বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিল
খেলাপি ঋণের পাহাড় ডিঙিয়ে পুনরুজ্জীবনের পথ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক নজিরবিহীন এবং ঐতিহাসিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। যে আর্থিক ব্যবস্থাকে অর্থনীতির ধমনী বলা হয়, সেই খাতই এখন খেলাপি ঋণের বিশাল ভারে ন্যুব্জ। সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে, আর ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে ক্রমাগত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলো মোট যে ঋণ বিতরণ করেছে, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এখন সমস্যাগ্রস্ত। গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় ৩৫.৭৩ শতাংশ, অর্থাৎ সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা, পরিশোধ না হওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও ৩৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি পাওয়া—পরিস্থিতির গভীরতা ও দ্রুত অবনতির স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখ্য যে প্রকৃত পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ত আমরা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পারব।
এই খেলাপি ঋণের পাহাড় রাতারাতি তৈরি হয়নি। এর মূলে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং এক শ্রেণির ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে তৈরি হওয়া ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা; সেই অঙ্ক আজ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দিকে যেমন- আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে ব্যাংকের সম্পদ দুর্বল হয়েছে, তেমনই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং অভ্যন্তরীণ বাজার সঙ্কটের কারণে অনেক সৎ ও প্রকৃত ব্যবসায়ীও ব্যবসা চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন। এর পরিণতিতে শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চক্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ অপ্রত্যাবর্তী ঋণ (Non-Performing Loan বা NPL) কেবল ব্যাংকের স্থিতিশীলতাই নষ্ট করছে না, বরং নতুন ঋণ প্রবাহকে রুদ্ধ করে অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে।
এই চরম সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভিন্ন পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা কেবল 'শাস্তিমূলক' ব্যবস্থা আরোপ না করে, এখন পুনরুজ্জীবনের সুযোগ দিতে চাইছে। যেসব বড় গ্রাহক টাকা বিদেশে পাচার করেননি বা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হননি, বরং ব্যবসার প্রকৃত ব্যর্থতার শিকার, তাদের অনুরোধে ব্যবসাকে আবার দাঁড় করানোর জন্য ঋণ পুনঃতফসিল (Rescheduling) ও পুনর্গঠনের (Restructuring) এক নমনীয় নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপটি অবশ্যই প্রশংসনীয়, কারণ এটি প্রমাণ করে যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন শুধু লোকসানের হিসাব নয়, বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করছে।
এই নতুন উদ্যোগের মূল সুবিধাগুলো হলো: খেলাপি ঋণের একটি সামান্য অংশ (১ থেকে ২ শতাংশ) ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনঃতফসিল করার সুযোগ, কিস্তি পরিশোধ শুরুর আগে ২ বছরের গ্রেস পিরিয়ড বা অবকাশ এবং ঋণ শোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সময়সীমা। এই পরিবর্তনগুলো বহু পুরোনো গ্রাহকের জন্য 'নিয়মিত গ্রাহক' হিসেবে ফিরে আসার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলোকে আবার সচল করার একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। এই পুনর্গঠন নীতি কেবল ব্যাংকের ক্ষতি কমানোর কৌশল নয়, বরং এটি দেশের অর্থনীতিকে একটি স্বচ্ছ ও নতুন পথে ফেরানোর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা।
তবে, নীতির এই সুন্দর দিকটি বাস্তবতার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বলে মনে করি। প্রথম এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ডাউন পেমেন্টের শর্ত। যে ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন তারল্য সংকটে ভুগছেন, যার উৎপাদন বন্ধ এবং নগদ প্রবাহ প্রায় শূন্য, তার পক্ষে ১ বা ২ শতাংশ হারেও ডাউন পেমেন্ট দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে, যখন ঋণের পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকার ওপরে চলে যায়, তখন ১% ডাউন পেমেন্ট মানে কোটি কোটি টাকা, যা এই মুহূর্তে জোগাড় করা অযৌক্তিক। এই পরিস্থিতিতে নীতিকে কঠোর না রেখে মানবিক ও নমনীয় হতে হবে। ডাউন পেমেন্টের হারকে আরও কমিয়ে, উদাহরণস্বরূপ ০.২৫-০.৫ শতাংশের মতো ন্যূনতম স্তরে নামিয়ে আনা এবং তা এককালীন না করে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হলে, অনেক সৎ ও আন্তরিক ব্যবসায়ী এই সুবিধা নিতে পারবেন এবং সত্যিকারের পুনরুজ্জীবনের পথে হাঁটতে পারবেন।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি গ্রেস পিরিয়ড ও কিস্তির মেয়াদের ক্ষেত্রে। সব ব্যবসার নগদ প্রবাহ এবং বাজার পরিস্থিতি একরকম নয়। বড় ধরনের প্রকল্প-ভিত্তিক ব্যবসা বা রপ্তানিমুখী শিল্পের তুলনায় নির্মাণ বা স্থানীয় শিল্প-কারখানার ঘুরে দাঁড়াতে ভিন্ন সময় লাগতে পারে। তাই সব ব্যবসার জন্য একই গ্রেস পিরিয়ড (যেমন ২ বছর) নির্ধারণ করা যৌক্তিক নয়। নীতি প্রয়োগের সময় প্রতিটি ঋণ কেসকে আলাদাভাবে, তার টার্ন-অ্যারাউন্ড প্ল্যান (Turnaround Plan) বা ব্যবসার পুনর্গঠন পরিকল্পনা, ভবিষ্যতের নগদ প্রবাহের সম্ভাবনা এবং জামানতের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে কিস্তির মেয়াদ ও গ্রেস পিরিয়ড নির্ধারণ করা উচিত। ঋণ পরিশোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুযোগ দেওয়া হলেও, বিভিন্ন ধরনের ঋণকে একত্রে 'টার্ম লোন' হিসেবে গণ্য করার ফলে কিস্তির পরিমাণ যেন অতিরিক্ত বড় না হয়ে যায়, সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে। কিস্তির চাপ এমন হতে হবে যেন ঋণ শোধের পাশাপাশি ব্যবসা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত কার্যকরী মূলধন থাকে।
বাংলাদেশ এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নিয়ন্ত্রকদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে—আমরা ডিফল্টের ধারা অব্যাহত রাখব, নাকি পুনরুজ্জীবনের ইতিহাস তৈরি করব। সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার এই বিশাল বোঝা কেবল একটি আর্থিক অঙ্ক নয়; এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক আস্থার প্রতীক। যদি নীতিতে নমনীয়তা আনা হয়, শর্তগুলো মানবিক করা হয়, এবং স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধ মনিটরিং নিশ্চিত করা যায়, তবে এই বিশেষ ঋণ পুনঃতফসিল উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রবাহ, নতুন আত্মবিশ্বাস এবং একটি সুস্থ ব্যাংকিং সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে। সময় এসেছে, শুধু নীতির ঘোষণা নয়, বাস্তব, দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল প্রয়োগের। তবে পরিশেষে একথাও বলা জরুরি মনে করছি যে এই সুবিধা যেন স্বেচ্ছা খেলাপিরা কোনোভাবেই না পায়।
তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পুনরুজ্জীবনের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা। ঋণ কেবল পুনঃতফসিল করলেই হবে না; ব্যবসাকে আবার সচল করার জন্য প্রয়োজন সুদ মওকুফ এবং নতুন কার্যকরী মূলধনের (Working Capital) জোগান। কোনো ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে যে অতিরিক্ত ও অনাদায়ী সুদ জমা হতে থাকে, সেই সুদের বোঝা মওকুফ না করলে পুনর্গঠনের পরও ঋণের প্রকৃত বোঝা কমবে না। এই সুদ-জটিলতা দূর করা ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর একটি প্রধান উপায় হতে পারে। একই সঙ্গে, কাঁচামাল কেনা, বেতন দেওয়া বা উৎপাদন চালু করার জন্য নতুন কার্যকরী মূলধন সরবরাহ করা অপরিহার্য। এই নতুন মূলধন সরবরাহ ছাড়া পুনর্গঠন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবে তা সফল হবে না।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অর্থনৈতিক মন্দা বা বড় সংকটের সময় সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ব্যবসাকে বাঁচাতে উদার নীতি গ্রহণ করে, অনেক ক্ষেত্রে কোনো অগ্রিম পেমেন্ট ছাড়াই ঋণের পুনর্গঠন করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এই সঙ্কট থেকে বাঁচাতে হলে, নিয়ন্ত্রকদের আরও মানবিক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে একই সাথে, এই নীতির অপব্যবহার কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। অতীতে রাজনৈতিক প্রভাব বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ নেওয়ার বহু নজির রয়েছে। যদি মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল থাকে, ব্যবসা যাচাইয়ে ফাঁক থাকে, তবে এই নতুন নীতি কেবল ভিন্ন নামে 'খেলাপি সংস্কৃতি'-কেই আবার ফিরিয়ে আনবে।
অতএব, বাংলাদেশ এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নিয়ন্ত্রকদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে—আমরা ডিফল্টের ধারা অব্যাহত রাখব, নাকি পুনরুজ্জীবনের ইতিহাস তৈরি করব। সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার এই বিশাল বোঝা কেবল একটি আর্থিক অঙ্ক নয়; এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক আস্থার প্রতীক। যদি নীতিতে নমনীয়তা আনা হয়, শর্তগুলো মানবিক করা হয়, এবং স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধ মনিটরিং নিশ্চিত করা যায়, তবে এই বিশেষ ঋণ পুনঃতফসিল উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রবাহ, নতুন আত্মবিশ্বাস এবং একটি সুস্থ ব্যাংকিং সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে। সময় এসেছে, শুধু নীতির ঘোষণা নয়, বাস্তব, দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল প্রয়োগের। তবে পরিশেষে একথাও বলা জরুরি মনে করছি যে এই সুবিধা যেন স্বেচ্ছা খেলাপিরা কোনোভাবেই না পায়। তাহলে ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতির জন্য আবার বড় ক্ষতি হবে, উপকার হবার পরিবর্তে।
লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট। [email protected]
এইচআর/জেআইএম