ইউরোপের ফ্ল্যাশফিকশন
ঝলকগল্পের ঝলক বাংলাদেশে
গল্প কখনো বিস্তৃত নদীর মতো, আবার কখনো বিজলীর ঝলকের মতো মুহূর্তে আঘাত হানে। ঝলকগল্প ঠিক এমনই।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে চাই, ফ্ল্যাশফিকশন আর অণুগল্প এক নয়। ফ্ল্যাশফিকশন হচ্ছে অতি-ক্ষুদ্র গল্প, সাধারণত ৫০-৩০০ শব্দ। কখনো ৫০০-৭০০ শব্দ পর্যন্তও গড়ায়। একটিমাত্র মুহূর্ত, টুইস্ট বা দৃশ্যকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে ধরাই এর লক্ষ। ‘ফ্ল্যাশ’ শব্দের মতোই এটি ঝটপট আঘাত করে। এটি বৈদ্যতিকবক্সের স্পার্কিং বা বিস্ফোরণের মতো ছোট, কিন্তু প্রভাব গভীর। অনলাইনে বিশ্বের নানা দেশে এ ধারাটি এখন বেশ জনপ্রিয়।
অন্যদিকে অণুগল্প হলো ছোটগল্পের আরও ক্ষুদ্রতর রূপ। সাধারণত ৩০০-১০০০ শব্দের মধ্যে থাকে। ১৫০০ শব্দ হতে পারে কি না―মতভেদ আছে। এতে চরিত্র, আবহ, ঘটনাপ্রবাহ সবই থাকে, তবে খুব সংক্ষিপ্ত ও পরিমিতভাবে।
মূল পার্থক্য হলো ‘ফ্ল্যাশফিকশন মুহূর্ত ধরে; অণুগল্প পুরো গল্পটা ধরে।’
ফ্ল্যাশফিকশন বেশি দ্রুত, ধারালো ও এক-মুহূর্তের; অণুগল্প তুলনায় বিস্তৃত, বর্ণনাধর্মী ও নির্মাণমুখী।
সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়ন থেকে উপলব্ধি করি Kafka কিংবা বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ লেখক বনফুল যে ধরনের ছোটোগল্প লিখেছেন, তা কখনো ফ্ল্যাশফিকশনের পরিসরে, আবার কখনো অণুগল্পের কাছাকাছি চলে আসে।
বিশ্বসাহিত্যে Microfiction নামে যে ক্যাটাগরি আছে, সেটিকে বাংলায় আমরা অণুগল্প বলেই জানি। আবার কেউ কেউ ফ্ল্যাশফিকশনকেও অণুগল্প বলে চালিয়েছেন। বাংলা অণুগল্পের শব্দসংখ্যা ৩০ থেকে ১৫০ হওয়া উচিত বলেও মনে করেন অনেকে। তবে Minimalism হলো এমন এক গদ্যশৈলী, যা অণুগল্প ও ফ্ল্যাশফিকশন, দুটোতেই প্রভাব ফেলে, সমকালীন গল্প-উপন্যাসেও। শব্দ বা বাক্যের বাহুল্য কাটছাঁট করে গদ্যকে পরিশীলিত করার চলমান বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে আমাদের সাহিত্যে ‘পরিমিত’ শব্দটার মিল আছে; বাহুল্য বর্জনের যে-কথা প্রচলিত আছে, তার সমার্থক শব্দ-ই বলা চলে।
“ফ্ল্যাশফিকশন সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখাও। গত সাত আট বছর ধরে ব্রিটেনে ‘ফ্ল্যাশফিকশন ডে’ পালিত হয়ে আসছে।
নিউজিল্যান্ডেও ‘জাতীয় ফ্ল্যাশগল্প দিবস’ পালিত হয়।
ফ্ল্যাশফিকশন লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেবিস। ছোটগল্পের পাশাপাশি ফ্ল্যাশফিকশন লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আর এক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার।
বার্টলার ও ডেভিসের অনেক আগে ছোটগল্পের পাশাপাশি ফ্ল্যাশফিকশন লিখে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা।
বিখ্যাত ফ্ল্যাশফিকশন লেখকদের মধ্যে রয়েছে নীল গাইমান, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং মার্গারেট অ্যাটউড, কাফকা, আর্থার সি ক্লার্ক, নাগিব মাহফুজ, ডোনাল্ড বার্থলেম, অ্যাব্রুস বিয়ার্স প্রমুখ। এই জগতে ছোটগল্পের অনেক সংগ্রহ রয়েছে এবং রয়েছে অনলাইন প্রকাশনাও।
মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মাত্র ৯০০ শব্দে ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ ফ্ল্যাশফিকশনটি লেখেন। আবার তিনি মাত্র ৬ শব্দে একটি অনুগল্প লেখেন : For sale: baby shoes, never worn আর চীনা সাহিত্যে ফ্ল্যাশফিকশনের শব্দসীমা ‘স্মোক লং’ হিসেবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একটা সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে, তার মাঝেই ক্ষুদে গল্প শেষ করতে হবে।
আধুনিক বাংলাসাহিত্যে ফ্ল্যাশফিকশনের ধারায় রবীন্দ্র-নজরুল-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-বনফুলসহ প্রতিষ্ঠিত অনেক গল্পকারই গল্প লিখেছেন। সম্প্রতি বাংলা ভাষায় অনেকেই ফ্ল্যাশফিকশন লিখছেন। পত্র-পত্রিকায় স্থানাভাবে যে সব অতি ছোট আকারের গল্প প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোর অনেক গল্পই ফ্ল্যাশফিকশনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, কোনো কোনোটা আবার অনুগল্পও।”
‘ফ্ল্যাশ’ ইংরেজি শব্দটির বাংলা হলো ঝলক আর ‘ঝলক’ মানে আলোকের বা বিদ্যুতের ক্ষণিকের দ্যুতি, দীপ্তি, অথবা কোনো কিছুর একটি সংক্ষিপ্ত বা আংশিক দৃশ্য বা আভাস। তাই প্রাবন্ধিক আবু সাঈদ কামালের ‘ফ্ল্যাশফিকশন’ শব্দটির অনুবাদ ‘ঝলকগল্প’ এবং উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি যথার্থ বলে মনে করি। এই নিবন্ধে শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে।
সাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নানা ধারা, নানা মতবাদ, নানা বিষয়-আশয় এসেছে সৃজনশীল কথাশিল্পে। প্রত্যেক বিষয় নিয়েই তর্ক-বিতর্ক আছে, ভালো-মন্দের বিচারে কোনো ধারাই কেবল প্রশংসাধন্য বলা যায় না; সমালোচনারও ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু কোনো ধারাই উচ্ছেদ হয়ে যায়নি; আপন মহিমায় আলো ছড়াচ্ছে। শব্দসংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঝলকগল্পে মূল দীপ্তিচ্ছটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় বলে মনে হয়েছে।
ঝলকের মতো গল্পের আয়ু সংক্ষিপ্ত হতে পারে, কিন্তু প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। পাঠকের অনুভূতিতে যদি এক মুহূর্তের বিদ্যুৎ-স্পন্দনও জাগাতে পারে, তাহলেই ঝলকগল্প তার লক্ষ্য অর্জন করবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, বাংলা একাডেমি ফেলো, সম্পাদক, শব্দঘর ।
এইচআর/জেআইএম