টিকার মতোই জাতীয় কর্মসূচি হোক সাঁতার শিক্ষা
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ—নদী, খাল, বিল ও পুকুর আমাদের ভূগোল, জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ এই জলই প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য শিশুর জীবন। প্রতিবছর দেশে কয়েক হাজার শিশু ডুবে মারা যায়; তাদের অধিকাংশের বয়স চার থেকে দশ বছরের মধ্যে। এই মৃত্যুর পেছনে কোনো জটিল রোগ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়—শুধু একটি অদক্ষতা, সাঁতার না জানা। যে দেশে শিশুরা পানির এত কাছে বেড়ে ওঠে, সেখানে সাঁতার শিক্ষা বাধ্যতামূলক না হওয়াটা নিঃসন্দেহে নীতি-অবহেলার প্রতিফলন। সময় এসেছে এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে সাঁতার শিক্ষাকে টিকার মতোই একটি জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণার।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের সাইনাল গ্রামে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। দুপুরে দুই বোন—মিম (৭) ও মরিয়ম (৫)—খেলতে গিয়ে পাশের পুকুরে পড়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের উদ্ধার করা গেলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অসহায় মায়ের কান্নাভেজা কথা ছিল—“ওরা যদি একটু সাঁতার জানত, হয়তো বাঁচত।” এই একটি বাক্যই আমাদের নির্মম বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে—শিশুরা ডুবে মারা যায়, কারণ তারা বাঁচার উপায় জানে না।
এমন মর্মান্তিক ঘটনা দেশের নানা জায়গায় প্রায় প্রতিদিন ঘটে। তবে আশার কথা হলো—যেখানে শিশুদের সাঁতার শেখানো হয়েছে, সেখানে মৃত্যুহার কমে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রুয়ান্ডা ইউনিয়নে ব্র্যাকের উদ্যোগে চালু হওয়া একটি পাইলট প্রকল্পে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে যায়। অংশগ্রহণকারী শিশুরা শুধু ভেসে থাকা নয়, পানিতে পড়ে গেলে কীভাবে নিজেকে ও অন্যকে সাহায্য করা যায়, সেটিও শিখেছে।
এই উদাহরণ প্রমাণ করে—সাঁতার শিক্ষা কেবল বিনোদন নয়, এটি একপ্রকার জীবনরক্ষাকারী টিকা। টিকা যেমন শিশুকে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, সাঁতারও তেমনি পানির বিপদ থেকে আত্মরক্ষার ক্ষমতা দেয়।
বাংলাদেশে জাতীয় টিকা কর্মসূচি (EPI) একটি অনুকরণীয় সাফল্য। টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে, যা আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় অর্জন। এক সময় যেমন টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব ছিল, আজ তেমনি সাঁতার শেখার ক্ষেত্রেও রয়েছে অবহেলা, সুযোগের ঘাটতি ও সামাজিক উদাসীনতা। অথচ লক্ষ্য একটাই—শিশুর জীবন রক্ষা।
ইউনিসেফ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৪ থেকে ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়—যা মোট শিশুমৃত্যুর প্রায় ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই এক থেকে চার বছর বয়সী শিশু। এই মৃত্যুগুলো কোনো প্রাকৃতিক পরিণতি নয়—এগুলো প্রতিরোধযোগ্য। সামান্য পরিকল্পনা, সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই এই মৃত্যুহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
যেমনভাবে সরকার শিশুর জীবন বাঁচাতে টিকা কর্মসূচিকে সর্বজনীন করেছে, তেমনি একটি জাতীয় সাঁতার শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা গেলে শিশুর নিরাপত্তায় আসবে এক বিপ্লব। বর্তমানে কিছু এনজিও ও স্থানীয় উদ্যোগ সীমিত পরিসরে কাজ করছে, কিন্তু তা জাতীয় কাঠামোয় পৌঁছায়নি। স্কুলভিত্তিক টিকা কর্মসূচির মতোই যদি স্কুলভিত্তিক সাঁতার শিক্ষা চালু করা যায়, তবে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর থেকেই পরিবর্তনের সূচনা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বাংলাদেশ এই অঞ্চলে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। একইসঙ্গে ইউনিসেফের ২০২৪ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর মধ্যে ডুবে যাওয়ার হার এখনও বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে। অর্থাৎ, এই সংকট শুধু স্থানীয় নয়—এটি একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আমাদের মতো নদীপ্রধান দেশগুলো।
যেমনভাবে সরকার শিশুর জীবন বাঁচাতে টিকা কর্মসূচিকে সর্বজনীন করেছে, তেমনি একটি জাতীয় সাঁতার শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা গেলে শিশুর নিরাপত্তায় আসবে এক বিপ্লব। বর্তমানে কিছু এনজিও ও স্থানীয় উদ্যোগ সীমিত পরিসরে কাজ করছে, কিন্তু তা জাতীয় কাঠামোয় পৌঁছায়নি। স্কুলভিত্তিক টিকা কর্মসূচির মতোই যদি স্কুলভিত্তিক সাঁতার শিক্ষা চালু করা যায়, তবে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর থেকেই পরিবর্তনের সূচনা হবে।
প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি “নিরাপদ জলাশয়” নির্ধারণ করা যেতে পারে। সেখানে প্রশিক্ষিত সাঁতার শিক্ষক বা স্থানীয় যুব প্রশিক্ষকরা ধাপে ধাপে শিশুদের সাঁতার শেখাবেন। লক্ষ্য থাকবে—“প্রতি শিশুই সুরক্ষিত থাকবে।” নিরাপদ জলাশয় নির্ধারণ একটি চ্যালেঞ্জ হলেও বেসরকারি পুকুর বা জলাধারের মালিকদের সরকারি উদ্যোগে যুক্ত করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একযোগে কাজ করলে এটি মোটেও অসম্ভব নয়।
অভিভাবক ও সমাজকেও এই উদ্যোগে অংশ নিতে হবে। টিকাদানের মতোই সাঁতার শেখার গুরুত্ব নিয়ে গণসচেতনতা তৈরি করা জরুরি। টিকাকর্মীরা যেমন ঘরে ঘরে গিয়ে টিকার বার্তা পৌঁছে দেন, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে সাঁতার শেখানোর প্রয়োজনীয়তা, নিরাপদ জলাশয় ব্যবহারের নিয়ম ও দুর্ঘটনার সময় করণীয় বিষয়গুলো প্রচার করা যেতে পারে। টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মসজিদ-মন্দির, এমনকি গ্রামীণ ক্লাব—সবাই এই প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে।
এমন কর্মসূচির সুফল কেবল দুর্ঘটনা প্রতিরোধেই সীমাবদ্ধ নয়। সাঁতার শিশুদের শারীরিক বিকাশে সহায়ক, মানসিক দৃঢ়তা ও দলগত চেতনা গড়ে তোলে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। সাঁতার শেখা শিশুরা আরও সক্রিয়, সাহসী ও স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে—যা ভবিষ্যতের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সহায়ক। সুতরাং এটি কেবল জীবনরক্ষার শিক্ষা নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ ও আত্মনির্ভর করে তোলার শিক্ষা।
সাঁতার শিক্ষাকে জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুস্পষ্ট নীতি-পরিকল্পনা জরুরি— প্রথমত, বিদ্যালয় পর্যায়ে বাধ্যতামূলক পাঠক্রমে সাঁতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; যেমন শারীরিক শিক্ষা বা স্কাউটিং কার্যক্রম আছে।
দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে—উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, নিরাপদ অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে—প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ভাসমান বা স্থায়ী সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি।
চতুর্থত, অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে—সরকারি বাজেট, আন্তর্জাতিক সংস্থা, কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) ও স্থানীয় সরকার তহবিল থেকে অর্থায়ন সম্ভব।
আমরা প্রায়ই দেখি—কোনো দুর্ঘটনার পর সমাজে সাময়িক আলোচনার ঝড় ওঠে, কিন্তু স্থায়ী নীতি আসে না। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। টিকার মতোই যদি সাঁতার শিক্ষাকে “প্রতি শিশুর অধিকার” হিসেবে সংবিধানিক বা নীতিগত স্বীকৃতি দেওয়া যায়, তবে সেটি হবে এক বিশাল অগ্রগতি। একসময় যেমন “টিকা নাও, বাঁচাও প্রাণ” স্লোগান সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি আমরা বলতে পারব—“সাঁতার শেখাও, জীবন বাঁচাও।”
এই কর্মসূচি কেবল দুর্ঘটনা প্রতিরোধ নয়; এটি অর্থনীতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গেও জড়িত। একটি পরিবার যখন কোনো শিশুকে হারায়, তখন শুধু একটি প্রাণ নয়, একটি ভবিষ্যৎ, একটি স্বপ্নও নিভে যায়। জাতি হিসেবে প্রতি বছর আমরা যে বিপুল মানবসম্পদ হারাচ্ছি, তার অর্থনৈতিক মূল্যায়নও জরুরি, তাই সাঁতার শিক্ষা দেশের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীল জনশক্তিকে রক্ষা করবে
এখনই সময় সরকারকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়ার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতিটি ইউনিয়নে এমনভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে যেন কয়েক বছরের মধ্যেই “সাঁতার না জানা শিশু” শব্দটি বিরল হয়ে যায়।
টিকা কর্মসূচি আমাদের দেখিয়েছে—রাষ্ট্র চাইলে কীভাবে প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যেতে পারে। এবার প্রয়োজন সেই একই দৃঢ়তায় একটি নতুন প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করা—ডুবন্ত মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই। এই লড়াইয়ের অস্ত্র হলো জ্ঞান, সচেতনতা ও দক্ষতা—যা অর্জন সম্ভব সাঁতারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের নদীপ্রধান ভূগোলকে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদে পরিণত করার সময় এসেছে। যদি শিশুর টিকার মতোই সাঁতার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যায়, তবে শুধু মৃত্যুহার নয়, জলভিত্তিক বিপদও অনেকাংশে কমে যাবে।
তাই আজ আমাদের উচ্চারণ হোক—
“প্রতি শিশুর সুরক্ষা, প্রতি জীবনের মূল্য—টিকার মতোই জাতীয় কর্মসূচি হোক সাঁতার শিক্ষা।”
লেখক : কলেজ শিক্ষক।
[email protected]
এইচআর/এমএস