ইসির লেন্সে ছানি ও বডিওর্নের ফোকাস মোড
জাতীয় নির্বাচনের কার্যক্রম সরেজমিনে পাহারা দেবার জন্য চারশো কোটি টাকায় কেনা চল্লিশ হাজার বডিওর্ন ক্যামেরা শীঘ্র দেশে আসছে। কারণ আমাদের জাতীয় নির্বাচন মানেই গণতন্ত্রের মহোৎসব হলেও অতীতে সেই মহোৎসব অনেক সময়ই কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে নানা অনিয়ম, জবরদস্তি আর স্বচ্ছতার সংকটে। বেশিরভাগ সময় ভোটাররা হয়েছেন ভীত-সন্ত্রস্ত, নির্বাচনী কর্মকর্তারা ছিলেন অসহায়, আর জনগণের আস্থা ডুবে গিয়েছিল সন্দেহের অতলে।
এই বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন বা সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ দেখা গেছে। অতীতে যেমন : ইভিএম, সিসিটিভি ক্যামেরা কেনা হয়েছিল। আর ২০২৫ জাতীয় নির্বাচনের জন্য সর্বশেষ সংযোজন হয়েছে বডি ক্যামেরা। এবারের নির্বাচনে চারশো কোটি টাকা ব্যয়ে চল্লিশ হাজার বডিওর্ন ক্যামেরা কেনা হয়েছে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, এতো বিপুল অর্থ ব্যয় করে এ ব্যবস্থা কি সত্যিই নির্বাচনী অনৈতিকতা ঠেকাতে পারবে? নাকি এটি কেবল আস্থাহীনতার প্রলেপমাত্র? এ বিষয়টি কিছুটা বিশ্লেষণ করা যাক।
বডি ক্যামেরার মূল উদ্দেশ্য হলো মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ রাখা। নির্বাচনকেন্দ্রে ভোটার প্রবেশ থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ, আনসার বা ম্যাজিস্ট্রেটের আচরণ পর্যন্ত সব কিছু রেকর্ডে ধরা পড়বে। তাত্ত্বিকভাবে ভাবলে ক্যামেরা থাকলে কেউ অনিয়ম করতে ভয় পাবে, কারণ প্রমাণ ধরা থাকবে চোখের সামনে। অথচ বাস্তবতা এত সরল নয়। আমাদের দেশে প্রমাণ থাকে, অভিযোগ ওঠে, তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু ফলাফল ক’জন দেখে? তাই ক্যামেরা থাকলেও যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে, তবে সে ভিডিও হয়তো পরদিন কোনো গোপন আর্কাইভে ঢুকে যাবে।
গণতন্ত্রের প্রতীক জাতীয় নির্বাচন। সেখানে মানুষের একটিমাত্র কাজ ভোটের মাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ। আর রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব সেই মত প্রকাশের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। এজন্য প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন নতুন কিছু উদ্যোগ নেয়। কোথাও সিসি ক্যামেরা বসানো হয়, কোথাও ডিজিটাল মনিটরিং, আবার কোথাও নতুন প্রযুক্তির ভরসা। এবার সেই ধারাবাহিকতায় আসছে চারশো কোটি টাকা ব্যয়ে চল্লিশ হাজার বডি ক্যামেরা। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অনেক দাম দিয়ে কেনা সিসি ক্যামেরা বহুবার অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।এবারের কেনা বডিওর্ন ক্যামেরা যেন সেই একইভাবে জন্মান্ধ অথবা বোবা না হয়।
অতীতে নির্বাচনী কেন্দ্রে সেট করা সিসি ক্যামেরার অভিজ্ঞতা মানুষের মনে এখনও স্পষ্ট রয়ে গেছে। তখন নির্বাচনের দিনই বহু কেন্দ্রে অভিযোগ উঠেছিল ক্যামেরা কাজ করছে না, ফুটেজ নেই, কেন্দ্রে বিদ্যুৎ নেই বা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ দেখল অনিয়ম, কিন্তু দেখেও কিছু হলো না।
এভাবে প্রযুক্তি যদি দায়সারা মনোভাবে ব্যবহার করা হয় তবে তা গণতন্ত্রের রক্ষক হবে না বরং আবারও প্রদর্শনীর সামগ্রী হয়ে ওঠবে। যদি ভিডিও প্রমাণ থেকেও কার্যকর পদক্ষেপ না হয় তবে এই ক্যামেরা কেবল বোবা সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগেভাগেই পর্যাপ্ত মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ দেবার প্রয়োজন রয়েছে।
এছাড়া এখানে অর্থনৈতিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। চারশো কোটি টাকা কম অর্থ নয়। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা কৃষিখাতে এই অর্থ গেলে বহু মানুষের জীবনমান উন্নত হতে পারত। অথচ তা ব্যয় হচ্ছে এমন এক যন্ত্রে যা শুধু কাজ করবে ব্যবহারকারীর দেহের মধ্যে। তাদেরকে ওয়াচ করার জন্য যদি রাষ্ট্র আরো কোনো ওয়াচডগ নিয়োগ দেন তাহলে সেটা আরো খরচ বাড়াবে। এটাকে সৎভাবে ব্যবহার করতে না পেরে যদি ভিডিও ফুটেজ অন্ধকার আর্কাইভে তালাবদ্ধ হয়ে যায় তবে এ টাকা হবে নিছক অপচয়। তাহলে চারশো কোটি টাকার এই প্রকল্পকে কীভাবে দেখা যায়? এটিকে একদিকে বলা যেতে পারে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা, অন্যদিকে প্রশ্নবিদ্ধ বিলাসিতা।
বডিওর্ন ক্যামেরার কিছু ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ বা আনসার সদস্য হয়তো ভাববেন, আমার প্রতিটি কাজ এখন রেকর্ড হচ্ছে। সেই ভাবনা অনৈতিক নির্দেশ মানতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে ভোটারও আস্থা পেতে পারেন যে অন্তত তার কণ্ঠস্বর কোথাও ধরা পড়বে। কিন্তু মানুষের আস্থা গড়ে উঠবে তখনই যখন দেখা যাবে যে ফুটেজ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, জবাবদিহি তৈরি হচ্ছে, আর কেউ রেহাই পাচ্ছে না। এজন্য আগাম মনিটরিং ব্যবস্থার বলয় তৈরি রাখা আবশ্যক।
তবে বডিওর্ন ক্যামেরার কিছু ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ বা আনসার সদস্য হয়তো ভাববেন, আমার প্রতিটি কাজ এখন রেকর্ড হচ্ছে। সেই ভাবনা অনৈতিক নির্দেশ মানতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে ভোটারও আস্থা পেতে পারেন যে অন্তত তার কণ্ঠস্বর কোথাও ধরা পড়বে। কিন্তু মানুষের আস্থা গড়ে উঠবে তখনই যখন দেখা যাবে যে ফুটেজ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, জবাবদিহি তৈরি হচ্ছে, আর কেউ রেহাই পাচ্ছে না। এজন্য আগাম মনিটরিং ব্যবস্থার বলয় তৈরি রাখা আবশ্যক।
জাতীয় নির্বাচনে মাত্র চল্লিশ হাজার বডিওর্ন ক্যামেরা কেনা কি গোটা দেশের ভোটকেন্দ্রগুলোতে মবক্রেসির ভিডিও করে অনৈতিকতা ঠেকাতে পারবে? হয়তো অনেকটা না পারলেও আংশিক পারবে। কারণ বডিওর্ন ক্যামেরার একটি ইতিবাচক দিক আছে। এটি মাঠপর্যায়ে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ওপর একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, একজন পুলিশ সদস্য জানেন তার প্রতিটি কাজ রেকর্ড হচ্ছে। তিনি হয়তো ভোটারকে ভয় দেখাতে বা কেন্দ্র দখলের সময় নীরব দর্শক হয়ে থাকতে দ্বিধায় পড়বেন। অন্তত কিছু ক্ষেত্রে এটি নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে। আবার ভোটারও বুঝবেন, চারপাশে প্রযুক্তির নজরদারি আছে, তাই তিনি নির্ভয়ে কেন্দ্রে যেতে পারবেন। তবে এ বিশ্বাস টেকসই হবে কেবল তখনই, যখন মানুষ দেখবে যে ক্যামেরার ফুটেজের ব্যবহার সত্যিই হচ্ছে।
আমাদের মূল সমস্যা কিন্তু প্রযুক্তি নয় বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা। প্রযুক্তি চোখ খুলে রাখবে, কিন্তু সেই চোখে দেখা অন্যায়কে বিচার করতে হলে দরকার সাহসী নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ প্রশাসন আর আইনের শাসন। অন্যথায় ক্যামেরা থাকবে, কিন্তু তারা কথা বলবে না। আর নীরব প্রযুক্তি হয়ে অতীতের মতো হয়ে যেতে পারে মৃত প্রযুক্তি।
জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা, দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আর নাগরিকদের সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো প্রযুক্তি কার্যকর হতে পারে না। উন্নত দেশে বডি ক্যামেরা কার্যকর হয়েছে মূলত পুলিশি আচরণ নিয়ন্ত্রণে, কারণ সেখানে প্রমাণ-ভিত্তিক বিচারপ্রক্রিয়া সক্রিয়। কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপটে যদি ফুটেজ আদালতে বা তদন্তে ব্যবহার না হয়, তবে এর পরিণতি হবে শুধু প্রযুক্তির প্রদর্শনী। ফলে প্রকৃত স্বচ্ছতা আসবে না, বরং মানুষের মধ্যে আরও হতাশা জন্ম নেবে। সেটা যাতে নাহয় সেজন্য বডি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওগুলো আগেভাগে প্রকাশ না করার কঠিন শর্ত জুড়ে দিতে হবে। সেগুলো আগেই বাজারে ছড়িয়ে গেলে সাইবার অপরাধীরা তা দিয়ে এআই, ডিপফেক, ডিপসিক ইত্যাদি দিয়ে নকল ভিডিও বানিয়ে প্রতিপক্ষের চরিত্র হননে মেতে উঠবে। যা বডি ক্যামেরার জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।এতে নির্বাচনের সৎ প্রার্থীরা নাজেহাল হবে, জাতি বিভ্রান্ত হয়ে কুরুক্ষেত্র তৈরি হয়ে যেতে পারে।
অতএব বলা যায়, বডি ক্যামেরা কেনার উদ্দেশ্য সৎ হলেও এটি কোনো জাদুর কাঠি নয়। নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ করতে হলে প্রযুক্তির পাশাপাশি চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জবাবদিহিতা আর ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। অন্যথায় চারশো কোটি টাকার চল্লিশ হাজার ক্যামেরা কেবল লেন্স ঘুরাবে কিন্তু গণতন্ত্রের চেহারা পাল্টাতে পারবে না।
আমরা জানি মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা আসে আচরণ থেকে, ন্যায়বোধ থেকে, জবাবদিহি থেকে। যত দিন না আমরা ভোটের পরিবেশ এমন করতে পারি যেখানে ক্যামেরা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তত দিন এই প্রযুক্তি কেবল দেখাবে আমাদের গণতন্ত্রে চাবি নেই আছে শুধু সন্দেহের তালা।
প্রযুক্তির এই দ্রুত অগ্রযাত্রায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিক রূপ গড়ে উঠেছে সিসি ক্যামেরা ও বডি ক্যামেরাকে ঘিরে। সিসি ক্যামেরার যেমন আলো ও পরিবেশের সামঞ্জস্য বজায় রেখে স্পষ্ট দৃশ্য ধারণে সহায়ক, তেমনি বডি ক্যামেরার ফোকাস বাস্তব মুহূর্তের নির্ভুলতা নিশ্চিত করে। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ যেখানে স্পষ্টতা, সততা ও দায়বদ্ধতাই হবে মূল লক্ষ্য।
আজকাল নিরাপত্তা প্রযুক্তির যুগে সিসি ক্যামেরা ও বডিওর্ন ক্যামেরা নজরদারির সাথে সত্য উদ্ঘাটনেরও নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রের চোখে ছানিপড়া অর্থাৎ লেন্স বা সেন্সরের দুর্বলতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে ছবির স্পষ্টতা হারিয়ে যাবে। এতে বাস্তব ঘটনাও বিকৃত হতে পারে। অন্যদিকে বডি ক্যামেরার ফোকাস-মোড ঠিকভাবে কাজ না করলে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ঝাপসা হয়ে যাবে। যা ন্যায়বিচার বা তদন্তের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই প্রয়োজন শুধু ক্যামেরা স্থাপন নয় বরং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, প্রযুক্তিগত আপডেট ও দায়িত্বশীল ব্যবহার। বডিওর্ন ক্যামেরা পরিচালনার দায়িত্বরত মানুষগুলোর সৎ ও নির্ভীক স্পষ্ট দূরদৃষ্টি ও সঠিক ফোকাসই পারে সেই ক্যামেরার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কার্যকর, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে। যেখানে প্রযুক্তি হবে ন্যায়ের সহযোগী। তা কখনও বিভ্রান্তির উৎস হতে পারবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো যন্ত্র শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে না। মানুষের সততা, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে পারে। প্রযুক্তি সেখানে একটি সহায়ক মাত্র। তাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবারের ভোটের জন্যে উচ্চ দাম দিয়ে কেনা বডিওর্ন ক্যামেরা যেন অতীতের মতো অন্ধ বা বোবা হয়ে না যায়। চল্লিশ হাজার আনসার ও পুলিশের বডিতে চল্লিশ হাজার বডিওর্ন ক্যামেরা আশি হাজার হয়ে যেন তরুণ ভোটারদের মতো সমস্বরে গর্জে ওঠা গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। [email protected]
এইচআর/জেআইএম