সুখের নদী, দুঃখের ভেলা
একটা আলোচনা সভায় যাবার আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে পারলাম না। বক্তা তাঁর লেখার মাধ্যমে আমার সুপরিচিত। বাংলাদেশের ওপর তিনি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী বই ও আন্তর্জাতিক মানের প্রবন্ধ লিখেছেন। যাই হোক, মনে মনে যাকে আঁচ করলাম সেমিনার কক্ষে ঢুকে বাস্তবে দেখি সেই ব্যক্তিটিই একটা চেয়ারে বসে আছেন।
দুই.
আমি ডেভিড লুইসের কথা বলছি। তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিকসের (এলএসই) সোশ্যাল পলিসি বিভাগে কর্মরত এবং সেখানকার সোশ্যাল ও উন্নয়ন বিষয়ক অধ্যাপক। বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রধান কারণ বাংলাদেশের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের বুদ্ধি-বৃত্তিক সম্পৃক্ততা। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা যে, তিনি বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং এখনও করছেন। তিনি যে ‘বাংলাদেশ-আসক্ত’ তার বড় প্রমাণ হিসাবে বাংলাদেশের ওপর লেখা তাঁর দু’একটা বইয়ের উদাহরণ টানা যেতে পারে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দু’একটাতে চোখ বোলাবার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯১ সালে তার অভিসন্ধর্ভ ছাপে এবং তারও আগে, ২০১১ সালে, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি একটা বই বের করে। ওই বইতে পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে বাংলাদেশের রক্তাক্ত এবং বেদনা-বিদুর বিদায়, স্বাধীনোত্তরকালে প্রায় বিধ্বস্ত আর্থসামাজিক কাঠামোর মধ্যেও সংসদীয় চর্চা লালন, গেল কয়েক দশক ধরে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ের বিবেকী বিশ্লেষণ স্থান পায়। লুইস যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশ নামক দেশটি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ-খাওয়া, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা স্থাপনে সরকার ও সুশীল সমাজের ভ‚মিকা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিপৎসংকুল অতীত ও বহমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে। এমনি করে বইটিতে বাংলাদেশ যে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র নয় সে বিষয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তি দাঁড় করাতে পেরেছেন ডেভিড লুইস।
তিন.
আমার একান্ত ব্যক্তিগত উৎসাহ সাম্প্রতিক প্রকাশিত তাঁর অন্য একটা বইতে। ডেভিড লুইস ও আবুল হোসেন প্রকাশ করেন যে একসময় গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো নিয়ে প্রচুর গবেষণা হতো। আজকাল হয় না বা হয়ে থাকলেও তেমন প্রচার পায় না। তবে এই ‘করুণ’ অবস্থানের বিপরীতে ক্ষমতা কাঠামো নিয়ে ডেভিড ও সহলেখকের বিশ্লেষণ অতি তৃষ্ণায় এক ফোঁটা পানির মতো। এই বইতে ব্যবহৃত উপাত্ত বা র্পযবক্ষেণ এসেছে বৃহত্তর ফরিদপুরে নির্বাচিত কিছু এলাকায় পুর্নির্ধারণের ভিত্তিতে। অর্থাৎ লেখকদ্বয় খুব সম্ভবত বেশ ক’বার জায়গাগুলো পরিদর্শন শেষে তুলনামূলক একটা চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস নেন। প্রসঙ্গত, বলার বোধ হয় অপক্ষো রাখে না যে, যেহেতু ডেভিড লুইস প্রখ্যাত একজন নৃ-বিজ্ঞানী এবং তাঁর সহ-লেখকও সমাজবিজ্ঞানী, তাঁরা পুরো গবেষণা নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা কর্মকৌশল গ্রহণ করে উপসংহারে পৌঁছান।
সে যাই হোক, তারা যে ক্ষমতা কাঠামো নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন এটাই বড় কথা। ওয়ার্লড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট (২০১৭) মনে করে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামো কীভাবে কাজ করে এবং এই কাঠামোকে কীভাবে দেখা হয় সে বিষয়টি এখনও মূলস্রোতের উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নরে ক্ষেত্রে প্রধান আকর্ষণ। ক্ষমতার ক্ষেত্রে অসমতা অথবা ভারসাম্যহীনতা একটা বিশেষ শ্রেণির বর্জন ঘটিয়ে সমতা অর্জনে বাধা দান করে। এর ফলে ন্যায়সংগত প্রবৃদ্ধির যাত্রা অকার্যকর ও সীমিত হয়ে পড়ে।
চার.
লেখকদ্বয়ের আগেকার লেখাতে বৃহত্তর ফরিদপুরে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামো ধীরে ধীরে বদলে যাবার চিত্র দেখা গেছে। সনাতনী গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো যেন একটু একটু করে ভাঙছে, যেমনি ভাঙছে নদীর পার। মহাজন, ভূস্বামীর জায়গায় ঋণ নিয়ে এসেছে এনজিও, স্থানীয় সরকারে মহিলাদের আনাগোনা শুরু। যদিও সেটা বড় মাপের নয় কিন্তু নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ‘স্পেস’ জেগে উঠছে যার মাধ্যমে কিছু দরিদ্র পুরুষ ও মহিলা অবস্থার পরিবর্তন করতে পেরেছে বলে লেখকদ্বয় মনে করেন।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রে থাকবে এটাই স্বাভাবিক তবে তা যেন বহুমুখিতা, অন্তর্ভুক্তি ও সুশীল সমাজের কর্মকাণ্ডের বিনিময়ে না হয়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন-মানের উন্নতি ঘটিয়েছে তবে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি’ এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সরকার এমন যুক্তি দেখাতেই পারে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা হচ্ছে ততক্ষণ টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।
উদীয়মান এই সুযোগগুলোর পেছনে যেসমস্ত উপাদান কাজ করেছে তার মধ্যে আছে স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন, কিছু কিছু উদীয়মান প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ড এবং সুশীল সমাজের ইতিবাচক ভূমিকা। কখনও কখনও এ উপাদানগুলো দরিদ্র ও অ-দরিদ্র উভয়ের জন্য ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে তাঁদের ধারণা। যদিও পরিস্থিতির উন্নতিতে তাঁরা আশাবাদী কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোতে অতি সাম্প্রতিক পরিবর্তন যেভাবে বা যে মাত্রায় ঘটে চলেছে তাতে অতীতের মতো অশাবাদী হবার অবকাশ বেশ কম দেয় বলে তাদের ধারণা।
গবেষণায় দেখা গেছে, অবিরাম চলমানতা ও পরিবর্তনের নিদর্শন। ২০০০ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে অর্থনৈতিক গতিশীলতা তীব্রতর হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে অনেক মানুষ উন্নততর জীবিকা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। নতুন নতুন অর্থনৈতিক সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্যুনিটিগুলো আগের চেয়ে ভৌগোলিক ও সামাজিকভাবে অধিকতর সম্পৃক্ত হয়েছে এবং যোগাযোগ পাবার ক্ষত্রেে খানাগুলো পছন্দের পরিধি পেয়েছে। স্থানীয়, জাতীয় ও বহুজাতীয় যোগাযোগ ও অভিবাসনের সুযোগ বৃদ্ধি ঘটেছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে মহিলাদের রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ধীরে হলেও প্রাম্ভিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
পুরোনো ক্ষমতা কাঠামোয় উপদানগুলো এখনও বিরাজমান যার মধ্যে আছে পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক, এলিট ক্ল্যান পলিটিকস এবং পিতৃতান্ত্রিক আচরণ। কিন্তু আপাতদৃষ্টে প্রতীয়মান যে, এগুলো ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। ইদানিংকালে প্যাট্রনের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে যার ফলে কম ক্ষমতাশালী দরিদ্র শ্রেণির সুবিধা বৃদ্ধি ঘটেছে। ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ভ‚মিকার অস্পষ্টতা বহমান যার ফলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা জটিল জাল তৈরি হয়েছে। এতে করে অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তন প্রান্তিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজ কী অবস্থা? তাঁরা মনে করেন যে, দিন দিন সুশীল সমাজের ‘স্পেস’ সংকুচিত হয়ে এসেছে। অনুমান করা হচ্ছে, বিশেষত নিকট অতীতে জমিজমা, স্থানীয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুশীল সম্পৃক্ততা নিয়ে বাতিঘর বলে খ্যাত যে সমস্ত র্যাডিকেল এনজিও কাজ করছে সেগুলোর সূর্য অস্তায়মান। এতে করে নিকট অতীতে ‘উইন উইন’ কোয়ালিশনের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল সেই সম্ভাবনা বিলুপ্তির পথে। এখন স্থানীয় ব্যবস্থা সংগঠন, স্কুল কমিটি এবং অন্যান্য সুশীল সমাজ গোষ্ঠীকে আগের চেয়ে অধিকতর রাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক স্বার্থ এদের চালিকা শক্তি। এর ফলে যদিও সুযোগ মানুষের আগের চেয়ে বেশি, দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে একটা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন আগের মতো নেই অর্থাৎ, বহুদলীয় মতের চেয়ে একদলীয় মতের প্রাধান্য। তবে হ্যাঁ, এখন যে প্রতিযোগিতা আছে তা একই দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে।
একদিকে জীবিকার ক্ষেত্রে অধিকতর শক্ত অবস্থান অন্যদিকে ক্রমহ্রাসমান গণতান্ত্রিক ‘স্পেস’ দরিদ্র পুরুষ ও মহিলার ওপর মিশ্র প্রভাব ফেলছে। সন্দেহ নেই যে সরকার বিভিন্ন সেবা নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছে এবং জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে ভাল হয়েছে, অর্থনৈতিক ও কিছুটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশেষত যুব শ্রেণিকে আশাবাদী করে তোলা।
বিশেষত মহিলাদের জন্য অর্থনৈতিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রান্তিক উন্নতি লক্ষ করা যায়। এর অর্থ এই নয় যে, বাধা-বিপত্তিগুলো উঠে গেছে বরং এটা বোধ করি বলা চলে যে এখনও অন্তহীন বাধা মহিলাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরতে উদ্যত। একটা সুখবর এই যে স্থানীয় পর্যায়ে সুশীল সমাজ সাংবাদিক এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে স্বচ্ছতার অব্যাহত দাবি পরিস্থিতিকে আগের চেয়ে ভাল রেখেছে। যাই হোক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নতির চিত্র (যেমন- আয়বর্ধন) বিনাব্যয়ে আসে নি- বস্তুত ‘রাজনৈতিক বেদনার’ বিনিময়ে অর্থনৈতিক ‘উপশম’ ঘটেছে।
অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামো আগের চেয়ে ভঙ্গুর, নাজুক ও অপেক্ষাকৃত কম স্থিতিস্থাপক হয়ে উঠছে। যেসমস্ত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমাজের অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতাশীলদের সাথে যোগাযোগ করতো বা করে থাকে সে সমস্ত নেটওয়ার্কে সরকারী দলীয়দের আধিপত্য বিস্তার পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করত: আক্রমত্যায় অবদান রাখছে।
মোট কথা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রে থাকবে এটাই স্বাভাবিক তবে তা যেন বহুমুখিতা, অন্তর্ভুক্তি ও সুশীল সমাজের কর্মকাণ্ডের বিনিময়ে না হয়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন-মানের উন্নতি ঘটিয়েছে তবে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি’ এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সরকার এমন যুক্তি দেখাতেই পারে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা হচ্ছে ততক্ষণ টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। যদি সমস্যাগুলো আশু চিহ্নিত করে সমাধান না দেওয়া যায় তবে প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। সুখের নদীতে দুঃখের ভালো।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম