ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জ্যাম যন্ত্রণা ও হর্নসন্ত্রস্ত রাস্তায় মুক্তি কিসে?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ১২ জুন ২০২৫

 

প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন এই শহরের আশেপাশে যাবার প্রধান যানবাহন ছিল রিকশা এবং একটু দূরে যেতে চাইলে বাসে চলাচল করতাম। খুব সহজে ও দ্রুত চলাচলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটের বাস ব্যবহার করতাম। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল থেকে মিরপুরে আত্মীয়ের বাসায় অথবা রামপুরায় বোনের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে মন চাইলে সকালে ল্যান্ড ফোনে বলতাম, ক্লাস শেষে একটার বাসে গিয়ে তোমাদের ওখানে খাবো। সাথে আমার এক ক্লাসমেট বন্ধুও যাবে। ও বহুদিন পোলাও-গরুভূনা খায়নি, আজ খেতে চেয়েছে। ব্যাস, যথারীতি দুপুর দুইটার কাছাকাছি মিরপুর ১১নম্বর অথবা রামপুরায় গিয়ে খাবার টেবিলে বসে যেতাম। দেখতাম ওরা আমাদের জন্য সামনে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে!

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আজকাল এমন মধুর স্মৃতির কথা ভাবাই যায় না। এখন সেইরকম বন্ধুও নেই, দরদি আত্মীয়ও নেই। গরমে রাস্তায় গাড়িতে দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে থেকে পাগল হয়ে যাচ্ছি বলে এক যাত্রী গতকাল সংবাদমাধ্যমকে দু:খের কথা বলেছেন। রাজপথে চাদিকে হর্নের বিকট শব্দ, জ্যামে পড়ে গাড়ির চাকা বন্ধ এবং পোড়া তেলে-মবিলের উৎকট গন্ধ ছাড়া আর ভাল কিছুই নেই! সাথে আরো অনেক আধুনিক গল্প-কথার যন্ত্রণা রাজধানীর মানুষের জীবন-মনকে প্রতিদিন বিষিয়ে তুলছে।

কোনো কাজে বেড়িয়ে দিনভর রাস্তায় বসে থাকা কি আমাদের নিয়তির অংশ? সেদিন মে মাসের ২২ তারিখ ২০২৫। সকাল সাড়ে আটটায় ফ্রিস্কুল স্ট্রিট থেকে সোবহানবাগ যাব বলে একটি উবারে কল দিয়েছিলাম। সে দেখালো ১০০ গজ দূরে আছে। রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছি বলে অপেক্ষা করছিলাম। ওর দেরি দেখে জ্যাম মনে করে অপেক্ষা করছি। অনেকক্ষণ পর সে আর ফোন রিসিভ করছিল না। পরে বুঝতে পারলাম আমাকে না জানিয়ে সে আরেকটি খ্যাপ নিয়ে ভিন্ন জায়গায় রওয়ানা দিয়েছে। সেদিন এর উত্তর কোনোভাবেই মেলাতে পারলাম না। নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। অগত্যা, অনেক চেষ্টা করে একটি সাধারণ রিকশায় চেপে রওয়ানা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে অনেক দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছেছি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

রিকশাওয়ালা কথা ছিল, ‘আল্লাহর তিরিশ দিনই জ্যাম’। সেজন্য কামাই নেই। দিনশেষে তার আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে না পারার কথা। আজ তার মালিকের নিকট দৈনিক জমা দিতে পারবে না। এজন্য সে বেশী ভাড়া দাবি করলো। রাজপথে নেমে তার যন্ত্রণার জীবনের কোন সুরাহা সে করতে পারছেই না। এরজন্য দায়ী দিনভর শুধু জ্যাম আর জ্যাম।

বিআইএম অফিসের কাজ শেষে সেখান থেকে সন্ধ্যে ৬টার পর বের হয়ে রাস্তায় যেদিকে তাকাই সেদিকেই স্থবির যানবাহন ও মানুষের জটলা চোখে পড়েছিল। পথে কোনো রিকশা চোখে পড়েনি। রিকশা, বাস, ট্রাক, দামি কার, ভ্যান সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে এ-ওর দিকে তাকাচ্ছিল আর এক অন্যকে গালাগালি করছিল। বিনা কারণে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে উৎকট মিউজিক তৈরি করে সবার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিল। হর্নের শব্দে পাগল হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছিল সেদিন। বিকট হর্ন বাজানোর সেই উৎসব থামানোর সাধ্যি কারো কি আছে এই শহরে?মোবাইলের ঘড়ি ধরে এক মিনিটে একশত সত্তর বার হর্নের শব্দ শোনা গেল সেদিন। এর শব্দ দূষণের দায় কখনই নেয় না কেউই।

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল একটি আটকে পড়া অ্যাম্বুলেন্সের আর্তনাদ। জ্যামে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সটি মুহুর্মুহু প্যাঁপ্যা, হাউমাউ শব্দে, লাইটের ঝলকানি দিয়ে, নানা কায়দা করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। কোন গাড়ি বা যানযাহন চালকদের মন গলেনি তাতে। কারো দরদ দেখানোর কোনো উপায় ছিল না।

সেদিন কোনো উপায় না দেখে একসময় হাঁটতে শুরু করি। ফুটপাতে হাঁটার কোন জায়গা কেই বাকী রাখেনি। গোটা পথে দোকানদার ও হকাররা মিলে পণ্যের পসরা সাজিয়ে দখলে রাখায় প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে অতিকষ্টে বাসায় ফিরেছিলাম। শুধু মনে পড়ছিল-জ্যামে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সটির কথা। যার আগেই আমি পায়ে হেঁটে চলছিলাম আর শব্দ শুনে ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম। একসময় আর্তনাদরত জ্যামে পড়া অ্যাম্বুলেন্সটির শব্দ থেমে গিয়েছিল আমার রাস্তা বদল করে হাঁটা শুরু করার কারণে। সেখানে অবস্থানরত রোগীর কি হয়েছিল তা জানার কোনো উপায় সেদিন ছিল না।

ঘরে ফিরে মনে হচ্ছিল- সকালের সেই রিকশাওয়ালা কথা ছিল, দিনশেষে তার আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে না পারার কথা। তার মতো কত হাজার, লক্ষ গতর খাটা মানুষ রাজধানীতে কষ্টকর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। ধানকাটা মৌসুমেও গ্রামে তাদের কাজ নেই। আজকাল তার এলাকায় মেশিনে ধানকাটা ও মারাই করা হয়। শ্রমিকের মজুরি খুব কম।

বিজ্ঞাপন

পরেরদিন আগারগাঁওয়ে একটি অফিসে জরুরি কাজ ছিল। সময় বাঁচানো যাবে বলে মেট্রো রেলে উঠে যাবার মনস্থির করলাম। স্টেশন পর্যন্ত যাবার সময় বড় রাস্তায় চতুর্দিকে গাড়ি থেমে থাকা দেখতেই মনে হলো কোন দুর্ঘটনা হচ্ছে বুঝি। অনেকক্ষণ রাস্তা বন্ধ থাকার পর বিকট শব্দে স্কটের নিরাপত্তা বাহিনীর সাইরেন শোনা গেল। সঙ্গে হুইসেল, ঝকমকে আলো, হ্যান্ড মাইকের শব্দ ভেসে এলো। সেই গাড়ির বহর এত লম্বা এবং বহরের সুযোগ নিয়ে ওই পথে এত পাবলিক গাড়ি দৌড়ানোর জন্য শরিক হয়ে গেল তা যে যেন থামতেই চায় না!

এটা দেখে আমার কয়েক যুগ আগেকার ছাত্র জীবনে সামরিক সরকারের নিরাপত্তা স্কটের কথা মনে পড়ে গেল। সাধারণ জনগণকে রাস্তায় থামিয়ে দিয়ে ভিআইপি চলাচলের পুরোনো নিয়ম এখনো কেন চালু রাখা হয়েছে তা বোধগম্য হলো না। এখন তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের সাথে জনদূরত্ব কমানোর চেয়ে আরো বেশী জনদূরত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে না?

এটাই আমাদের রাজধানীর সাধারণ মানুষের রাজপথে চলার সাধারণ চিত্র। এক মিনিটে একশত সত্তর বার হর্নের শব্দ শোনা কি চাট্টিখানি কথা? এই শব্দ সবার জন্য ক্ষতিকর। দামি গাড়িতে চড়া, এসি দিয়ে জানালা বন্ধ করে জ্যামে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা বস মানুষগুলোও প্রতিদিন এই শব্দ শোনেন। তারা কেউ কেউ পরিবেশের নীতি নির্ধারক। প্রতিদিন অফিস যাওয়া-আসার পথে গড়ে তিন-চার ঘণ্টা রাস্তায় অলস কাটিয়ে কাটিয়ে দেরিতে অফিসে গিয়ে তাদেরকে কি কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না? এই হিসেব সরকারি খাতায় নেই, নেয়ার মতো কোনো পরিবেশও নেই। এটাই অফিসগামীদের বাংলাদেশি হিসেব।

বিজ্ঞাপন

এবার আরেকটি দিন হেঁটে হেঁটে রাজপথের পাশ দিয়ে শুধু হর্ন বাজানোর ধরণ পর্যবেক্ষণ করলাম। প্রথম দিন ব্যস্ত এলাকায় এক মিনিটে ১৭০ বার হর্ন দিতে শুনেছি। আজ একটি অভিজাত হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায় তার চেয়ে বেশি হর্ন শোনা গেল। এখানে মোটর সাইকেলগুলো একটানা বা হালকা "বিপ" বা "বিপ-বিপ" শব্দ করে। প্রাইভেট কার দুটি-তিনটি ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির মিশ্রণে উচ্চমাত্রার জোড়া শব্দ বিপ-বাপ করে, ট্রাক, বাস এবং বড় যানবাহনগুলো ‘ফাঁআআআআন’ টাইপ শব্দ করে। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ বা কিছু সময় কাস্টমাইজড ট্রাক বা প্রাইভেট গাড়িতে ওঠানামা করা সাইরেন ধ্বনি ‘উই উউ উউ উউ’ করে কানে তালা লাগিয়ে দেয়। কিছু আধুনিক গাড়ি বা কাস্টম গাড়িতে যান্ত্রিকভাবে প্রোগ্রাম করা নানা রকম শব্দও শোনা গেল।

তবে শুধু রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নয়, সারা দেশের সব জায়গায় মোটর সাইকেল ও অটো রিকশা হর্নের অতিরিক্ত ও যথেচ্ছ ব্যবহার শহরের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন ধরনের উচ্চ শব্দযুক্ত হর্ন যেমন এয়ার হর্ন, সাইরেন, ডুয়াল টোন বা মিউজিক্যাল হর্ন, প্রায় সব ধরনের যানবাহনে ব্যবহৃত হওয়ায় শহরে শব্দদূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে অটো রিকশা হর্নের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সব ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটো রিকশায় উচ্চশব্দের হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই ক্রমাগত শব্দদূষণ মানুষের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে, শ্রবণশক্তির ক্ষতি করছে এবং শিশু, বয়স্ক ও রোগীদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এছাড়া, হর্নের উৎপাত পথচারী ও চালকদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ফলে, ঢাকা সহ সারা দেশের হর্নসন্ত্রস্ত রাস্তাগুলো শুধু অশান্ত নয়, অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যহানিকর ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

এ থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে সামান্য প্রচেষ্টাই যথেষ্ট। আমাদের দেশে সকল রাস্তায় ক্ষেত্র বিশেষে হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ করে অচিরেই সরকারি পরিপত্র জারি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত রাস্তায় গতি ও অযথা হর্ন বাজানোর জন্য অটোমেটিকভাবে জরিমানার বিধান চালু করা হোক। এজন্য কোনো গাড়িকে ম্যানুয়ালি রাস্তায় আটকিয়ে জরিমানা না করে জাপানের মতো ভিডিও দেখে চালক অথবা গাড়ির মালিকের এনআইডি কার্ড ও স্যালারি আইডি নম্বর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে জরিমানা কর্তন করা শুরু করলে চালকদের এই হর্ন বাজানো বদভ্যাস কমানো যাবে এবং শব্দ দূষণমূলক দৈহিক ও মানসিক সমস্যা কমে যেতে পারে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
mail: fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস

বিজ্ঞাপন