকেই শ্রমবাজার থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মাঝেই দেশে বন্যার পদধ্বনি। মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। কয়েক দিন আগে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের কারণে উপকূল ভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিতে লাখ লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। এই ধকল না কাটতেই মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারী বৃষ্টির কারণে বন্যার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে উত্তর–পূর্বাঞ্চল ও উত্তর–মধ্যাঞ্চলের কয়েক জেলা। টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সব নদ–নদীর পানি বাড়ছে। লক্ষণ ভালো নয়। তারপরও আশাবাদী অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

অর্থনীতির নানা রূঢ় বাস্তবতার মাঝেও প্রথাগতভাবে দেশের ৫৪তম বাজেট দিতে হয়েছে তাকে। প্রবৃদ্ধির সুফল সমবন্টনের উচ্চাশা তার। বৈষম্যবিরোধী চেতনায় আনতে চান সমতা। এত দিন এক বছর থেকে অন্য বছর বাজেটের আকার বাড়ানো হয়ে আসছিল ১০ শতাংশের বেশি, গতবার বাড়ানো হয় ৫ শতাংশের কম। এবার কমানো হলো। তবে অঙ্কের ফের তত কম নয়। সর্বশেষ পতনের আগে গেল সরকার ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার। আর সালেহউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা করলেন ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে দলীয় সরকারগুলোর ধাঁচের বাইরে যেতে পারেনি অদলীয় সরকার।  দলীয় বৃত্তের বাইরে এসে জনমুখী, একটা বৈষম্যবিরোধী, উন্নয়নমুখী বাজেট কেমন হতে পারে, সেই উদাহরণ তারা তৈরি করে দিতে পারত। কিন্তু, ঘটনার পরম্পরা ও পরিস্থিতির চাপ সম্ভবত সরকারকে সেই এক্সপেরিমেন্ট চালানোর সুযোগ দেয়নি। নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানোসহ বহু কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ সরকারের জন্য। যে কারণে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতি হয়ে গেছে বেশি মুখ্য। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে ঘোষণা ও আলোচনা চলছে এতে সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকারের এটাই হবে একমাত্র বা শেষ বাজেট। সময়ের এ টাইমফ্রেমের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে আগের সরকারের বা বিদ্যমান যে বাজেট–কাঠামো, সেই পথেই হাঁটতে হয়েছে। যে কারণে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের যে-সব সুপারিশ এসেছে, সেগুলোর তেমন প্রতিফলন ঘটেনি ঘোষিত বাজেটে। অর্থনৈতিক সংস্কারে দুটি বড় কমিটির প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আছে। একটি শ্বেতপত্র কমিটি, আরেকটি  টাস্কফোর্স কমিটি।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে জানুয়ারির শেষ দিকে। প্রতিবেদন দুটির সুপারিশের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনার উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দিক থেকেও ওই দুই কমিটির সুপারিশ বাজেটে বাস্তবায়নের চাপ বা তাগিদ আসেনি। কমিটির সদস্যদের দিক থেকেও তাগিদ না হোক অন্তত পেছন থেকে একটু মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তথ্য নেই। যার জেরে বহুল আলোচিত বৈষম্যবিরোধী বা বৈষম্য কমানোর তেমন পদক্ষেপ নেই বাজেটে। আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য, প্রবৃদ্ধির সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও তাই। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের জায়গাটাও ফাঁকা। ব্যক্তি খাত, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, সব জায়গায়ই শুভ বার্তার ভীষণ খরা। 

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

বিজ্ঞাপন