জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা- প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
জানা কথা যে অধিকাংশ দেশ আজ সমুদ্রের স্তর উপড়ে উঠা এবং তীব্র ঝড়ো আবহাওয়ার প্রাবল্যের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের মুখোমুখি। তবে সম্ভবত সবার চেয়ে অধিকতর ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল হিসাবে বাংলাদেশের নাম শীর্ষে স্থান পায় কেন না, এবং কে না জানে যে, ব্যাপক বার্ষিক বন্যা এবং অন্তর অন্তর ঘটা বন্যা বাংলাদেশে প্রাত্যহিক জীবনেরই অন্যতম এক অংশ। আরও বিপজ্জনক হলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর সত্তর ভাগ সমুদ্রস্তর থেকে মাত্র পাঁচ মিটার উপরে অবস্থিত এবং জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাস করে গড় সমুদ্রস্তর হতে ১০ মিটারের ভেতর। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর খাত হচ্ছে কৃষি যেখানে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক সংগঠিত হয়, কৃষি খাদ্যের ঝুড়ি তো বটেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা কৃষি, গবাদিপশু মাছচাষ এবং বনায়নের উপর নির্ভরশীল তারা ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়েছেন। এমতাবস্থায় এটাই স্বাভাবিক যে জলবায়ু বিষয়টি ঘিরে গেল এক দশকে কর্মসূচির দ্রুত বিস্তার, নীতিমালা সংক্রান্ত সংলাপ এবং গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচার গুরুত্ব এবং গতিময়তা লাভ করে।
সফল অভিযোজন (এডাপটেসন) নির্ভর করে ঝুঁকি সম্পর্কিত তীক্ষ্ণ সচেতনেতার উপর যাতে করে সময়োপযোগী উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন -প্রসূত নির্দিষ্ট ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা ভিন্ন হতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী কম্যুনিটিগুলোর তথ্য ও বিতর্কে সমান সুযোগ নাও থাকতে পারে। বাংলাদেশের পূর্বেকার অধ্যয়নগুলোতে দেখা গেছে যে সচেতনতা আয়, শিক্ষা ও জেন্ডারের উপর নির্ভরশীল। এমনকি, মানব সাস্থ্যের উপর দৃষ্টিবদ্ধ সাতটি জলবায়ু -ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় প্রায় সাত হাজার খানার উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে জানা যায় উত্তরদাতাদের প্রায় অর্ধেক জলবায়ু পরিবর্তন -প্রসূত ঝুঁকি সম্পর্কে মোটেও অবহিত নন। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, বিআইজিডি-এর রোহিনি কামাল, এম সাইফুল ইসলাম এবং আদিবা নুরাইনা রিসা গবেষণাটি করেছেন।
এর বিপরীত চিত্রও আছে। অতি সম্প্রতি একটি উপজেলায় পরিচালিত সমীক্ষায় কৃষকদের ধারণার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রায় নব্বুই ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে এবং আবহাওয়াসংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্য এবং তাদের ধারণা অধিকাংশ সহগের সাথে সহগামী- যেমন গড় তাপমাত্রার পরিবর্তন, বার্ষিক এবং মৌসুমি বর্ষণ ইত্যাদি। তবে যেখানে উত্তরদাতা বলছেন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, সেখানে আবহাওয়াসংক্রান্ত ধারণার দ্বিমত রয়েছে সম্ভবত এই কারণে যে, যেমনটি বলেছেন হিউ ব্রামার, আবহাওয়া অফিসগুলো শহরাঞ্চল বা তাপ- দ্বীপে অবস্থান করে। যাই হোক, একটা উপজেলা অথবা একটা পেশার মানুষের এবং সীমিত সময় বিস্তৃত ধারণা দীর্ঘকালীন গল্প হবে এমন কোনো কথা নেই । এর অর্থ দাঁড়ায়, উপলব্ধ জলবায়ু পরিবর্তন -প্রসূত ঝুঁকি এবং মাঠ পর্যায়ে পরিবেশ -প্রসূত অভিজ্ঞতা পেতে প্রয়োজন জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল অধ্যয়ন।
সমস্যা অন্যখানেও। গবেষকগণ দেখেছেন যে, অতীতের চরম আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা আর জলবায়ু-ঝুঁকি পাশাপাশি যায়। যাই হোক, বিরূপ ঘটনার অভিজ্ঞতা প্রকৃত ঝুঁকি আড়াল করতে পারে যদি বাস্তব ঝুঁকি পরিমাপগুলো পর্যালোচনা থেকে ছিটকে যায়। বস্তুত বাংলাদেশের বন্যা ঝুঁকি নিয়ে সবচেয়ে বড় জাতীয় পর্যায়ের অধ্যয়ন মনে করে বন্যার উপলব্ধ ঝুঁকি প্রদর্শন প্রকৃত ঝুঁকি প্রদর্শনের দুর্বল প্রতিনিধি। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত উপলব্ধ ঝুঁকির ক্ষেত্রে এটা খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় যেখানে এই ঝুঁকিগুলো ভিত্তিবছরের আবহাওয়া সংক্রান্ত অবস্থান- যেমন তাপমাত্রা, তুফান, বন্যা এবং ভারী বর্ষণ - থেকে আলাদা করা যায় না।
এসব কথা মাথায় রেখে গবেষকগণ বর্তমান গবেষণায় ৬৪ জেলা-বিস্তৃত জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল ডেটাসেট ব্যবহার করেছেন। এই তথ্য এসেছে ২০১৭ সালে ৩৩, ৫৫৪ খানার উপর পরিচালিত একটা জরিপ থেকে এবং জরিপটি যৌথভাবে বিআইজিডি ও ব্র্যাক- গবেষণা এবং মূল্যায়ন বিভাগ (রেড) করেছে এসপিএ -র বেসলাইন সমীক্ষার জন্য। সমীক্ষায় ব্যবহৃত প্রশ্নমালায় জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতাসূচক কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল যেমন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ‘ কথাটার সাথে পরিচিতি, অধুনা উপলব্ধ তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, বন্যা, বর্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা। জানা মতে, এটা বাংলাদেশে অনুভূত জলবায়ু ও পরিবেশ পরিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল মূল্যায়ন।
তাছাড়া এবং জাতীয় পর্যায়ের উপাত্তের সমন্বয় করে পরিস্থিতি অবলোকন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। বিশেষত তারা দেখতে চেয়েছি আইপিসিসি তালিকাভুক্ত নির্দেশকগুলো তাদের কাছে থাকা সমীক্ষার তথ্য এবং জাতীয় প্রতিবেদনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। স্মর্তব্য, ঝুঁকিতে উপলব্ধ পরিবর্তন পরীক্ষায় তারা ডেটাসেট থেকে গেল দশ বছরের সাথে তার আগের দশকগুলোর অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ঃ (ক) কম্যুনিটির বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারক দ্বারা শনাক্তকৃত বর্তমান জলবায়ু ঝুঁকি বাংলাদেশের সর্বত্র জানানো হচ্ছে কিনা এবং (খ) বেসলাইন ও পরিবর্তনশীল জলবায়ুজনিত অবস্থার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের জীবন -জীবিকার অভিজ্ঞতা যথেষ্টভাবে নীতিমালায় প্রতিফলিত হচ্ছে কি না।
নিজের এলাকায় আগের তুলনায় গেল ১০ বছরে পরিবেশের পরিবর্তন প্রশ্নে প্রায় নব্বুই ভাগ উত্তরদাতা পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানিয়েছেন। নির্দিষ্টভাবে, প্রায় আশি ভাগ বলেছেন বর্ষণ বৃদ্ধির কথা, পঁচিশ ভাগ উল্লেখ করেছেন বর্ষণের সময় ও মৌসুম পরিবর্তন, এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন গেল দশ বছরে তাদের অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, এক-পঞ্চমাংশ এর ধারণা পূর্বের চেয়ে শীতের ঠান্ডা এখন কম এবং এক-তৃতীয়াংশ দেখছেন বন্যার প্রকোপ বেড়ে গেছে।
যদি না হয়ে থাকে তা হলে প্রথম দরকার নাজুক কম্যুনিটির কাছে ঝুঁকির খবর ভালোভাবে পৌঁছানো; দুই, আরও ভালোভাবে মাঠ পর্যায়ের তথ্য অভিজ্ঞতা আহরণ করে নীতিমালা প্রণয়নে সাহায্য করা দরকার এবং সবশেষে মাথায় রাখা যে পরিবেশ, এবং সেইহেতু নাজুক জনগোষ্ঠীর জীবন, প্রভাবিত করার জন্য মানব- সংগঠিত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ছাড়াও অন্যান্য উপাদান থাকতে পারে যেমন- স্থানিক, সরাসরি মানুষের কর্মকাণ্ড।
সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে বর্ণনামূলক পরিসংখ্যান এবং লজিস্টিক রিগ্রেসন আলোচনা দ্বারা। এক্ষেত্রে নির্ভরশীল চলক হিসেবে থাকছে বন্যা-কেন্দ্রিক উপলব্ধ পরিবর্তন, তাপমাত্রা, হ্রাস এবং বর্ষণের ধরন এবং অন্যান্য পরিবেশ চলক। অপরদিকে, স্বাধীন চলকের মধ্যে রয়েছে নাজুক জেলাগুলো, জনমিতিক তথ্য যথা জেন্ডার, উত্তরদাতার আয় এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা তবে এখানে নাজুক জেলার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে ধারণা এবং জ্ঞান বিবেচনা করে ফলাফলে দেখা যায় যে, উত্তরদাতার – ৬৭ ভাগ পুরুষ এবং ৩৩ ভাগ নারী - তিন- চতুর্থাংশ জানিয়েছেন ‘জলবায়ু পরিবর্তন ‘ কথাটার সাথে তারা পরিচিত। এদের মধ্যে চার-পঞ্চমাংশ শুনেছেন অন্যের কাছ থেকে এবং প্রায় ষাট ভাগ, প্রান্তিক অধিক্রমন সংবাদ মিডিয়া থেকে যেমন টিভি রেডিও, খবরের কাগজ।
নিজের এলাকায় আগের তুলনায় গেল ১০ বছরে পরিবেশের পরিবর্তন প্রশ্নে প্রায় নব্বুই ভাগ উত্তরদাতা পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানিয়েছেন। নির্দিষ্টভাবে, প্রায় আশি ভাগ বলেছেন বর্ষণ বৃদ্ধির কথা, পঁচিশ ভাগ উল্লেখ করেছেন বর্ষণের সময় ও মৌসুম পরিবর্তন, এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন গেল দশ বছরে তাদের অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, এক-পঞ্চমাংশ এর ধারণা পূর্বের চেয়ে শীতের ঠান্ডা এখন কম এবং এক-তৃতীয়াংশ দেখছেন বন্যার প্রকোপ বেড়ে গেছে। অন্যান্য পরিবর্তনের মধ্যে আছে মৌসুমের অনিশ্চিত বদল (২০ শতাংশ ), বজ্রপাতের প্রকোপ বৃদ্ধি (১৯ শতাংশ ) এবং অধিকতর ঘন ঘন ঝড়-তুফান।
এবার নাজুক জেলার উত্তরদাতার ধারণা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উত্তরদাতার ধারণার একটা তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা যেতে পারে। গবেষকদের পর্যবেক্ষণে পাওয়া আঞ্চলিক ভিন্নতা ইঙ্গিত করে যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি অনুধাবনে উত্তরদাতারা মোটাদাগে সঠিক যদিও চলক বিশেষে সহমতের স্তরে পার্থক্য রয়েছে। এক, উপরের দিকের তিনটা উপলব্ধ পরিবর্তনের সাথে আইপিসিসির শনাক্তকৃত তাপমাত্রা, বন্যা এবং বর্ষণ এই তিন পরিবর্তনের সাথে মিল রয়েছে। যেমন- প্রায় চার-পঞ্চমাংশ উত্তরদাতা মনে করেন বর্ষণ বৃদ্ধি ঘটেছে, একতৃতীয়াংশ বলেছেন তাপমাত্রা বেড়ে যাবার কথা এবং সমানুপাত উল্লেখ করেছেন বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধির কথা।
রিগ্রেসনের ফলাফল নিয়ে দু’একটা কথা বলতেই হয়। তারা লক্ষ করলেন, আই পি সি সি চিহ্নিত তিনটি চলকের বেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গড় তাপমাত্রা, বন্যার প্রকোপ এবং গড়পড়তা বর্ষণ নিয়ে যারা উঁচু মাত্রার ঝুঁকিতে আছেন তারা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আরও বেশি পুনঃপুন পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন। তবে উপলব্ধির বেলায় তারা খুব বেশি কাছাকাছি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ইস্যুতে।
তবে এ থেকে তারা উপসংহার টানতে পারেন না যে, চলকগুলোতে উপলব্ধ পরিবর্তনই আসল পরিবর্তন তবে সমীক্ষাটা যে শিক্ষা দিচ্ছে তা হল ঃ (ক) নাজুক কম্যুনিটির কাছে ঝুঁকির বার্তা প্রেরণ করা, (খ) মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দ্বারা নীতিমালা প্রভাবিত করার কৌশল উদ্ভাবন, এবং (গ) স্বীকার করে নেয়া যে, জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও অন্যান্য উপাদান পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে আর তাই গ্রামীণ জীবন -জীবিকার জন্য সেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব নামিয়ে আনার জন্য দরকার নীতিমালা তৈরিতে খুব নাজুক কম্যুনিটির প্রয়োজন মাথায় রাখা।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম