ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের ঈদ

আব্দুল মুনঈম | প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ০৫ জুন ২০২৫

ঈদ মানেই আনন্দ, উৎসব, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে খুশি আর আনন্দ ভাগাভাগি করার দিন। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই ঈদ। ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা। আমাদের দেশে সাধারণত ত্রিশ রোজা পালনের পর ঈদ-উল-ফিতর উৎযাপিত হয়। আর জিলহজ্জ মাসে হজের সময় হয় ঈদ-উল-আযহা, যাকে বাংলাদেশে বলা হয় ‘কুরবানি’ ঈদ । জানা গেছে, আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসি বা উর্দুতে ‘কুরবানি’ হিসেবে পরিচিত। যার অর্থ ‘নৈকট্য’ লাভ। মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানি দেয়। নবী আদম ও বিবি হাওয়ার সময় থেকেই কুরবানির প্রচলন। এই কথা রয়েছে কোরআনের সুরা মায়িদায়। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, নবী ইব্রাহিম আল্লাহকে কতটা ভালবাসেন তার একটা পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পরম করুণাময় আল্লাহতালা। আল্লাহ স্বপ্নে ইব্রাহিমকে বলেন, তোমার সব চাইতে প্রিয় জিনিসটি আমাকে উৎসর্গ কর। পরপর তিন রাত ইব্রাহিম একই স্বপ্ন দেখলেন। এমন স্বপ্ন দেখার পর তিনি চিন্তা করতে লাগলেন তার সব চাইতে প্রিয় জিনিস কী হতে পারে! তিনি দেখলেন তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস তারই পুত্র ইসমাইল। কারণ, তিনি তার বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর অনুগ্রহে ইসমাইলকে পেয়েছিলেন। ফলে ইব্রাহিম তার সন্তান ইসমাইলকে আল্লাহর নামে কুরবানি দিতে উদ্যত হলেন। কুরবানি দেওয়ার পর দেখা গেল ইসমাইলের জায়গায় একটা দুম্বা (মতান্তরে ছাগল) কুরবানি হয়ে পড়ে আছে। এরপর থেকে ইব্রাহিমের অনুসারীরা এই ঘটনার স্মরণে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য চান্দ্র মাসের উল্লেখিত দিনে পশু কুরবানি দেওয়া চালু করেন।

কুরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। এ জন্য আমরা পশু কুরবানি করি এবং সাথে নিজের পশুত্ব ত্যাগ করে ইহজগৎ ও পরজগতের শান্তি সঞ্চয় করি। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই কুরবানির আসল উদ্দেশ্য ভুলে যাই এবং লোক দেখানো কাজ করি। কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য আসে প্রকৃত ত্যাগের সাথে। ইসলামী বিধানে আছে, পশু কোরবানি করার পর মোট মাংসের তিনটি ভাগ করে এক ভাগ গরিব-দুঃখীকে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে এবং এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্য রাখতে হয়। খুশির এই সুষম বন্টন আমাদের যেমন ত্যাগ শিক্ষা দেয় তেমনি দৃঢ় করে সামাজিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনও। তবে পশুটি কেনার সময় সুস্থ সবল কিনা নিশ্চিত করতে হবে। পশুর চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ করে সেটি বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ টাকা গরীবদের মাঝে ভাগ করে দেওয়ার বিধানও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আসলে কুরবানি পশু কেনার সামর্থ্য না থাকলে বা না কিনতে পারলে এর একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করে। বিশেষ করে সমাজের মধ্যবিত্তের কাছে। অনেক ক্ষেত্রে আশপাশের মানুষ বা আত্মীয়-স্বজনের কাছেও হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় কুরবানি না দিতে পারা মানুষটির। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার আবার লোক লজ্জার ভয়ে ধারদেনা করেও কুরবানির পশু কিনে নিয়ম রক্ষার্থে কুরবানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু ইসলামে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সামর্থ্য না থাকলে কুরবানি দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণীর মানুষ কুরবানির পশুর উচ্চমূল্যের কারণে কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে, আরেক দল কুরবানির পশু কিনে সেই পশুর পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে জাহির করছেন। আদতে এটাই কি কুরবানির ধর্মীয় মূল্যবোধ? এটা কি ত্যাগের মহিমা? যুগের পর যুগ ধরে আমাদের দেশে চলছে ধর্মের নামে এই ধরনের সামাজিক অবক্ষয়। এটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধনী-দরিদ্রের একটি নেতিবাচক পার্থক্য।

আজ থেকে দেড় দুইশ বছর আগে ঈদুল আযহাকে বলা হত ‘বকরী’ ঈদ। সেই সময় বকরী ঈদ এখনকার মত এত আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না। শহরের মোড়ে মোড়ে এত পশুর হাটও বসত না। অবস্থাসম্পন্ন লোকেরা কুরবানি দিতেন আর তা পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রদের মাঝে তা বিলিয়ে দিতেন। ব্রিটিশ আমলে বকরী ঈদে সরকারি ছুটির দিন একদিন ছিল। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুমধাড়াক্কা হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন কিছু হইত না। বকরী ঈদে প্রথম প্রথম দুই-তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানি হইত।’ বর্তমান সময়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মতই তখনকার সময়ের মধ্যবিত্তদের কাছে বকরী ঈদে কুরবানির পশু কেনা ছিল আকাঙ্ক্ষার। যাদের কুরবানির পশু কেনার সামর্থ্য নেই সেই মানুষগুলোর ঈদের আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আসলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে ঈদের প্রস্তুতি মানেই সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ। সীমিত আয়ের মধ্যেই ঈদের পোশাক, অতিথি আপ্যায়নের খরচ- সবকিছু সামলাতে হয়। শিশুদের আবদার মেটানো, পরিবারের সবার জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা, আত্মীয়-স্বজনের জন্য উপহার কেনা- এসবের পেছনে খরচ করতে গিয়ে প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে প্রতি মুহূর্তে হিসাব মেলাতে হয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের কাছে ঈদ-উল-আযহায় সবচেয়ে বেশি আর্থিক যোগানের পর্বটি কুরবানির পশুর জন্য।
বর্তমানে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মধ্যবিত্তের সেই হিসাবের খাতা ভারী করে তোলে। এখন বাজারে প্রতিটি পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম। এই সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ, হলো বাজার নিয়ন্ত্রণের অভাব। প্রতি বছরই ঈদের আগে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো, কৃত্রিম সংকট তৈরি করা- এসব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকারের মনিটরিং দল বাজারে নামলেও সেটি অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয় না। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এসব অরাজকতার শিকার হন। এ সমস্যা থেকে বের হতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং কঠোর নজরদারি। সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন যেন কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ না থাকে, তার বাস্তবায়নও জরুরি।

মধ্যবিত্তের আরেকটি সমস্যা হলো, তারা কারও কাছে গিয়ে নিজেদের দুরবস্থার কথা বলতে পারেন না। নিম্নবিত্তরা যেভাবে ত্রাণ পায়, সহায়তা পায়- মধ্যবিত্তরা সেটাও পান না, তারা কষ্ট গোপন রাখার এক অলিখিত নিয়ম মেনে চলেন। তারা হাত পাততে চান না, লজ্জায় অনেক সুযোগ-সুবিধা নিতেও সংকোচ করেন। এরা পারিবারিক কিংবা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই
অনেকে সীমিত বাজেট দিয়েই পরিবারের আনন্দ ভাগ করে নেন। আসলে ঈদ আসে ঈদ যায়। মধ্যবিত্তের সুখ, দুঃখের খবর কেউ রাখে না। আমাদের আশপাশে অনেক পরিবার আছে, যাদের কথা হয়ত আমরা স্মরণ করি না। আমাদের একটু খেয়াল, আমাদের একটু অপচয় রোধ দিয়ে আমরা আরও কিছু পরিবারের ঈদের আনন্দ শেয়ার করতে পারি। ইমলাম কিন্তু আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

বিজ্ঞাপন

এবার মসলা ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের ওপর। কুরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বৃদ্ধি বাংলাদেশের বাজারে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যা। এই বৃদ্ধি শুধু ভোক্তাদের জন্যই নয়, খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, কারণ বাড়তি দামের কারণে বিক্রি কমছে। সরকার, ব্যবসায়ী সমিতি, এবং ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। ঈদের আনন্দ যেন দাম বৃদ্ধির কারণে ম্লান না হয়, সেজন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

তবে আশার কথা, নিত্যপণ্যের দাম কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও ডিম আমদানিতে শুল্ক ছাড়, নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, টিসিবি ও ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিবিষয়ক নীতিমালা যুগোপযোগী করাসহ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু এখনও এর প্রভাব বা স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। চেষ্টার পরও কেন হচ্ছে না তা অনুসন্ধান করে এখনই পদক্ষেপ নেয়া হোক।

সবচেয়ে বড় কথা, উৎসবের আনন্দ যেন সবার হয়। শুধুমাত্র বিত্তবানদের জন্য ঈদ নয়। মধ্যবিত্তদেরও ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার অধিকার আছে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য বাজারের দরজা উন্মুক্ত করতে হবে। ঈদের বাজার যেন মধ্যবিত্তের জন্য এক হাপিত্যেশের কারণ না হয়ে, বরং সত্যিকারের আনন্দ আর উৎসবের প্রতিফলন ঘটায়- এটাই আমাদের কামনা।

বিজ্ঞাপন

লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)

এইচআর/এমএস

বিজ্ঞাপন