ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নিশি, টম ও কয়েকটি কুকুরের গল্প

মহসীন হাবিব | প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

এক মায়ের নাম নিশি, তিন সন্তানের জননী; আরেক মায়ের নাম টম, সে ৮টি সদ্যোজাত শিশুর মা। লেখার ভাষা থেকেই বোঝা যাচ্ছে দুই মা এক গোত্রের না। মা নিশিকে ‘তিনি’ সম্বোধন করা গেলেও কুকুর মা টমকে তিনি বলা যায় না! নিশিকে জননী বলা গেলেও টম নামের কুকুর মাকে জননী বলার সুযোগ নাই। জননী শব্দ কেবল মানুষের জন্য সংরক্ষিত। তবে মা নিশি আর মা টমের যে নির্মম ঘটনা, তাতে সম্বোধন উল্টো হওয়া উচিত ছিল।

প্রকৃতি বাঁচার অধিকার দিয়েছে সমান। তা মানেন নাই মানব গোষ্ঠীর মা নিশি। তিনি তার সন্তানদের আদর যত্ন করেন তার স্বামী কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হাসানুর রহমানের সঙ্গে মিলে-মিশে। কিন্তু কুকুর মা টমের একার ঘাড়েই দায়িত্ব আটটি সন্তানকে দেখে রাখার। কুকুর টম থাকে ঈশ্বরদী উপজেলার ইউএনও সাহেবের বাসভবনের এক কোনায়। ইউএনও সাহেবের যত্নে থাকে না, তা পরিষ্কার। কারণ ইউএনও পরিবারের ওই কুকুরের উপর একটু নজর থাকলে কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তার স্ত্রী ভুলেও চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেতেন না।

এটাও বাংলাদেশের ৮টি কুকুর ছানাকে মেরে বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে হত্যা করেছেন তিন সন্তানের মা নিশি। কুকুরটির হৃদয় বিদারক কান্না স্থানীয় মানুষদের নজর কেড়েছে। তারা সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা জানতে পারে। দেশে মানবিক মানুষের যে ঘাটতি নেই তা প্রমাণ হয়েছে এ ঘটনায়। নিষ্পাপ কুকুর শিশুগুলোকে এভাবে হত্যার ঘটনা মেনে নিতে পারেনি দেশের লাখ লাখ মানুষ। মুহূর্তে সেটা ভাইরাল হয়ে যায় নেট দুনিয়ায় এবং অভিযুক্তের শাস্তি দাবি করতে থাকে। কানে পৌঁছে যায় বর্তমান সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তারের। তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে ফোন করে এ ঘটনা অমানবিক বলে অভিযোগ করেন। ধন্যবাদ উপদেষ্টা ফরিদা আক্তারকে উচ্চ আসনে বসে এই ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ায়। বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, এমন উঁচু স্থান থেকে ফোন করলেই কেবল তা অমানবিক বলে বিবেচিত হয়। 

ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে কুকুর বিষয়ক বিরল ঘটনার একটি হয়ে থাকবে অন্য আরেকটি কারণে। মা কুকুরটি বাচ্চাদের হত্যাকাণ্ডের পরদিন নিজ বাচ্চাদের জন্য কান্নাকাটি, ছুটাছুটি করে তারপর মঙ্গলবার ইউএনও’র অফিসের দোতলায় উঠে ইউএনওর দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ছবি পত্রিকান্তরে প্রকাশ পেয়েছে। বুঝতে বাকী থাকে না, সে মানুষের মতই বিচারের ফরিয়াদ জানিয়েছে। কেন মেরেছে নিশি নামের ওই নারী বাচ্চাগুলোকে? তিনি নাকি তার নিজে বাচ্চাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এ কাণ্ড করেছে। এটি একেবারেই অপব্যাখ্যা। কুকুর সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন, একই স্থানে বড় হয়ে উঠলে কুকুর নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, বরং নিরাপত্তাদানকারী সেবক হয়ে ওঠে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বের হৃদয় বিদারক কুকুরের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে নিশির অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিক অবস্থার দিকে ফিরে যাবো। প্রথম কাহিনীটি লিখে রেখে গেছেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন ক্যাথলিক যাজক স্টিফেন বরবন।  ওই সময় ফ্রান্সের লিও শহরের একটি দূর্গে অভিজাত একটি বাড়িতে বাস করতেন একজন অভিজাত ব্যক্তি। তার একটি কুকুর ছিল নাম গুইঁফোর্ট (ফরাসি ভাষায় উচ্চারণটি হয়তো অন্যরকম)। কিছুকাল আগেই তার স্ত্রী ছোট একটি সন্তান রেখে মারা গেছেন। ভদ্রলোকের নেশা ছিল শিকার করা। তিনি শিকারে বের হয়ে যেতেন প্রতিদিন একা এবং শিশুটির দেখাশোনার দায়িত্ব থাকতো গ্রে-হাউন্ড জাতের কুকুর গুইঁফোর্টের ওপর। একদিন সেই অভিজাত ব্যক্তি শিকার থেকে ফিরে দেখতে পান তার শিশুটি ঘরের ছোট্ট খাটে নেই। কুকুর গুইঁফোর্টের মুখ ভর্তি রক্ত। ঘরের মেঝেতে রক্তের মাখামাখি। কুকুরটি তারদিকে ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করছে। তিনি বুঝে গেলেন, তার সন্তানকে কুকুরটি খেয়ে ফেলেছে। তিনি কোমর থেকে তলোয়াড় বের করে কুপিয়ে গুইফোর্টকে মেরে ফেললেন। ঠিক পরক্ষণেই খাটের নিচ থেকে তার শিশু সন্তানটি কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিচু হয়ে দেখলেন, একটি বড় অজগর সাপ মরে পড়ে আছে, সাপের মাথাটি ছিন্নভিন্ন। সাপের পাশেই তার শিশুটি প্রায় অক্ষত শুয়ে আছে। তার বুঝতে বাকি থাকল না ঘটনা কী ঘটেছে।

ফ্রান্সের সেই অভিজাত ব্যক্তি ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। তিনি বাড়ির দরোজার সামনেই কুকুরটিকে কবর দেন এবং তার প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আশেপাশের কৃষকরা এসে প্রভুর বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রভুর হাতে নিহত হওয়া কুকুরের সমাধিতে একটি মন্দির গড়ে তোলে। কয়েক শ’ বছর ধরে মানুষ সেখানে মহানুভবতার প্রার্থনা করতে সমবেত হতো। আজও ফ্রান্সের লিও শহরের কাছে সেন্ট গুইঁফোর্ট বা সাধু গুইঁফোর্ট নামের মন্দিরটি টিকে আছে। আজও কেউ কেউ সেখানে ভাঙা হৃদয় নিয়ে প্রার্থনা করতে যান।

আমরা অনেকে মানব সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়ে উঠতে পারি না। বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটে কুকুরকে যেভাবে ট্রিট করা হয় তার সঙ্গে নিশি নামের নারীর কাণ্ডটির পার্থক্য অনেক। নিশির এ কাণ্ড যাদেরকে ব্যথিত করেছে, তারা নিজেদের মানুষ হিসাবে দাবি করতে পারে।

১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালির টাসকানি শহরের একজন কারখানার শ্রমিক কার্লো সোরিয়ানি কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় দেখতে পান, রাস্তার পাশের একটি মরা খালে ছোট্ট একটি আহত কুকুরের বাচ্চা। তিনি কার কুকুর তা না ভেবেই সেটিকে বাড়িতে নিয়ে যান। কার্লো এবং তার স্ত্রী দুজনে মিলে কুকুরের বাচ্চাটিকে সুস্থ করে তোলেন। নাম রাখেন ফিডো। এরপর প্রতিদিন ইটের ভাটায় কাজে যাওয়ার সময় ফিডো তার সঙ্গে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যায়। আবার সন্ধ্যাবেলার কার্লোর ফেরার সময় হলে সে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে অপেক্ষা করে। কার্লো বাস থেকে নামলে সে আনন্দে লাফাতে থাকে। পশু বা মানুষ কারোই সুখ বোধকরি বেশিদিন সয় না। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে মিত্র বাহিনী ইতালির ছোট্ট শহর বোর্গো সান লরেনজোতে কর্লোর কর্মস্থল ইটের ভাটায় বোমা ফেলে। ওদের ভাটা আমাদের দেশের মত খোলা নয়, ফ্যাক্টরির মত। কার্লো আরো অনেক সহকর্মীর সঙ্গে নিহত হন। সেদিনও ফিডো গিয়ে অপেক্ষা করলো তার প্রভুর জন্য। কিন্তু কার্লো ফিরলেন না। কয়েক দিন না খেয়ে অপেক্ষা করলো। তারপর বাড়ি ফিরে গেল। পরবর্তী ১৪ বছর ফিডোর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ঝড়, শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন সে বাসস্ট্যান্ডে এসে বাতাসে ঘ্রাণ নিতো, প্রভুর জন্য অপেক্ষা করতো।

টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর উয়েনো’র কুকুরের নাম ছিল হাচিকো। প্রফেসর সংক্ষেপে ডাকতেন হাচি। প্রতিদিন হাচি প্রফেসরের সঙ্গে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত আসতো। ট্রেন ছেড়ে গেলে বাড়ি ফিরতো। আবার সন্ধ্যাবেলা প্রফেসরের আসার সময় হলে দেখা যেতো হাচিকো স্টেশনে উপস্থিত। ১৯৩৫ সালে ৫৩ বছর বয়সে কর্মস্থলেই প্রফেসর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। কিন্তু থেমে থাকেনি হাচিকো’র অপেক্ষা করা। শিবুয়া নামক স্টেশনে প্রতিদিন এসে ঘুরঘুর করে। ট্রেন আসতে দেখলে লেজ নাড়ে। সবাই নামলে একজন-একজন করে দেখতে থাকে। তখনকার জাপান বর্তমানের মত এতটা সভ্য দেশ ছিল না। মানুষজন লাথি দিতো, স্টেশন মাস্টার বিরক্ত হয়ে তাড়িয়ে দিতেন। ইতোমধ্যে জাপানের একজন সাংবাদিক হাচি’র ঘটনাটি পত্রিকায় ছবিসহ প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে হাচি জাপানে হিরোতে পরিণত হয়। আমৃত্যু প্রতিদিন যখন হাচি স্টেশনে উপস্থিত হতো। তখন মানুষজন আসতো তাকে দেখতে। এ ঘটনায় অনুপ্রাণিত হলে জাপান হেলেন কেলারকে দুটি কুকুর উপহার দেয়। ওই স্টেশনে এখনও হাচির একটি ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে। জাপানে সে ভালোবাসার প্রতীক হিসাবে এখনও বিবেচিত।

আমরা অনেকে মানব সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়ে উঠতে পারি না। বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটে কুকুরকে যেভাবে ট্রিট করা হয় তার সঙ্গে নিশি নামের নারীর কাণ্ডটির পার্থক্য অনেক। নিশির এ কাণ্ড যাদেরকে ব্যথিত করেছে, তারা নিজেদের মানুষ হিসাবে দাবি করতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি আছে, “The greatness of a nation can be judged by the way its animals are treated.”

নিশির বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪২৯ ধারায় মামলা হয়েছ। ওই ধারায় বলা আছে, ‘যদি কেহ প্রাণী হত্যা করে এবং যে কোনো প্রাণীর মূল্য  ৫০ টাকা বা তার বেশি হয় তাহলে ওই ব্যক্তির পাঁচ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

এ আইন নিয়ে যতই জটিলতা থাকুক, নিশির কাণ্ডটি একটি লোমহর্ষক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। আমি কথায় কথায় ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শব্দটি ব্যবহার করিনা। নিশিকান্ড সত্যিকার অর্থে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি রাখে। এতে মানুষের মধ্যে পশুর প্রতি নির্মমতা কমবে।

লেখক: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম