ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আমাদের সচেতনতা কতটুকু?

প্রশান্ত কুমার শীল | প্রকাশিত: ০৯:৩৮ এএম, ১৪ জুন ২০২৫

বর্তমান যুগকে ‘ডিজিটাল যুগ’ বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে একটিমাত্র ক্লিকেই আমরা জেনে নিতে পারছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কী ঘটছে। এই আশ্চর্য ক্ষমতা এনে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এবং আরও অনেক প্ল্যাটফর্ম। তবে প্রশ্ন হলো, আমরা এসব মাধ্যম ব্যবহার করছি তো ঠিকই, কিন্তু কতটা সচেতনভাবে?

কাজের ফাঁকে সামান্য একটু সময় পেলেই হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে স্মার্টফোন। তার পর স্ক্রল করতে করতে চোখ বোলানো। ঘুম থেকে উঠে চোখ খোলা থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত বার বার। কখনও ইউটিউব, কখনও ফেসবুক, লিংকড-ইন, কখনও-বা ইনস্টা ফিড— সারা দিন নিছক অভ্যাসের বশেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রলিং করে চলছি আমরা। এই স্ক্রল করার সময়টা এ বার মাপতে গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে সমীক্ষকদের। নতুন নতুন উপাত্ত আমাদের সামনে হাজির করছে। যা কিছুটা ভয়াবহ এবং আতংকের ও বটে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মানুষের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহারের অভ্যাস নিয়ে সাম্প্রতিক মার্কিন পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষায় বেশ কিছু আশ্চর্য তথ্য উঠে এসেছে। ২০১২ সালে, একজন ইউজ়ার সারা দিনে গড়ে দেড় ঘণ্টা সময় কাটাতেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। কিন্তু ২০২৪-এর হিসেব অনুযায়ী, সেই সময়টা এখন আড়াই ঘণ্টার কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। রীতিমতো ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। দৈনিক আড়াই ঘণ্টা করে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নিউজ় ফিড স্ক্রল করে চলেছি আমরা। এটিকে কোন দাঁড়িপাল্লায় মাপলে কী দাঁড়ায়? একজন ইউজ়ার বা ব্যবহারকারী সারা দিনে গড়ে যতটা স্ক্রল করেন, তা ভার্টিক্যালি মাপলে অন্তত ৩০০ ফুট হবে, অর্থাৎ স্ট্যাচু অফ লিবার্টি-র সমান হবে!

এই হিসেবে এক সপ্তাহে এই স্ক্রলিংয়ের পরিমাপ দাঁড়াচ্ছে ২,১০০ ফুট, মানে যা দুইটি আইফেল টাওয়ারের সমান। এক মাসে আমরা এক-একজন ৯,০০০ ফুট নিউজ় ফিড স্ক্রল করছি যা গড়ে কি না গোটা তিনটা বুর্জ খলিফার উচ্চতার সমান। আর সারা বছরের হিসেব যদি করা হয়? প্রায় এক লক্ষ দশ হাজার ফুট! অর্থাৎ, সারা বছর ধরে একজন সোশ্যাল মিডিয়া ইউজ়ার যতটা নিউজ় ফিড স্ক্রল করে, তা চার-চারটি মাউন্ট এভারেস্টের সমান! কিন্তু, এত যে কন্টেন্ট ক্রমান্বয়ে স্ক্রল করে চলছি আমরা, তা বানাচ্ছেন কত জন? দুই দশক আগে প্রথম যখন সোশ্যাল মিডিয়া এসেছিল, তখন বিশেষজ্ঞরা ৯০-৯-১ নামের একটি থিয়োরি বা তত্ত্ব দিয়ে ‘ইউজ়ার টেনডেন্সি’কে ব্যাখা করতেন। এই থিয়োরি অনুযায়ী, মাত্র এক শতাংশ ইউজ়ার হলেন ‘ফ্রিকোয়েন্ট ক্রিয়েটর্স’, অর্থাৎ যারা প্রতিদিনই কিছু না কিছু পোস্ট করেন। কখনও কখনও দিনে একাধিক বারও হয় এটি। নয় শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়া ইউজ়ার হলেন ‘অকেশনাল কন্ট্রিবিউটর্স’। এরা কনটেন্ট পোস্ট করার ক্ষেত্রে নিয়মিত নন। মাঝেমধ্যে একটা-দুইটা পোস্ট এদের প্রোফাইল থেকে আপলোড হতে দেখা যায়। আর বাকি ৯০ শতাংশ? তারা স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়াতে এসে বিভিন্ন ক্রিয়েটরদের পোস্ট স্ক্রল করে বেড়ান। কখনও কখনও লাইক, শেয়ার বা কমেন্টও করেন, কিন্তু নিজেরা কিছু পোস্ট করেন না। শুধু অন্যদের পোস্টে ডু মেরে বসে থাকেন। সোশ্যাল মিডিয়ার পরিভাষায় এদের বলা হয় ‘লার্কার’।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গত বিশ বছরে এই ৯০-৯-১ থিয়োরি কিছুটা বদলেছে। ‘অকেশনাল কন্ট্রিবিউটার্স’-এর সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। কিন্তু তথ্যগত ভাবে এটা প্রমাণিত যে, মূল থিয়োরিটা একই আছে। কনটেন্ট পোস্ট করেন খুব কমসংখ্যক মানুষ। বেশির ভাগ ইউজ়ার নিছক লার্কিং করেই খুশি। অর্থাৎ এই পরিসরে সময় কাটাতে পেরেই তৃপ্তি। তারা মনে করে দেখেই তুষ্ট। সমীক্ষা থেকে উঠে আসা আরও একটি তথ্য মনস্তত্ত্ববিদদের ভাবাচ্ছে। কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কমিউনিটি বা মতবাদকে আক্রমণ করে যদি কোনও পোস্ট করা হয়, তবে সে পোস্টের ‘শেয়ার্ড’ হওয়ার সম্ভাবনা ৬৭ শতাংশ বাড়ে! অ্যাক্টিভ ইউজ়াররা সবাই যে এই ধরনের আক্রমণাত্মক পোস্ট করেন, তা কিন্তু নয়। ঐ সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে, মাত্র ৩ শতাংশ অ্যাক্টিভ অ্যাকাউন্ট ‘টক্সিক’, কিন্তু মোট কন্টেন্ট-এর ৩৩ শতাংশ আসে তাদের থেকেই! পোস্টে যত বেশি রাগ, বিদ্বেষ এবং নীতিগত অবস্থানের নিশ্চয়তা, তত সে পোস্ট ইউজ়ারদের আবেগকে বেশি করে প্রভাবিত করে এবং দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্ আবেগ দিয়ে ইউজারদের ব্যাস্ত রাখতে চায় ক্রিয়েটররা। দেখা যাবে এসব কনটেন্টের হয়তো বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই। যা আছে সব গাল ভরা আবেগ ও বাজার ধরার প্রবণতা। সমীক্ষায় এটাও দেখা গেছে যে, যে সব ইউজ়ার ব্যক্তিগত জীবনে সামাজিক মান্যতা চান, তারা অনলাইনে বাকিদের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। সোশ্যাল মিডিয়া এক্স (টুইটার)-এর অ্যালগোরিদম থেকে এটাও পরিষ্কার যে, যে কোনও উদ্দীপনামূলক পোস্টকে এই প্ল্যাটফর্মে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।‌

এর ফলস্বরূপ, কোনও কিছু সম্পর্কে সবটা না জেনেই আমরা নিজেদের মতো করে একটা ‘পারসেপচুয়াল অ্যাভারেজ’ তৈরি করছি। আবার সাধারণীকরণ ও করছি। কোনও একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বা পরিস্থিতিকে কত রকম আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা যেতে পারে, তা কারও পক্ষেই সম্পূর্ণ ভাবে জানা বা বোঝা সম্ভব নয়।অথচ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার লেন্সে যেটুকু ধরা পড়ে, আমরা তার ভিত্তিতেই একটা ধারণা তৈরি করে নিচ্ছি। সাইকোলজির ভাষায় একে বলে ‘অনসম্বল কোডিং’। এই ধারণা সব সময়ে ঠিক না-ও হতে পারে। একটা উদাহরণ সহকারে বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক। ধরা যাক, আমার গাড়িতে মোট পাঁচ বার অন্য গাড়ি ধাক্কা মেরেছে, এবং সেই পাঁচ বারের মধ্যে তিন বারই চালক ছিলেন একজন মহিলা। ব্যস, আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায় যে, মহিলারা ভালো ভাবে গাড়ি চালাতে পারেন না। যদিও স্ট্যাটিস্টিক্স বা পরিসংখ্যান মোটেই সে কথা বলছে না। কিন্ত আমরা সহজেই সাধারণীকরণ করে ফেলছি।

বিজ্ঞাপন

এর পাশাপাশি রয়েছে ব্যাপক তথ্য-বিভ্রান্তির বিষয়টিও। যারা পোস্ট শেয়ার করেন, তাদের মধ্যে তিন রকম ‘স্প্রেডার’ রয়েছেন। প্রথম দল অলস, এরা শেয়ার করার সময়ে কী শেয়ার করছেন, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা বা ফ্যাক্ট চেকের ধার ধারেন না। দ্বিতীয় স্প্রেডার হলেন তারা, যারা ভাবেন যে ঠিক তথ্যই শেয়ার করছেন, কিন্তু বিচার করে দেখেন না। তৃতীয় স্প্রেডাররা হলেন ‘ক্লাউট চেজ়ার’। এরা বিলক্ষণ জানেন যে, যা ফরওয়ার্ড করছেন, তার ভিতরে তথ্য-বিভ্রান্তি রয়েছে। তবু তারা পোস্টের রিচ বাড়ানোর জন্য শেয়ার করেন। ভুল তথ্য বার বার পড়তে পড়তে এবং শুনতে শুনতে এমন পর্যায়ে চলে যায়, যখন একটা সাধারণ ইউজ়ারের পক্ষে তার ভিতর থেকে সত্যিটাকে ছেঁকে নেওয়া প্রায় অসম্ভব, সে তখন ‘কোয়ার্সিভ পারস্যুয়েশন’-এর ফাঁদে পড়ে যায়।‌

রাজনৈতিক প্রোপাগ্যান্ডাকে ছড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে এই কায়দাকে বহু দিন ধরেই ব্যবহার করা হয়েছে।‌ আজকের যুগে ইন্টারনেট এসে গিয়ে এর ব্যবহার আরও বহু গুণে বেড়ে গেছে। একা সোশ্যাল মিডিয়ায় রক্ষা নেই, দোসর এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। ‘ডিপ ফেক’ এখনই এমন পর্যায়ে যে, সত্যি-মিথ্যে আলাদা করা দুষ্কর। মাউন্ট এভারেস্টের সমান স্ক্রল করে চলেছি আমরা, অথচ আদৌও এক পা-ও এগিয়ে চলেছি কি সুন্দর পৃথিবীর গড়ার পথে? সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়ে গেল?

সচেতনতার অভাব বলতে আমি বোঝাতে চাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, তথ্য যাচাই, ফেক নিউজ, সাইবার অপরাধ, ডিজিটাল আসক্তি এবং ভার্চুয়াল আচরণ সংক্রান্ত আমাদের অসচেতনতা। আমাদের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, লোকেশন খোলামেলা শেয়ার করি—যা আমাদেরকে সাইবার অপরাধের শিকার করে তুলতে পারে। অথচ সাধারণ প্রাইভেসি সেটিংস কিভাবে চালু করতে হয়, তা অনেকেই জানেন না কিংবা জানলেও তা প্রয়োগে অনীহা প্রকাশ করেন।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে, গুজব ও ভুয়া খবর ছড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ একজন কোনো কিছু পোস্ট করলেই, যাচাই না করে আমরা সেটি শেয়ার করে দেই—মনে করি এটা "ভাইরাল" করলেই দায়িত্ব শেষ। অথচ কোনো ভুল তথ্য, গুজব কিংবা উসকানিমূলক বক্তব্য সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছে, যার ফলে পড়াশোনা, ঘুম, মানসিক স্বাস্থ্য, এমনকি বাস্তবিক পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা শুধুমাত্র প্রযুক্তির দোষ নয়—আমাদের অভ্যাস, সচেতনতা ও ব্যবহারবিধির অভাবই এখানে মূল ভূমিকা রাখছে।

তবে আশার কথা হলো—এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব। ডিজিটাল লিটারেসি বা ডিজিটাল শিক্ষাকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ করা, পরিবারে সচেতনতা তৈরি, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল প্রচার এবং তরুণদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা জাগ্রত করা সময়ের দাবি। সবশেষে বলবো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের হাতে এক বিশাল শক্তিশালী হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। এই হাতিয়ার আমরা কিভাবে ব্যবহার করব, সেটাই নির্ধারণ করবে আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি তথ্য সচেতন, দায়িত্বশীল এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাই, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া হবে উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও জ্ঞান বিস্তারের অন্যতম মাধ্যম। আর যদি না পারি, তবে এ মাধ্যমই হতে পারে বিভ্রান্তি, কুৎসা আর সহিংসতার ক্ষেত্র। সচেতন হওয়া তাই এখন কেবল বিকল্প নয়—বরং একটি জরুরি প্রয়োজন।

শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
vprashantcu@gmail.com

বিজ্ঞাপন

এএইচআর/এমএস

বিজ্ঞাপন