ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মিত্র পক্ষের গুলি

আব্দুল বায়েস | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ০৮ জুন ২০২৫

 

২০০১ সালে ‘নেহেরু বক্তৃতা’য় অমর্ত্য সেন ‘মিত্রপক্ষের গুলি’ (ফ্রেন্ডলি ফায়ার) নামে একটা ধারণা প্রবর্তন করেন। সেনাবাহিনী সাধারণত শত্রু দেখলে তাক করে গুলি চালায় সত্য, কিন্তু শত্রু মিত্র ঠাহর করতে না পেরে কোনো কোনো সময় নিজের গুলিতে নিজের লোক মারা যায়। বলা হয়ে থাকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ২-২০ শতাংশ সৈন্য মিত্রপক্ষের গুলির শিকার হয়। যদি  ধরে নেয়া হয় যে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে পাঁচজন করে সৈন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ সৈন্য মিত্রপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়। অমর্ত্য সেন এই মিত্রপক্ষের হামলা (আমরা বলবো, আত্মঘাতী ব্যয়) বলতে  এমন সরকার ব্যয়ের কথা বলছেন যা উপকারে না এসে বরং উল্টো অপকারে আসে। মিত্রপক্ষের গুলির কিছু উদাহরণ নিম্নরূপ-

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

  • ২০০১ সালে ভারতে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি টনের ওপর। যদিও ভারত সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ভারতের জন্য ২.৫ কোটি টন আপৎকালীন মজুতই যথেষ্ট। এই মজুতের পরিমাণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের এক সহকর্মী জঁ ড্রেজ লিখেছেন, ৬ কোটি টন খাদ্যশস্যের বস্তা যদি একটির ওপর একটি সাজানো যেত, তা হলে ১০ লাখ কিলোমিটার ওপরে ওঠা যেত; আর এতটুকু পথ পরিভ্রমণ করা মানে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসা।

২০১২ সালে ভারতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে ৩ কোটি টন মজুত ছিল তা বাংলাদেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদনের প্রায় কাছাকাছি। তবে দুর্ভাগ্যজনক যে, ভারত সরকারের গুদামে এত বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত সত্ত্বেও সেই দেশে অপুষ্টির হার ভয়াবহ । একটা দেশে বিশাল মজুত সত্ত্বেও মানুষ অপুষ্টিতে ভুগতে পারে এমনকি না খেয়েও মারা যেতে পারে এবং দেশটির অতিরিক্ত মজুত অন্যান্য দেশের জন্য মৃত্যুকূপ হতে পারে। আর সম্ভবত এই কারণেই অমর্ত্য সেন ভারতের খাদ্যনীতিকে অনেকটা পাগলামির সাথে তুলনা করেছেন। আমরা বলবো  সরকারের খাদ্য মজুত সত্ত্বেও মানুষের মার্সিয়া। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে সরকারকে অব্যাহতভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করতেই হবে। যে কোনো প্রকল্পের সার্বিক সাফল্যের জন্য যথাযথ ব্যয়ের প্রয়োজন আছে ঠিকই কিন্তু  এই ব্যয় যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে সেই লক্ষ্যে মূল্যায়ন, তদারকি, দীর্ঘ মেয়াদি ও অর্থ-বহির্ভূত প্রভাব পর্যালোচনা করা আবশ্যক।

  • ভারতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়াবার পরও শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে । তার অর্থ, স্বল্প বেতনই যে শিক্ষার মানের অবনতির কারণ হবে এমন কোনো কথা নেই। এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধানের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকা এবং (এর সাথে শক্তিশালী  ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতি)  দায়বদ্ধতার বিচ্যুতি সম্ভবত বেতন ও শিক্ষার মানের বিপরীতমুখী সম্পর্কের জন্য দায়ী।
  • বাংলাদেশে হস্তচালিত নলকূপের কারণে আর্সেনিক সমস্যা ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণবিষ প্রয়োগের ঘটনা বলে বিবেচিত হচ্ছে। অন্যদিকে, স্বল্প সুদের ঋণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ পেলে শোধ না করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
  • মানুষের কল্যাণ বা উন্নয়নের জন্য নিবেদিত দেশের জনপ্রিয়  প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের সময় রাস্তা-ঘাট ও যান-চলাচল বন্ধ করে দিয়ে জনগণের অভিশাপ কুড়িয়ে জনপ্রিয়তা হারানো।
  • বাংলাদেশে স্বল্প সুদের ঋণে বিপুল ভর্তুকি সত্ত্বেও অধিকাংশ গরিব মানুষই বেশি সুদেও ঋণ পাচ্ছে না। গরিবের দুঃখ লাঘব করতে গিয়ে দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয়।
  • পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ভরতুকি ব্যবস্থা অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে- ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই এই ভরতুকি ভোগ করে থাকে যদিও ধনীর চাইতে গরিবের ক্ষেত্রে ১ টাকার প্রান্তিক উপযোগ অনেক বেশি।
  • পুল নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে কিন্তু বছরের পর বছর শুধু কয়েকটা স্তম্ভ দাঁড়িয়ে পারাপারের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
  • টিনের ঘরে পরিচালিত স্কুলের জায়গায় দালান দেয়া এবং তা অচিরেই ধসে পড়ার কারণে টিনের ঘরে পরিচালিত শিক্ষারও পরিসমাপ্তি।
  • ভারতে সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পাড়লেও গরিবদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারেনি। ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে না পারলে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম নির্ধারণের জন্য যে পরিমাণ ভরতুকির প্রয়োজন তা দেয়া সম্ভব নয়। সামগ্রিকভাবে এই ভ্রান্ত নীতি ভারতের গরিবদের জন্য মিত্রপক্ষের একটি প্রচণ্ড হামলায় পরিণত হয়েছে। খাদ্য উদ্ধৃত সত্ত্বেও ভারতে ক্ষুধার্ত অপুষ্টির ব্যাপকতা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি এবং জনগণের ভোগান্তি।
  • কুইক রেন্টেল পাওয়ার পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধির চেষ্টা এবং এর ফলে অপচয় ও দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি।

উপরিউক্ত উদাহরণগুলো থেকে মিত্রপক্ষের গুলি সংক্রান্ত সরকারের অর্থের অপচয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। খুব সম্ভবত সে কারণেই সরকারের বিরুদ্ধে অনেকেই চটে আছেন । যেমন, প্রাচীন চৈনিক দার্শনিক লাও জু বলতেন, ‘মানুষের কল্যাণের জন্য সরকার যত আইন করবে, যত বিধিনিষেধ আরোপ করবে, মানুষ ততই গরিব হবে’। মার্কিন রসিক উইল রজার্স লিখেছেন ,‘সরকার কিছু না করলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। সরকার যখন কিছু  করে তখনই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।’ এবং অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান বলেছেন ‘সরকার ভোক্তাদের রক্ষা করুক এর চেয়েও অনেক জরুরি সমস্যা হচ্ছে সরকারের খপ্পর থেকে ভোক্তাদের বাঁচিয়ে রাখা ’।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সরকারি ব্যয় মানেই ব্যর্থতা। সরকার এমন একটা প্রতিষ্ঠান যা মুনাফামুখী প্রবণতার ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের কল্যাণের জন্য নিবেদিত থাকে বলে ধরে নেওয়া হয়। কথায় বলে, মশার সাথে রাগ হয়ে মশারি পোড়াতে নেই, তেমনি মিত্রপক্ষের গুলিতে সৈন্য মারা যাচ্ছে বলে (ক্ষতি হচ্ছে) গুলি বন্ধ করতে হবে তেমন কোন কথা ঠিক নয়। এটা করা যাবে না  কারণ তাহলে শত্রু এসে আক্রমণ করতে পারে। এ প্রেক্ষিতে  যা করণীয় তা হলো মৃতের সংখ্যা যাতে সর্বনিম্নে রাখা যায় সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া। বিশেষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে সরকারকে অব্যাহতভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করতেই হবে। যে কোনো প্রকল্পের সার্বিক সাফল্যের জন্য যথাযথ ব্যয়ের প্রয়োজন আছে ঠিকই কিন্তু  এই ব্যয় যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে সেই লক্ষ্যে মূল্যায়ন, তদারকি, দীর্ঘ মেয়াদি ও অর্থ-বহির্ভূত প্রভাব পর্যালোচনা করা আবশ্যক।

সূত্র : নিজের সংগ্রহ ও আকবর আলি খানের বই, “আজব ও জবর আজব অর্থনীতি”।

বিজ্ঞাপন

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম

বিজ্ঞাপন