ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মেধা পাচার নাকি বৈশ্বিক পুঁজির পুনর্বিন্যাস?

ড. মতিউর রহমান | প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ২৩ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গত দুই দশকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এই প্রবণতাকে প্রায়শই “ব্রেইন ড্রেইন" বা মেধা পাচার হিসেবে দেখা হয়, যা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য উদ্বেগজনক। তবে, সমাজবিজ্ঞানী সাসকিয়া সাসেন (Saskia Sassen) তাঁর "The Mobility of Labor and Capital" (১৯৮৮) এবং "Guests and Aliens" (১৯৯৯) বই দুটিতে যে তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করেছেন, তার আলোকে এই ঘটনাকে আরও গভীর, কাঠামোগত ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।

সাসেনের মতে, অভিবাসন কেবল ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা আর্থিক সুবিধার ফল নয়, বরং এটি বৈশ্বিক পুঁজির বণ্টন, অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং শহরের নতুন ভূরাজনৈতিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত একটি জটিল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই বিশ্লেষণ আমাদেরকে প্রচলিত "মেধা পাচার" ধারণার বাইরে গিয়ে অভিবাসনের অন্তর্নিহিত কারণ এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বুঝতে সাহায্য করে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গ্লোবাল সিটি এবং কগনিটিভ লেবারের অভূতপূর্ব আকর্ষণ

সাসেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলোর মধ্যে একটি হলো "গ্লোবাল সিটি"। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী, টরন্টো, সিডনি, লন্ডন বা বার্লিনের মতো কিছু নির্দিষ্ট নগর বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্রীভূত কমান্ড হাব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই শহরগুলো কেবল উচ্চপর্যায়ের আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনাগত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র নয়, বরং তারা এক বিশেষ ধরনের শ্রমশক্তিকে আকর্ষণ করে: "কগনিটিভ লেবার" বা চিন্তাশীল, প্রযুক্তি-দক্ষ ও উচ্চশিক্ষিত পেশাদার।

এই কগনিটিভ লেবাররা মূলত উচ্চতর দক্ষতা সম্পন্ন, যারা আধুনিক অর্থনীতির জটিল এবং বিশেষায়িত কাজগুলো সম্পন্ন করতে সক্ষম। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রকৌশল, চিকিৎসা, তথ্যপ্রযুক্তি বা ব্যবসায় প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী যুবসমাজ এই গ্লোবাল শহরগুলোর স্কিল-বেইজড অভিবাসন প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষভাবে যোগ্য হয়ে ওঠে। কানাডার এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রোগ্রাম, অস্ট্রেলিয়ার স্কিল্ড মাইগ্র্যান্ট ভিসা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্লু-কার্ড সিস্টেম এই কাঠামোরই অংশ। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার চাহিদা মেটাতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে মানসম্পন্ন মানবসম্পদ সংগ্রহের সুযোগ তৈরি করে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সাসেন তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে এই শ্রমিকদের আকর্ষণ করার পেছনে এক ধরনের "পলিসি অব প্রেফারেন্স" কাজ করে, যা গ্লোবাল শহরগুলোর বৈশিষ্ট্য। এই শহরগুলো সামাজিকভাবে উৎপাদিত দক্ষ শ্রমশক্তিকে নিজেদের দিকে টেনে নেয়, অথচ সেই শ্রমিকের সামাজিকীকরণ, শিক্ষাদান এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ভার বহন করে এসেছে প্রেরণকারী দেশ, যেমন বাংলাদেশ। উদাহরণস্বরূপ, একজন বাংলাদেশি প্রকৌশলীকে তার ১৮-২২ বছরের শিক্ষা অর্জনের জন্য তার পরিবার ও দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অথচ, তার দক্ষতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছে উন্নত বিশ্বের একটি দেশ।

এই প্রক্রিয়াটি এক প্রকার "পুঁজির উপনিবেশবাদী" রূপ লাভ করে, যেখানে উন্নত দেশগুলো কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই উন্নয়নশীল দেশ থেকে দক্ষ শ্রমশক্তি আহরণ করে, আর উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের মানবসম্পদ ও বিনিয়োগের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে, একদিকে গ্লোবাল শহরগুলো তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়িয়ে চলে, অন্যদিকে উৎস দেশগুলো মেধা ও তার সাথে জড়িত সম্ভাবনা হারায়। এই অসম বিনিময় বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল স্রোতে প্রান্তিক দেশগুলোর অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তোলে।

বিজ্ঞাপন

সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের 'অপসারণ'

সাসেন তাঁর ১৯৮৮ সালের গবেষণায় ব্যাখ্যা করেন কীভাবে পুঁজির বৈশ্বিক গতি এবং শ্রমের সীমিত গতি একে অপরের সঙ্গে এক সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি করে। পুঁজি অবাধে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে প্রবেশ করে স্বল্প মজুরি ও অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশের খোঁজে, কিন্তু শ্রমিকরা উন্নত দেশে অভিবাসনের ক্ষেত্রে কঠোর আইনি ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়।

এই অসম গতিশীলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে এক ধরনের "সেমি-পেরিফেরি" অবস্থানে পরিণত হয়েছে। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে দেশ গ্লোবাল সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত হলেও, তার অবস্থান প্রান্তিকায়িত এবং তার সার্বভৌমত্ব সীমাবদ্ধ। এই প্রান্তিকীকরণের অর্থ হলো, বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি অংশ হলেও, এর ভূমিকা মূলত কাঁচামাল বা সস্তা শ্রমের উৎস হিসেবে নির্ধারিত।

বাজারমুখী সংস্কারের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়াতে অস্বচ্ছতা, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব, বৈষম্যমূলক কোটানীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় অপ্রতুলতা এবং দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিরতা—এসবই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরে। দেশে পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে তারা এক ধরনের "বিকল্পের খোঁজ" করতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও এই অভিবাসন প্রবণতাকে প্রভাবিত করে। বাজারমুখী সংস্কারের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়াতে অস্বচ্ছতা, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব, বৈষম্যমূলক কোটানীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় অপ্রতুলতা এবং দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিরতা—এসবই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরে। দেশে পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে তারা এক ধরনের "বিকল্পের খোঁজ" করতে বাধ্য হয়।

বিজ্ঞাপন

দেশে যেখানে উদ্ভাবনী কাজের সুযোগ কম, বা মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না, সেখানে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের একটি মানসিকতা তৈরি হয়। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপ তখন তাদের কাছে কেবল উচ্চ আয়ের সম্ভাবনার দেশ থাকে না, বরং ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও আত্মমর্যাদার প্রতিনিধিত্বকারী স্থান হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে, সাসেন এই অভিবাসনকে "অপসারণ" বা expulsion হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এটি কোনো আকস্মিক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি কাঠামোগত চাপের ফল যা ব্যক্তি, পরিবার ও প্রজন্মকে দেশত্যাগে বাধ্য করে।

এই 'অপসারণ' গ্লোবাল পুঁজির অমানবিক স্বরূপকে প্রকাশ করে, যেখানে মানবসম্পদকে কেবল অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়, এবং প্রযোজনা তাদের জীবন ও স্বপ্নকে অর্থনীতির ধ্বংসাবশেষে পরিণত করা হয়। এই তত্ত্বে, অভিবাসী কেবল একজন স্বেচ্ছাসেবী কর্মী নয়, বরং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের চাপ দ্বারা বিতাড়িত একজন ব্যক্তি।

'অতিথি' এবং 'এলিয়েন': স্বীকৃতির দ্বৈততা ও প্রান্তিকীকরণ

সাসকিয়া সাসেন তাঁর "Guests and Aliens" বইটিতে ইউরোপীয় অভিবাসন নীতির সামাজিক-ঐতিহাসিক রূপ তুলে ধরেন এবং দেখান কীভাবে অভিবাসীরা শ্রমবাজারের জন্য "পণ্য" হিসেবে স্বাগত পেলেও, অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক স্বীকৃতি ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের ক্ষেত্রেও এটি গভীরভাবে প্রযোজ্য। তারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপে পৌঁছেও প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হয়।

বিজ্ঞাপন

চাকরির ক্ষেত্রে বিদেশি ডিগ্রির তুলনায় স্থানীয় ডিগ্রির অগ্রাধিকার, ভাষা-দক্ষতার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব, এবং প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদের নানা রূপ তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। অনেক সময় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার তুলনায় কম দক্ষতার কাজ করতে হয়, যা তাদের মেধা ও প্রতিভার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহারকে বাধাগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন পিএইচডি ধারী বাংলাদেশি বিজ্ঞানীকে হয়তো একটি উন্নত দেশে তার যোগ্যতার চেয়ে নিম্নমানের গবেষণাগারে কাজ করতে হয়, বা একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে নির্মাণ খাতে সাধারণ শ্রমিকের কাজ করতে হয়।

এই অভিবাসীরা শ্রমবাজারে অপরিহার্য হলেও, নাগরিকত্ব বা পূর্ণ রাজনৈতিক স্বীকৃতির পথে তাদের নানা আইনি ও সাংস্কৃতিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়। বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ক্ষেত্রেও তাদের বিভিন্ন শর্ত ও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। সাসেন এই অবস্থাকে বোঝাতে "গেস্ট" (অতিথি) ও "এলিয়েন" (বিদেশি) ধারণার ব্যবহার করেন। 'অতিথি' হিসেবে তারা সাময়িকভাবে প্রবেশাধিকার পেলেও, 'এলিয়েন' হিসেবে তাদের নাগরিক অধিকার সীমিত থাকে।

বাংলাদেশের এই তরুণেরা তখন নতুন দেশে সামাজিকভাবে প্রান্তিক হলেও, অর্থনৈতিকভাবে অপরিহার্য একটি অবস্থানে অবস্থান করেন—এ এক ধরনের অবস্থানগত দ্বৈততা। তারা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে তাদের অবস্থান প্রায়শই দুর্বল ও প্রান্তিক থাকে। এই দ্বৈততা তাদের পরিচয় সংকট, মানসিক স্বাস্থ্য (যেমন একাকিত্ব, বিষণ্নতা) এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, যা অনেক সময় তাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সংঘাত তৈরি করে।

বিজ্ঞাপন

রেমিটেন্স, নির্ভরতা এবং অভিবাসন সংস্কৃতির পুনরুৎপাদন

অভিবাসন নিয়ে প্রচলিত বিশ্লেষণে প্রায়শই রেমিটেন্স প্রবাহের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক অবদানের ওপর জোর দেওয়া হয়। তবে, সাসেনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, এই আর্থিক অবদানও একটি বৃহত্তর নির্ভরশীলতার কাঠামো তৈরি করে। প্রেরণকারী দেশগুলো, যেমন বাংলাদেশ, অভ্যন্তরীণ টেকসই উন্নয়নের বদলে রেমিটেন্সের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

এর ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদী বৈষম্য ও অর্থনৈতিক অক্ষমতার চক্র তৈরি হয়, যেখানে দেশ তার নিজস্ব উৎপাদনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ হারায়। রেমিটেন্স অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও, এটি উন্নয়নশীল দেশের কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে না, বরং অনেক সময় সেগুলোকে আড়াল করে রাখে। এই নির্ভরতা দেশের উৎপাদন খাতকে দুর্বল করে এবং একটি ভোগবাদী সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।

এই প্রক্রিয়ার আরও গভীরতর প্রভাব হলো "মাইগ্রেশন কালচার" বা অভিবাসন সংস্কৃতির সৃষ্টি। একবার কেউ বিদেশে সফল হলে, পরিবারের অন্য সদস্যরা, বন্ধুবান্ধব এবং এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সেটিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এই সংস্কৃতি এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, একসময় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবাসমুখী হয়ে ওঠে। IELTS, GRE, GMAT, এবং বিভিন্ন প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন কোর্সগুলো মূলত অভিবাসনের লক্ষ্য পূরণের জন্য ডিজাইন করা হয়।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্স কারিকুলাম নির্বাচনের সময়ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগকে অগ্রাধিকার দেয়। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার, গবেষণা ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হারায় তাদের মেধাবী ছাত্রদের, গবেষণা হারায় উদ্ভাবক, এবং স্বাস্থ্যখাত হারায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। মেধার এই অবিরাম নিঃসরণ বাংলাদেশকে একধরনের "প্রবাহ-ভূখণ্ড" (flow territory) বানিয়ে তোলে—যেখানে মানুষ প্রস্তুত হয় বিদেশে যাওয়ার জন্য, দেশের অভ্যন্তরে অবদান রাখার জন্য নয়। এই প্রক্রিয়া দেশের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতা বিকাশে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের টেকসই উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলে।

অভিবাসনের সমালোচনামূলক সমাজতাত্ত্বিক পাঠ ও নীতিগত প্রস্তাবনা

সাসকিয়া সাসেন আমাদের শিখিয়েছেন যে, অভিবাসন কোনো বিচ্ছিন্ন বা সরল ঘটনা নয়। এটি গ্লোবাল পুঁজির পুনর্বিন্যাস, জাতীয় রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা এবং বৈশ্বিক শহরগুলোর ভূমিকার এক জটিল সম্মিলিত প্রতিফলন। বাংলাদেশ থেকে শিক্ষিত তরুণদের এই অভিবাসন এই বৃহত্তর বৈশ্বিক কাঠামোরই একটি অংশ, যেখানে উন্নত দেশগুলো অত্যন্ত সস্তায় মেধা আহরণ করছে, এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ভবিষ্যৎ ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের সম্ভাবনা হারাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কেবল অর্থনৈতিক নয়, এর গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।

একজন বাংলাদেশি অভিবাসী কেবল বিদেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন না, তিনি তার দেশের জন্য একটি স্থানচ্যুতি, একটি শূন্যতা এবং একটি মেধার অভাব রেখে যাচ্ছেন। সাসেনের তত্ত্ব আমাদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়—অভিবাসন মানে শুধু ব্যক্তিগত সুযোগের সন্ধান নয়, বরং এটি গভীর বৈশ্বিক অসমতার এক সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি, যেখানে কিছু দেশ কাঠামোগতভাবে লাভবান হয়, আর কিছু দেশ টিকে থাকার জন্য লড়াই করে।

এই সমালোচনামূলক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত অভিবাসনকে কেবল রেমিটেন্স-নির্ভর অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে না দেখে, বরং এটিকে একটি কাঠামোগত সংকট হিসেবে চিহ্নিত করা। শিক্ষিত যুবকদের জন্য দেশে সম্ভাবনাময় পরিবেশ তৈরি করা এখন অপরিহার্য। এর জন্য প্রয়োজন:

১. মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন: দেশের শিল্প ও সেবা খাতে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত কর্মসংস্থান তৈরি করা, যা শিক্ষিত তরুণদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন করে এবং তাদের সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ করে দেয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারি চাকরির উপর নির্ভরতা কমিয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে।

২. গবেষণা ও উদ্ভাবনী সংস্কৃতির বিকাশ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং উন্নত অবকাঠামো তৈরি করা, যাতে দেশের তরুণরা দেশেই নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশে অবদান রাখতে পারে। গবেষণার জন্য বিদেশি ডিগ্রির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

৩. সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি দমন: প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সর্বস্তরে দুর্নীতি দমন করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যা তরুণদের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে এবং তাদের মধ্যে দেশ ত্যাগের প্রবণতা কমাবে। চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

৪. দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রণয়ন ও মানবসম্পদ পরিকল্পনা: কেবল তাৎক্ষণিক সমাধানের ওপর জোর না দিয়ে, বরং দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রণয়ন করা যা দেশের মানবসম্পদকে দেশেই ধরে রাখতে এবং তাদের সক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে সাহায্য করবে। মানবসম্পদ পরিকল্পনা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন দেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরি হয় এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হয়।

৫. অভিবাসন সংস্কৃতির বিশ্লেষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: অভিবাসন সংস্কৃতি কীভাবে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে গবেষণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শুধু বিদেশ যাওয়াকেই সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে না দেখে, দেশেই অবদান রাখার সুযোগগুলো তুলে ধরা।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারলে, বাংলাদেশ শুধু মেধা পাচার রোধই করবে না, বরং তার তরুণ প্রজন্মের অপার সম্ভাবনাকে দেশের সার্বিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারবে। এটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/জেআইএম

বিজ্ঞাপন