ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দরিদ্র হয়ে জন্মেছেন, কিন্তু দরিদ্র হয়ে মৃত্যুবরণ করবেন কেন?

সাইফুল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০৪ অক্টোবর ২০২৫

দারিদ্র্য একটি বাস্তবতা, কিন্তু চিরস্থায়ী নিয়তি নয়। মানুষ তার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কিন্তু জীবন কেমন হবে— সেই নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই তার নিজের হাতে। আপনি যদি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, সেটি দুঃখজনক হতে পারে, কিন্তু যদি সেই দরিদ্রতা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন— সেটি হতে পারে এক ধরনের আত্মসমর্পণ।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে জন্মের সময় অর্থনৈতিক বৈষম্য চোখে পড়ে, যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে সুযোগের ঘাটতি সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না যে— এই একই দেশেই হাজার হাজার মানুষ শূন্য থেকে শুরু করে আজ সফল উদ্যোক্তা, শিল্পপতি বা জ্ঞানী মানুষে পরিণত হয়েছেন।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) মতে, ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। যেখানে একসময় প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো, তা ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছিল (যদিও বর্তমান সময়ে দারিদ্র্যের হার আবার বাড়ছে)। এর মানে দাঁড়ায়, দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসার পথ আছে, এবং বহু মানুষ তা করছে।

দারিদ্র্য দূর করা মানে শুধু পকেট ভরানো নয়— এটা হলো নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখা, নিজের সন্তানকে নতুন ভবিষ্যৎ দেওয়া এবং সমাজে একজন প্রভাবক মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এক সময় যিনি শুধু চাল কিনতে হিমশিম খেতেন, তিনি হয়তো একদিন নিজের গ্রামের ১০ জনকে চাকরি দেবেন— এটিই প্রকৃত সফলতা।

গবেষণাগারে তৈরি আবিষ্কার নয়— বরং মাঠে তৈরি এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে যে, সুযোগ, মেধা, পরিশ্রম ও আর্থিক শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় (World Bank, 2022) দেখা যায়, বাংলাদেশে যারা স্ব-উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেন— যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, ফ্রিল্যান্সার বা হস্তশিল্পী— তাদের মধ্যেই দারিদ্র্য কাটানোর হার বেশি।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস একবার বলেছিলেন: “দারিদ্র্য কোনো পাপ নয়, কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে মিতালি করে থাকা অপরাধের মতো।” এই কথায়ই বোঝা যায়, আমরা দরিদ্র হয়ে জন্ম নিলেও সেটি আমাদের দায় নয়, কিন্তু আজীবন সেই অবস্থায় পড়ে থাকাটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ব্যবস্থা হয়ত অনুকূল নয়— কিন্তু সেটি চিরকাল নয়।
বিশ্বব্যাপী আয় বৃদ্ধির অন্যতম পথ হলো শিক্ষা ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট। মানুষ চাইলেই নিজেকে বদলাতে পারে। বাংলাদেশের অনেক সফল উদ্যোক্তাই শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে। তাদের কারও ছিল না উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ, কিন্তু ছিল আত্মবিশ্বাস, শেখার আগ্রহ ও কাজ করার উদ্যম।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বর্তমানে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্রিল্যান্সিং, আইটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ই-কমার্স ও গ্রাফিক ডিজাইন। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই গ্রামের মাটিতে বসেই লাখ টাকা আয় করছেন প্রতি মাসে।

প্রখ্যাত লেখক ও উদ্যোক্তা জিম রন বলেছিলেন, "If you don’t like how things are, change it. You’re not a tree." অর্থাৎ, আপনি গাছ নন— নিজেকে বদলাতে পারবেন। অনেক সময় আমাদের আশেপাশের পরিবেশ, সমাজ কিংবা পরিবার হয়তো পিছিয়ে রাখে, কিন্তু নিজেকে উন্নত করার ইচ্ছা থাকলে, কোনো কিছুই একমাত্র বাধা হতে পারে না।

আমাদের দেশে একটি বড় বাধা হলো আর্থিক অজ্ঞতা। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোথাও ‘টাকা’ বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয় না। কীভাবে আয় বাড়ানো যায়, কীভাবে খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের গুরুত্ব— এসব শেখানো হয় না। ফলে অনেকেই আয় করেও দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারে না। মানুষকে ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ করে তোলার জন্য আমি লিখেছি “দ্য আর্ট অফ পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট, দ্য নিটি গ্রিটি অফ ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট ইন লাইফ, আমি কি এক কাপ কফিও খাব না, প্রবাসীদের ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট” ইত্যাদি যুগান্তকারী বই।

এই জায়গায় যদি ব্যক্তি মাত্রই নিজের মধ্যে ফাইনান্স বিষয়ক জ্ঞান বাড়ায়, তাহলে তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। ছোট একটি ডায়েরিতে দৈনিক আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা, বাজেট তৈরি করা, অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দেওয়া এবং ছোট করে হলেও সঞ্চয় শুরু করাই হতে পারে সেই পরিবর্তনের সূচনা।

উন্নয়ন মানেই শুধু অর্থ নয়— বরং মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তনও জরুরি। Harvard University’র গবেষণা বলছে, "মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি তার আত্মনিয়ন্ত্রণ না বাড়ে, তবে সে যতই উপার্জন করুক, চিরদিনই দরিদ্র্যতার ছায়ায় থাকবে।" তাই দরকার অর্থনৈতিক আচরণগত পরিবর্তন— যেমন: দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করা, ভোগ নয় সঞ্চয়ে আগ্রহী হওয়া, এবং অস্থায়ী লোভের বদলে স্থায়ী নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেওয়া।

বাংলাদেশের শহর-গ্রামজুড়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, যারা হয়তো ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরেই থেকেছেন এতদিন, কিন্তু মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস (MFS) ব্যবহার করে ব্যবসা করছেন। এই ডিজিটাল প্রবেশগম্যতা তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ খুলে দিয়েছে।

“আপনার আজকের অবস্থান নির্ধারণ করে না আপনার ভবিষ্যৎ। আপনার সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করে আপনি কোথায় যাবেন।” — এই কথাটি খুবই বাস্তব। আপনি হয়তো এখনই অর্থনৈতিক কষ্টে আছেন, হয়তো আপনার পরিবারে কোনো উত্তরাধিকার ছিল না, অথবা আপনি উচ্চশিক্ষা পাননি। কিন্তু তাও, আজই আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নিজেকে গড়ার। YouTube, Facebook, Google-এর মতো প্ল্যাটফর্মে শেখার অনেক সুযোগ আছে— যা একসময় কারও কল্পনাতেও ছিল না।

বলা হয়, “ধনী হয়ে জন্মানো সৌভাগ্যের, কিন্তু ধনী হয়ে মৃত্যুবরণ করা আপনার দায়িত্বের ফল।” এই কথায় প্রতিফলিত হয় যে, নিজের জীবনকে আপনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আর্থিক সফলতা মানে কোটিপতি হওয়া নয়, বরং নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে পারা, সংকটমুক্ত জীবন গড়া এবং ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা।

দারিদ্র্য দূর করা মানে শুধু পকেট ভরানো নয়— এটা হলো নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখা, নিজের সন্তানকে নতুন ভবিষ্যৎ দেওয়া এবং সমাজে একজন প্রভাবক মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এক সময় যিনি শুধু চাল কিনতে হিমশিম খেতেন, তিনি হয়তো একদিন নিজের গ্রামের ১০ জনকে চাকরি দেবেন— এটিই প্রকৃত সফলতা।

অবশেষে বলা যায়, দারিদ্র্য হচ্ছে এক ধরনের অবস্থা— কিন্তু সেটি চিরকাল থাকার মতো নয়। আপনি যদি আজও দরিদ্র থাকেন, সেটি হতে পারে পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু আগামী ৫, ১০ বা ১৫ বছর পরে যদি আপনি ঠিক একই অবস্থায় থাকেন— সেটি হবে আপনার সিদ্ধান্তের ফল।
আপনি যদি দরিদ্র হয়ে জন্মে থাকেন, দোষ আপনার না। কিন্তু আপনি যদি দরিদ্র হয়েই মৃত্যুবরণ করেন— দোষ তখন পুরোপুরি আপনার।

লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন