ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় পাঠ্যপুস্তক সংকট

বিদেশি নির্ভরতার কারণ, প্রভাব ও সম্ভাব্য রূপরেখা

লে. কর্নেল খন্দকার মাহমুদ হোসেন, এসপিপি, ‍পিএসসি(অব.) | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ২০ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা দীর্ঘদিন ধরেই একটি মৌলিক সমস্যার সম্মুখীন—দেশীয় স্কলারদের রচিত মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলা ভাষায় তো নয়ই; ইংরেজি ভাষায়ও খুব কম বাংলাদেশি লেখকের একাডেমিক টেক্সটবুক পাওয়া যায়। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিদেশি লেখকদের বই, বিদেশি উদাহরণ এবং বিদেশি জ্ঞান কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। প্রশ্ন হলো—কেন এমন হচ্ছে? দেশীয় মেধাবী শিক্ষক-গবেষক কি নেই? নাকি কাঠামোগত কোনো দুর্বলতা রয়েছে?

নিচে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষায় পাঠ্যপুস্তক সংকটের কারণ, বিদেশি নির্ভরতার ঝুঁকি, গবেষণা বনাম টেক্সটবুকের দ্বন্দ্ব এবং ভবিষ্যতে দেশীয় বই তৈরির জন্য কী করা দরকার—সেসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রদান করা হলো।

দেশীয় টেক্সটবুকের অভাবের মূল কারণসমূহ

• দুর্বল গবেষণা ইকোসিস্টেম: একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় টেক্সটবুক শিল্প সাধারণত শক্তিশালী হয় যখন দেশটিতে নিয়মিত গবেষণা, আপডেটেড জ্ঞান উৎপাদন, ল্যাব/ফান্ডিং, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ইত্যাদি মজবুত থাকে। বাংলাদেশে গবেষণা উৎপাদন, গবেষণার মান, গবেষণাকে সমর্থনকারী কাঠামো, অর্থায়ন, নীতি এবং একাডেমিক সংস্কৃতি—সবকিছুই অপর্যাপ্ত বা কিছু ক্ষেত্রে অকার্যকর। বাংলাদেশে গবেষণা সিস্টেম সীমিত হওয়ায় নতুন জ্ঞান উৎপন্ন হলেও তা টেক্সটবুকে রূপ নেওয়ার মতো শক্তিশালী ইকোসিস্টেম তৈরি হয়নি।

দেশীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা একটি জাতীয় দায়িত্ব। বাংলাদেশি স্কলারদের অভাব নেই— তবে ঘাটতি আছে কাঠামোতে, প্রণোদনায়, নীতি-পরিবেশে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনে। যদি গবেষণাকে টেক্সটবুকে রূপান্তর করা যায়, বাংলাদেশ ‘জ্ঞান আমদানিকারক’ থেকে ‘জ্ঞান উৎপাদনকারী দেশ’ হয়ে উঠবে মনে অনুমেয়। আজ দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ের অভাব দূর করে উপরের নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা স্থাপত্যের কেন্দ্র তৈরি হতে পারে। যত দ্রুত এ বিষয়টি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার পাবে, তত দ্রুত দেশীয় স্কলারদের বই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জায়গা পাবে।

• বই লেখাকে অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারে গুরুত্ব না দেওয়াঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদোন্নতির জন্য সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হলো— SCOPUS/ISI জার্নালে প্রকাশনা। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক রচনা খুব কম মূল্যায়িত হয়, কখনো গুরুত্বই পায় না। ফলে শিক্ষকরা অগ্রাধিকার প্রবন্ধ, গবেষণা, সেমিনার, কনফারেন্সকে অগ্রাধিকার দেন। আর টেক্সটবুক লেখার দিকে তাদের ঝোঁক কম হয়।

• শিক্ষক ওভারলোড এবং সময়ের অভাবঃ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে প্রতি সেমিস্টারে ৩–৫ কোর্স, প্রশাসনিক কাজ, পরীক্ষা/স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন ইত্যাদি সবকিছু সামলাতে হয়। কিন্তু একটি মানসম্পন্ন টেক্সটবুক রচনায় লাগে ১–৩ বছর। বর্তমান কাঠামোতে এত সময় শিক্ষকরা পান না।

• বিদেশি টেক্সটবুকের একচেটিয়া আধিপত্যঃ আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, ভারতীয় বা অন্যান্য বেশ কিছু দেশের লেখকদের বই সহজলভ্য এবং সিলেবাসে ‘স্ট্যান্ডার্ড রেফারেন্স’ হিসেবে স্বীকৃত। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এসব বই সফল করার জন্যও অনেক প্রচেষ্টা করা হয়। ফলে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি বইয়ের নিরাপদ পথেই থাকতে চান।

• একাডেমিক প্রকাশনা শিল্পে পেশাদারিত্বের অভাবঃ প্রকাশনা শিল্পে যথাযথ পিয়ার রিভিউ বোর্ড, একাডেমিক সম্পাদক, ইনস্ট্রাকশনাল ডিজাইনার বা মান পরীক্ষা ব্যবস্থা নেই। ফলে টেক্সটবুক তৈরির জন্য পেশাদার প্ল্যাটফর্ম খুবই দুর্বল।

• মানসিক বাধা: কে পড়বে বাংলাদেশি বইঃ এটি একটি গভীর, কাঠামোগত ও সংস্কৃতিগত মানসিক বাধা। অনেক শিক্ষকই মনে করেন— আন্তর্জাতিক স্তরের মতো বই লেখা কঠিন, বাজার ছোট, ক্লাস নোটই যথেষ্ট ইত্যাদি। এই মানসিকতা পাঠ্যপুস্তক রচনার পথে বড় বাধা। অনেক শিক্ষক-গবেষকের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা ও মনোভাব রয়েছে যে, ‘বাংলাদেশি লেখকের বই ছাত্ররা কিনবে না’ বা ‘বিদেশি বই মানেই স্ট্যান্ডার্ড’ বা ‘লোকাল কন্টেন্ট তেমন মূল্যবান নয়।’ এই মানসিক বাধার ফলে স্কলাররা বই লিখতে আগ্রহী হন না, গবেষণা দেশীয় জ্ঞানে রূপান্তরিত হয় না এবং শিক্ষাব্যবস্থা বিদেশি বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

বিদেশি বইগুলো আন্তর্জাতিক মানের হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতির সাথে একইভাবে পথ চলে না। বিদেশি লেখকদের বই বহু দশক ধরে উচ্চশিক্ষার প্রধান উৎস। যেমন McGraw-Hill, Pearson, Oxford, Wiley ইত্যাদি। এই ব্র্যান্ডগুলোর বই দেখতে সুন্দর, মুদ্রণমান উচ্চ, গ্রাফিক্সসমৃদ্ধ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক ও ছাত্র মনে করেন— ‘এটাই তো স্ট্যান্ডার্ড।’ বাংলা/দেশীয় ইংরেজি বইয়ে সাধারণত ডিজাইন, সম্পাদনা, গ্রাফিক্স দুর্বল থাকে। এর ফলে একটি মানসিক তুলনা তৈরি হয়।

এই ধারণা লেখককে বই লেখার আগেই হতাশ করে দেয়। শিক্ষকদের একটা চিন্তার সংকট (cognitive barrier) আছে। যখন তারা দেখেন: বিদেশি লেখকের বইতে ২০–৩০ বছরের গবেষণা, টিমওয়ার্ক, পেশাদার সম্পাদনা রয়েছে কিন্তু তারা বাংলাদেশে তা পান না। দেশে বই লেখাকে সময়, অর্থ, মানসিক সমর্থন—কোনোটিই দেওয়া হয় না। ফলে তারা মনে করেন: ‘আমি লিখলে বিদেশি বইয়ের তুলনায় দুর্বল হবে।’ এই নিজস্বতার সংকট (inferiority mindset) বই লেখার আগ্রহ কমিয়ে দেয়।

অন্যদিকে, লেখকের বাস্তব চিন্তা হলো, একটা বই লিখতে ১–৩ বছর লাগবে, কত কপিই বা বিক্রি হবে, প্রকাশক খুব কমই রয়্যালটি দেবে, তেমন আর্থিক লাভ নেই। ফলে তারা ভাবেন এত পরিশ্রম করে লাভে নেই বা একেবারেই কম। এমন মনোভাব বই লেখার ইচ্ছাকে হত্যা করে। অনেক শিক্ষক আছেন যারা মনে করেন, ক্লাস নোটই যথেষ্ট। এটা একটি বিপজ্জনক একাডেমিক সংস্কৃতি।

বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শুধু ক্লাস লেকচার, হ্যান্ডনোট, স্লাইডভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই তিনটি কারণেই অনেকের কাছে বই প্রয়োজনীয় মনে হয় না। কারণ, ক্লাস নোট দ্রুত তৈরি করা যায়, বইয়ের পড়ার এবং বোঝার মতো পরিশ্রম লাগে না, আর ছাত্ররাও পরীক্ষামুখী হওয়ায় নোট পছন্দ করে। ফলে শিক্ষক মনে করেন—‘বই লিখলেই তো ছাত্ররা কিনবে না। নোটেই চলছে।’ এটি একটি সাময়িক সুবিধার পদ্ধতি এবং একটি নিম্ন প্রত্যাশার মানসিকতা, যা জ্ঞান সৃষ্টির সংস্কৃতিকে বন্ধ করে দেয়। পশ্চিমা জ্ঞানই বিশ্বমানের এবং দেশীয় জ্ঞান সবসময় কম মানের- এই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব (Post-colonial mindset) বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার উচ্চশিক্ষায় এক ধরনের অবচেতন মানসিকতা ধারণা তৈরি করেছে।

অনেক শিক্ষক মনে করেন— ‘ছাত্ররা তো বিদেশি বই/নোটই চায়। দেশীয় বই বিক্রি হবে না।’ কিন্তু গবেষণা বলছে—যেখানে দেশীয় বই মানসম্মত হয়েছে সেখানে ছাত্ররা ব্যাপকভাবে সে বই গ্রহণ করেছে। যেমন- ভারতের UGC পাঠ্যপুস্তক, মালয়েশিয়ার Malaysian Edition বই, Singapore Local Edition সিরিজ এবং বাংলাদেশের আইন, হিসাবরক্ষণ, ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান—এগুলোতে দেশীয় বই ব্যাপক জনপ্রিয়।

• গবেষণা জ্ঞান কেন ছাত্রদের কাছে পৌঁছায় না? বাংলাদেশে অনেক গবেষণা হয়, কিন্তু সেই গবেষণার বড় অংশ ছাত্রদের কাছে পৌঁছায় না। কারণ, গবেষণা পেপার সাধারণত- জটিল, সংকীর্ণ বা বিশেষ বিষয়ের ওপর, paywall-এর পেছনে এবং শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। অন্যদিকে টেক্সটবুক হলো— সহজবোধ্য, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, সমন্বিত এবং প্রজন্মের জ্ঞানভিত্তি তৈরি করে। ফলে দেশে গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু টেক্সটবুক না হওয়ায় এসব গবেষণার জ্ঞান বা উদ্দেশ্য শিক্ষার্থী বা জ্ঞান পিপাসুদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। গবেষণা পেপার কেবল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লাভের মধ্যে সীমিত থাকে।

গবেষণা দিয়ে শিক্ষক পদোন্নতি পান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ranking বাড়ে। অনেকটা, শিক্ষার্থী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভর করে শিক্ষকদের বেড়ে ওঠা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী জ্ঞান তৈরি না হলে শিক্ষার্থীদের গড় মূল বৌদ্ধিকভিত্তি দুর্বল থাকে। এখনকার বাস্তবতা হলো— Research without textbooks is a kind of Knowledge without transmission। অর্থাৎ জ্ঞান তৈরি হলেও তা সমাজে বিস্তার পায় না। কিন্তু সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা বড় স্টেকহোল্ডার।

• বিদেশি নির্ভরতা জাতীয় বৌদ্ধিক পরাধীনতাঃ বিদেশি টেক্সটবুক নির্ভরতার ফলে— স্থানীয় উদাহরণ, কেস স্টাডি বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুপস্থিত। বাংলাদেশি ছাত্র বিদেশি উদাহরণে দক্ষ হয়, কিন্তু দেশীয় সমস্যার সমাধানে দুর্বল থাকে। জ্ঞান কাঠামো আমদানি হয়, নিজেদের জ্ঞানতত্ত্ব তৈরি হয় না। ফলে intellectual dependency তৈরি হয়—এক ধরনের বৌদ্ধিক পরাধীনতা। উচ্চশিক্ষায় দেশীয় অবদান অদৃশ্য হয়ে যায়। দেশের স্কলাররা বই লেখেন না, ফলে আন্তর্জাতিক জগতে বাংলাদেশের একাডেমিক পরিচয় দুর্বল থাকে।

বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষায় বিদেশি বইয়ের সমস্যা

বিদেশি বইগুলো ইংরেজি ভাষায় পড়তে হয় এবং বুঝতে হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বিদেশি পাঠ্যপুস্তক পড়ে অনুধাবন করার মতো পরিমিত জ্ঞানের অভাব সুস্পষ্ট। তাছাড়া, বিদেশি বইগুলো তাদের দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনগত কাঠামো ব্যাখ্যা করে। এসব কাঠামো বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা বা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে আমাদের ছাত্ররা এই বই পড়ে দেশের বাস্তবতা বুঝতে পারে না। একই সাথে সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে বিদেশি বইয়ের কনটেন্ট অনেক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।

এই পার্থক্যের কারণে বিদেশি বইয়ের উদাহরণ এবং থিওরিগুলো আমাদের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়। সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি বইয়ের ভাষা ও বিষয়বস্তু সর্বদা মানানসই নয়। ফলে আমাদের দেশের management, ethics, leadership, HRM, sociology—ইত্যাদি ধরনের বিষয় বিদেশি বইয়ের মাধ্যমে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয় না।

সর্বোপরি, বিদেশি বই মানেই ইংরেজি ভাষা আর ইংরেজিতে উপযুক্ত দক্ষতা সব শিক্ষার্থীর নেই। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা বোঝার দক্ষতা সীমিত, জটিল একাডেমিক শব্দ বোঝার ক্ষমতা কম, দীর্ঘ টেক্সট বিশ্লেষণ করার অভ্যাস নেই, ধারণাগত জটিলতা বুঝতে পারে না এবং বিদেশি ভাষার উদাহরণ ও প্রসঙ্গ ধরতে অসুবিধা হয়। ফলে শিখন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়। একই সাথে ক্লাশে বাংলা আর ইংরেজির সংমিশ্রণে ক্লাস পরিচালনা এবং ঘরে এসে ইংরেজি বই পড়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে।

তাহলে কি আমরা কখনো দেশীয় স্কলারদের বই পাব না?

ভবিষ্যতে বই লেখা এবং প্রকাশের অবকাঠামোগত ও অন্যান্য দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে বা পরিবর্তন করলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তবে বর্তমান কাঠামো বিদ্যমান থাকলে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে শত শত স্কলার আছেন যারা টেক্সটবুক লিখতে সক্ষম। কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা, সময়, পেশাদার প্রকাশনা কাঠামো, জাতীয় নীতি নির্দেশনা থাকা এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত প্রবৃদ্ধির বা লাভের ঊর্ধ্বে গিয়ে স্কলার লেখকের অবদান রাখার উদার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলে আগামীতে বাংলাদেশে শত শত বিদেশি মানের দেশীয় টেক্সটবুক তৈরি করা সম্ভব।

দেশীয় পাঠ্যপুস্তক তৈরির সম্ভাব্য সমাধান ও রোডম্যাপ

• “Bangladesh National University Textbook Policy” চালু করা। যেমন- এটি হবে উচ্চশিক্ষার জন্য একটি জাতীয় নীতি, যার আওতায় UGC প্রতিটি বিষয়ে দেশের স্কলারদের দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড, পিয়ার-রিভিউড, দেশীয় প্রেক্ষাপটে উপযোগী টেক্সটবুক লেখাবে— এবং সরকার এ কাজে অর্থায়ন করবে। ধরা যাক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে Accounting/Finance পড়ানো হয়।

এই কোর্সে সারাদেশেই মূলত Horngren, Ross, Brigham, Weygandt ইত্যাদি বিদেশি বই পড়ানো হয়। এসব বইয়ের হিসাব নীতি, বাজার বাস্তবতা, আইন, কেস স্টাডি—সবই বিদেশি। ফলে ছাত্ররা বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর, কর ব্যবস্থা বা স্থানীয় চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তথ্যবহুল ধারণা পায় না। তাই এক্ষেত্রে UGC বলতে পারে—‘Accounting 101-এর জন্য বাংলাদেশি লেখকদের দ্বারা লিখিত ২-৩টি স্ট্যান্ডার্ড বই তৈরি করা হবে।’ এগুলো সম্পূর্ণ নতুন বই হতে পারে অথবা বিদেশি বইয়ের জ্ঞানকে স্থানীয়করণ করেও তৈরি হতে পারে।

• টেক্সটবুক লেখার জন্য সরকারি অনুদান প্রদান করা। যেমন- একজন লেখক দলকে দেওয়া হলো ১০–১৫ লাখ টাকা, বই লেখার জন্য ১২–১৮ মাস সময়, বই তৈরির পর সম্পাদনা ও রিভিউ খরচ UGC বহন করবে, লেখক রয়্যালটি পাবেন। ভারতে UGC এই মডেল ব্যবহার করে ৬০০+ কলেজ টেক্সটবুক প্রকাশ করেছে। বইটি একবার অনুমোদিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবহার শুরু করবে। এতে ছাত্ররা প্রথমবারের মতো Bangladesh–Context বই পাবে।

• পদোন্নতিতে টেক্সটবুক রচনাকে স্কোপাস পেপারের সমান মর্যাদা দেওয়াঃ যদি একটি মানসম্মত বই যা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন মেটাবে সেটা যদি ওই লেখকের ৩-৪টি গবেষণা প্রবন্ধ এর সমান মর্যাদাপূর্ণ হয় তখন স্কলাররা বই লিখতে উৎসাহ পাবেন। একজন স্কলার যদি ২–৩ বছর ধরে একটি উচ্চমানের টেক্সটবুক লেখেন, সেটি সাধারণত ‘গবেষণা নয়’ বলে গণ্য করা হয়। ফলে শিক্ষকরা স্কোপাস/ISI পেপার লিখতে বেশি আগ্রহী হন। কিন্তু টেক্সটবুক—ছাত্রদের শিক্ষার মূল উপকরণ, একটি দেশের জ্ঞান গঠনের ভিত্তি, গবেষণার সারাংশকে পাঠযোগ্য করে তোলার মাধ্যম। তাই একটি উচ্চমানের টেক্সটবুক ৩–৪টি SCOPUS indexed research paper-এর সমতুল্য মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

একটি বই তৈরিতে ২–৩ বছরের পরিশ্রম লাগে কিন্তু একটি গবেষণা প্রবন্ধে লাগে সাধারণত ৩–৪ মাস। বর্তমান সময়ে উন্নতি আর প্রয়োজনের অতিমাত্রায় প্রবর্তনের কারণে একটি বই শিক্ষার্থীদের প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় সেবা দেয়। অর্থাৎ একাডেমিক প্রভাবটি (impact) বৃহৎ। তাছাড়া, বই যেভাবে নীতিনির্ধারণের স্তরে এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব তৈরি করে সেভাবে সাধারণ গবেষণাপত্র সবসময় করে না। উদাহরণ স্বরূপ, একজন শিক্ষক ‘Bangladesh Public Sector Management: Concepts, Cases, Reforms’ নামে একটি বই লিখলেন, যা উচ্চশিক্ষার সিলেবাসে অনুমোদিত হলো। UGC সিদ্ধান্ত নিল—এটি ৪টি SCOPUS প্রবন্ধের সমমান। ফলে লেখক পূর্ প্রফেসর পদোন্নতিতে সুবিধা পাবেন, বই লেখার উৎসাহ বাড়বে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও উজ্জ্বল হবে।

• বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ‘Textbook Writing Fellowship’ঃ একজন শিক্ষককে এক বছর কম কোর্স লোড দিয়ে বই রচনার সুযোগ পেতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষককে এক বছর কম কোর্স লোড দেবে (যেমন- ১২ ক্রেডিটের বদলে ৩–৬ ক্রেডিট), যাতে তিনি বই লেখায় মনোযোগ দিতে পারেন। এটি বিশ্বমানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। যেমন, MIT-তে ‘ফ্যাকাল্টি রাইটিং ফেলোশিপ’, Oxford-এ ‘সাবাটিক্যাল রাইটিং ইয়ার’ এবং Delhi University তে ‘টিচার ফেলোশিপ স্কিম’ ইত্যাদি। বাংলাদেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করল যে প্রতি বছর পাঁচজন শিক্ষককে Textbook Fellowship দেওয়া হবে। এতে যে সুবিধা হবে তা হলো, প্রতি শিক্ষক এক বছর গবেষণা/বই লেখায় ফোকাস করবেন, কোর্স লোড কমানো হবে, ৩০–৫০ হাজার টাকা স্টাইপেন্ড দেওয়া হবে, গবেষণা সহকারী নিয়োগ করা যাবে।

• বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যৌথ ‘Textbook Consortium’ ঃ একই বিষয়ে পাঁচ–ছয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলাররা যৌথভাবে একটি টেক্সটবুক লিখতে পারবেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একা একটি বই লিখতে পারে— তবে ৫–৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ স্কলাররা বই লিখলে ওই বইটি বেশি মানসম্মত, বেশি পর্যালোচিত, জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, ভুল বা পক্ষপাতহীন এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত হবে। এই ধারণাটিই হলো Consortium Model। ধরা যাক, একটি Textbook Consortium ‘Principles of Marketing: Bangladesh Edition’ লিখবে। এই কনসার্টিয়ামে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হলো। যারা তাদের স্ব স্ব বিষয়ে এক্সপার্ট। যেমন- ঢাকা ইউনিভার্সিটি– মার্কেটিং এক্সপার্ট, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি– কনজিউমার বিহেভিয়ার, বিইউপি– ব্র্যান্ডিং অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি, চিটাগাং ইউনিভার্সিটি– ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং, বিএআইইউএসটি– ডিজিটাল মার্কেটিং অ্যান্ড কেস স্টাডিজ এবং এনএসইউ– মার্কেট রিসার্চ। তাদের দায়িত্ব বণ্টন হতে পারে DU: থিওরি অধ্যায়, CU: গ্লোবাল মার্কেটিং ট্রেন্ডস, BAIUST: বাংলাদেশ-ভিত্তিক ডিজিটাল মার্কেটিং কেস স্টাডিজ, NSU: রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিস এবং BUET/BUP: ডেটা মডেলিং । এর ফলে কনসোর্টিয়াম কর্তৃক যে বইটি হবে সেটা বহুমাত্রিক, রিভিউড, সমন্বিত, শিক্ষার্থী বান্ধব এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা-সমৃদ্ধ হবে। এটি বিদেশি Kotler-এর মতো বইয়ের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি উপযোগী হবে।

• পেশাদার একাডেমিক প্রকাশনা ব্যবস্থা গড়ে তোলাঃ যেখানে থাকবে—রিভিউ কমিটি, ডিজাইন টিম, ইনস্ট্রাকশনাল বিশেষজ্ঞ এবং স্টাইলগাইড। উন্নত দেশগুলোতে (যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া) টেক্সটবুক তৈরি করার সময় একটি পূর্ণ পেশাদার প্রকাশনা কাঠামো কাজ করে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার বই প্রকাশে এই কাঠামো প্রায় নেই। ফলে মানসম্মত টেক্সটবুক তৈরি হয় না। এই কাঠামোতে যে চারটি মূল উপাদান থাকে সেগুলো হলো- ১. রিভিউ কমিটি, ২. ডিজাইন টিম, ৩. ইনস্ট্রাকশনাল বিশেষজ্ঞ, ৪. স্টাইল গাইড।

১. রিভিউ কমিটি (Peer Review Committee) ঃ রিভিউ কমিটি হলো একটি বিশেষজ্ঞ দল যারা প্রকাশিতব্য বইটির বিষয়বস্তু, মান, বৈজ্ঞানিক যথার্থতা, অধ্যায়বিন্যাস, নির্ভরযোগ্যতা এবং শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগিতা এগুলো সব পরীক্ষা করে। এটি অনেকটা জার্নাল পেপারের মতো ‘peer review’ পদ্ধতি—কিন্তু টেক্সটবুকের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশে অনেক প্রকাশক পাণ্ডুলিপি রিভিউ না করেই বই প্রকাশ করে। ফলে ভুল, অসম্পূর্ণ, বিদেশি-প্রেক্ষাপট বর্জিত বই তৈরি হয়। যেমন- Oxford University Press (OUP) একটি বই প্রকাশ করার আগে ৩টি রিভিউ করে। Bangladesh-এ একটি টেক্সটবুক রিভিউয়ার থাকবে যেখানে একজন সিনিয়র প্রফেসর, দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একজন শিল্প/প্র্যাকটিশনার এবং একজন ভাষাগত সম্পাদক থাকতে পারে (এরা সবাই নির্বাচিত থাকবেন)।

২. ডিজাইন টিম (Academic Book Design & Production Team)ঃ এটা একটি পেশাদার টিম যারা বইয়ের লেআউট, গ্রাফিক্স, টেবিল, চার্ট, কভার ডিজাইন, টাইপসেটিং ইত্যাদি তৈরি করবেন। এরা অ্যাকাডেমিক বইয়ের জন্য বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করবেন যেমন, Typography, readability, accessibility। এই টিম বইয়ের অসম ফন্ট, দুর্বল চার্ট/ফিগার, অস্পষ্ট টেবিল, এলোমেলো লে-আউট যা শিক্ষার্থীদের জন্য বিরক্তিকর এবং অ-পেশাদার সেগুলি সংশোধন করবেন। মনে রাখতে হবে আধুনিক বই শুধুই লেখা নয় বরং এটি একটি প্রধান শিখন-উপকরণ (learning tool)। বিদেশী বইগুলিতে এই সব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লেখা বইগুলির জন্য এমন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন।

৩. ইনস্ট্রাকশনাল বিশেষজ্ঞ (Instructional Designers)ঃ এরা শিক্ষা-বিজ্ঞান, লার্নিং সাইকোলজি, এবং শিক্ষা–নকশা (Instructional Design)-এর বিশেষজ্ঞ। এদের কাজ হলো, কীভাবে একটি বই শিক্ষার্থীকে আরও ভালো শিখতে সাহায্য করবে সেটা নিশ্চিত করা। এই বিশেষজ্ঞরা অধ্যায়ের শুরুতে learning outcomes যুক্ত করে, বইয়ে কার্যকরী উদাহরণ ও অ্যাক্টিভিটি যোগ করে, অধ্যায়ের শেষে প্রশ্ন/MCQ/Case Study যোগ করে, Level–wise content adjust করে এবং জটিল বিষয় সহজভাবে ব্যাখ্যা করবেন। এই দল বইকে “শিক্ষণযোগ্য (teachable)” করে। উদাহরণ স্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে Chapter Summary, Review Questions, Case Study, Concept Boxes, Diagrams, এবং Learning Pathways থাকে-তেমন। এই উপাদানগুলো ইনস্ট্রাকশনাল ডিজাইনাররা ঠিক করেন। বাংলাদেশে এটি প্রায় নেই। যা-ও আছে সেটাও বিদেশী বইয়ের কপি।

৪. স্টাইল গাইড (Academic Style Guide)ঃ এটি একটি মানদণ্ডের বই বা নথি, যেখানে লেখার ধরন যেমন, ভাষা হবে কেমন (formal, academic), বাংলা/ইংরেজির বানানরীতি, উদাহরণ ব্যবহারের নিয়ম, উদ্ধৃতি (citation) নিয়ম, চার্ট কীভাবে হবে, ফিগারের স্ট্যান্ডার্ড কেমন হবে, ডেটা কীভাবে প্রদর্শিত হবে, অধ্যায় কাঠামো যেমনঃ learning outcomes, summary, review questions ইত্যাদি কি হবে সেগুলি নির্দিষ্ট করা থাকে। যেন একটি বই অন্য বই থেকে আলাদা, এলোমেলো বা অসম মানের না হয়। সব বই একই কাঠামো মেনে চললে বিশ্ববিদ্যালয়-স্থিতি বাড়ে। বিশ্বের সব বড় প্রকাশকের নিজস্ব স্টাইল গাইড থাকে। বাংলাদেশেও UGC একটি “Bangladesh Higher Education Textbook Style Guide” তৈরি করতে পারে।

দেশীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা একটি জাতীয় দায়িত্ব। বাংলাদেশি স্কলারদের অভাব নেই— তবে ঘাটতি আছে কাঠামোতে, প্রণোদনায়, নীতি-পরিবেশে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনে। যদি গবেষণাকে টেক্সটবুকে রূপান্তর করা যায়, বাংলাদেশ ‘জ্ঞান আমদানিকারক’ থেকে ‘জ্ঞান উৎপাদনকারী দেশ’ হয়ে উঠবে মনে অনুমেয়। আজকে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ের অভাব দূর করে উপরের নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা স্থাপত্যের কেন্দ্র তৈরি হতে পারে। যত দ্রুত এই বিষয়টি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার পাবে, তত দ্রুত দেশীয় স্কলারদের বই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জায়গা পাবে।

রেফারেন্স-

• Altbach, P. G. (2007). The imperialism of knowledge. Globalisation, Societies and Education।
• Altbach, P. G., & Knight, J. (2007). The internationalization of higher education: Motivations and realities. Journal of Studies in International Education।
• UNESCO. (2018). Textbooks and learning materials: Policies for quality and equity. Paris: UNESCO Publishing.
• UNESCO. (2021). Transforming Higher Education: Global Policy Framework.
• OECD. (2019). Education Policy Outlook 2019.
• World Bank. (2015). Higher education in Bangladesh: Status and strategic directions.
• Greetham, D. (2014). Textbook economics and higher education publishing. Oxford University Press.
• Ministry of Human Resource Development India. (2018).
• UGC India. (2016). Textbook writing and monograph schemes.
• Ministry of Education China. (2018). National Higher Education Textbook Policy.
• Malaysia Ministry of Higher Education. (2015). Malaysia Education Blueprint (Higher Education) 2015–2025.
• Sri Lanka Ministry of Higher Education. (2017). National Higher Education Policy.
• Pakistan Higher Education Commission (HEC). (2015–2022). Annual reports & textbook policy guidelines.
• Kwiek, M. (2018). The rise of research universities in emerging economies.
• Teaching for quality learning at university. McGraw-Hill.
• UGC Bangladesh. (2018–2023). Annual Reports and Statistical Releases.
• Ministry of Education, Bangladesh (2010). National Education Policy.

লেখক : Bangladesh Army International University of Science and Technology (BAIUST) এর রেজিস্ট্রার এবং ফ্যাকাল্টি।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন