ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বিপর্যয়: কার দায় কতটা

শাহানা হুদা রঞ্জনা | প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট হওয়ার পর থেকে ভাবছি এতগুলো ছাত্রছাত্রী যে অকৃতকার্য হলো, তাদের এবং তাদের পরিবারের উপরে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দুই বছরের পড়া আবার পড়ে ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী পরীক্ষায় বসতে হবে। এরমধ্যে কতজন টিকবে, আর কতজন ঝরে পড়বে, তা কে জানে। বিশেষ করে ছাত্রীরা ফেল করলেই পরিবার বিয়ের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। আর অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে শিক্ষাব্যয় পুনরায় বহণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ছেলেমেয়ে দ্রুত পাস করে বেরিয়ে যাবে, চাকরি বা ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, পরিবারের দায়িত্ব নেবে। মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিঃসন্দেহে চোখে সরষে ফুল দেখছে। এবছর পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১২ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে, সংখ্যার হিসেবে যা পাঁচ লাখের বেশি।

দেশে দু’শোরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইচএসসি-সমমান পরীক্ষায় পাসের হার শূন্য। অবাক হয়ে গেলাম এই ফলাফল শুনে। তাহলে কি এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক লাইনও পড়াশোনা করানো হয়নি? টেস্ট-প্রিটেস্ট পরীক্ষায় কি একজন ছাত্রছাত্রীও পাস নাম্বার পায়নি? শিক্ষকদের ভূমিকা কী ছিল? তারা কেন অভিভাবকদের জানায়নি যে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করছে না, পাশ নাম্বার তুলতে পারছে না। কিভাবে সম্ভব ২০২ টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্য পাশের হার হওয়া? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জানতে চাইবে এই ফল বিপর্যয়ের কারণ কী?

সরকারের পলিসি অনুযায়ী নাম্বার বাড়ানো কমানোর দরকার নেই। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাই দায়ী নয়, সংশ্লিষ্ট সবারই দায় আছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক, স্কুল-কলেজ, অভিভাবক সবারই দায় আছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বোঝাপড়ার দক্ষতা অর্জনে কেবল পাঠ্যবই নয়, প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক ও কার্যকর শিক্ষণ পদ্ধতি। কিন্তু দেশে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি প্রকট। যার কারণে শিশুদের বোঝার সক্ষমতা তৈরি হয় না। অথচ নানাধরনের অব্যবস্থার দায় এখন শুধু শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার বহন করে চলেছে। এটাতো চলতে দেয়া যায় না।

বোদা পাইলট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে কেউ পাস করেনি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জানিয়েছেন ভর্তি হওয়ার পরে সবার বিয়ে হয়ে গেছে, এজন্য কেউ পাস করতে পারেনি। এটা কোন যুক্তি হতে পারে? কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন আগে থেকেই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? সবকিছু মিলিয়েই বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম। এবছর পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় জিপিএ-৫ এর সংখ্যায় বেশ কমেছে। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ফলাফলের তুলনায় এবছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। সেদিক থেকে অনেকেই এবারের রেজাল্টকে 'বিপর্যয়' মনে করছেন। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীর পাস করতে না পারার বিষয়টি ঘিরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে এতটা বিপর্যয়ের কারণ কী? আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় যতটুকু বা যেরকম লিখেছে, মূল্যালয়ের পর সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে গড় রেজাল্টে। তাহলে গত দুই দশকে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে পাসের হার ও জিপিএ-র সংখ্যা বাড়ার যে ধারা দেখা গিয়েছিল সেখানে ছেদ পড়লো কেন? শুধু উচ্চ মাধ্যমিক নয়, মাধ্যমিকেও একইভাবে ফল বিপর্যয় হয়েছিল। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে, গ্রেস মার্কিয়ের মাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভালো ফলাফল দেখানো হতো। (বিবিসি বাংলা) তাহলে ধরে নিতে হবে এখন সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তাই পাসের হার এত কম হয়েছে। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীরা আদতে কী এবং কতটা শিখছে? তারা কি ভালো ফলাফল ও খারাপ ফলাফলে একই জিনিস শিখছে?

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্টের কথা। সেখানে বলা হয়েছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের লার্নিং পোভার্টি ব্রিফ অনুযায়ী, দেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৫১ শতাংশই তাদের বয়স উপযোগী একটি সাধারণ লেখা পড়ে তা বুঝতে পারে না। এ হার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা ভালো হলেও এটি মৌলিক শিক্ষার মানে বড় ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশের শ্রেণিকক্ষে আজ লাখ লাখ শিশু বই খুলে উচ্চারণ করতে বা পড়তে জানে, কিন্তু তাদের অনেকেই আসলে যা পড়ে, তা বোঝে না। দেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও শিক্ষার্থীদের বোঝার ক্ষমতার ক্ষেত্রে গভীর সংকট রয়ে গেছে, যা পাঠ করে তার শাব্দিক ও অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারে না অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী। সাম্প্রতিক দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান ও শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা নিয়ে এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে ইউনেস্কো ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

এরই ধারাবাহিকতা আমরা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাঙ্গণে দেখতে পারছি বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। রেজাল্ট ভালো বা খারাপ হোক প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের শিক্ষার দুর্বলতা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি। গাছের গোড়া শক্ত না হলে আগায় ভাল ফুল বা ফল ফলবে কেমন করে? দেশে ১০ বছর বয়সেও শিশুদের সিংহভাগ বয়সোপযোগী একটি গল্প পড়ে বুঝতে পারে না। এতে একসঙ্গে বিবেচনা করা হয় দুটি বিষয়, স্কুলে গিয়ে শেখার ঘাটতি এবং একেবারেই স্কুলে না যাওয়া শিশুদের হার।

বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর রিপোর্টের কথাই ফুঠে উঠেছে শিক্ষা উপদেষ্টার কথায়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, "দেশের শিক্ষার মূল সংকট প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু হয়। সেই ঘাটতি বছরের পর বছর জমা হয়। দীর্ঘদিন আমরা সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হইনি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছে। পাসের হার সেখানে সাফল্যের প্রতীক, আর জিপিএ-৫ এর সংখ্যা তৃপ্তির মানদন্ড। ভালো ফলাফল দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই। আমি চাই, শিক্ষা ব্যবস্থা আবারও বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করুক।”

এ বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সায়মা রহমান বলেছেন, ‘আমাদের এখনকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বাচ্চারা পড়ছে কিন্তু বুঝছে না। শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায়, কিন্তু সেই জ্ঞানটা টিকছে না। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও হারিয়ে ফেলে। শেখার আনন্দটাই হারিয়ে যাচ্ছে।’ (দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস) ২০২৫ এর উচ্চ মাধ্যমিকে রেজাল্ট খারাপ করা প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, তা হলো রাজনৈতিক কারণে ছাত্রছাত্রীদের মনোসংযোগহীনতা। ২০২৪ সালে দেশের ছাত্র জনতা আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল।

বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের মারধর, হেনস্তা করে বিতাড়িত করা হয়েছে। এইসব কারণে অনেকেই পাঠ্যপুস্তক বা পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিতে পারেনি। ২০২৫ এ এসেও ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের দাবিদাওয়া ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রাজপথে ছিল। এই সার্বিক অবস্থা পড়াশোনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলছেন, ফলাফল খারাপ বা ভালো হওয়ার পেছনে কেবল রাজনৈতিক কারণ খুঁজলেই হবে না। "শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া কতটা হচ্ছে, শিক্ষকরা আসলে ক্লাসে পড়ান কিনা, এগুলোও দেখা দরকার।” (বিবিসি বাংলা)

অন্যদিকে এর কারণ হিসেবে বারবার শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতিকে দায়ী করছেন কুমিল্লার হোমনা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তবারক উল্লাহ। তিনি মনেকরেন, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ও খাতা দেখার ক্ষেত্রে বাড়তি কড়াকড়ি আরোপের প্রভাবও এবারের ফলাফলে পড়েছে। একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে অতীতের মতো পাস করানোর জন্য গ্রেস মার্ক বা 'সহানুভূতি মার্ক' দেয়াও যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য মন্দ ফল বয়ে এনেছিল, তেমনি এটা বন্ধ করে দেওয়া ও বাড়তি কড়াকড়ি আরোপের ফলেও শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো নিজেদের সক্ষমতাকে বিচার করতে পারেনি। এবছর এইচএসসির ফলাফল এমন হওয়ার কারণ হিসেবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেছেন, "প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করল না, এটা তো কাঙ্ক্ষিত নয়। এই বিষয়টিতে আমরা একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি। তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, গলদ আছে, অবশ্যই গলদ আছে। সেই গলদের জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে।"

আমরাও সেই কথাই বলতে চাইছি, গলদটা চিহ্নিত করতে হবে। এজন্য গবেষণা করা দরকার। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষকের দায়দায়িত্ব, অভিভাবকদের সচেতনতা, শিক্ষার পলিসিগত পরিবর্তন, ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা প্রদান সব বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। এবার সবচেয়ে খারাপ করেছে ইংরেজি ও আইসিটিতে। কারিগরি শিক্ষাতেও খারাপ করেছে। অথচ বর্তমানে এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘাটতিটা কেন তৈরি হলো? কিভাবে শিক্ষার্থীদের এই কূপ থেকে টেনে
তোলা যায়, তা দেখা দরকার। যে যা লিখবে সেই নাম্বারই তাকে দেয়া হোক।

সরকারের পলিসি অনুযায়ী নাম্বার বাড়ানো কমানোর দরকার নেই। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাই দায়ী নয়, সংশ্লিষ্ট সবারই দায় আছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক, স্কুল-কলেজ, অভিভাবক সবারই দায় আছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বোঝাপড়ার দক্ষতা অর্জনে কেবল পাঠ্যবই নয়, প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক ও কার্যকর শিক্ষণ পদ্ধতি। কিন্তু দেশে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি প্রকট। যার কারণে শিশুদের বোঝার সক্ষমতা তৈরি হয় না। অথচ নানাধরনের অব্যবস্থার দায় এখন শুধু শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার বহন করে চলেছে। এটাতো চলতে দেয়া যায় না।

২২ অক্টোবর, ২০২৫

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন