ডিসেম্বর: ক্ষোভ-ক্রোধ-প্রতিবাদে বাঙালির অনিঃশেষ কবিতা
আব্দুল মালিক ফারুক, আমার প্রিয় এক অগ্রজ। ফারুক ভাইয়ের কৈশোর-তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে তাকে হাতছানি দিয়েছিল এক যুগান্তকারী কাল। প্রচণ্ড ডামাডোলের মাঝেই সেই তারুণ্যবেলায় তিনি চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বয়সটা তখন কতই বা—দশম শ্রেণিতে পড়তেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। বয়স ষোলো কিংবা সতেরো। কেন-ই বা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি? শুধু দেশকে স্বাধীন করতে ছুটে গিয়েছিলেন যুদ্ধে। তখন চারদিকে ছুটছে মানুষ—দিগ্বিদিক। তরুণরা ছুটছে, ভারতমুখী তাদের যাত্রা। কৃষক-মজুর-ছাত্র-রাজনৈতিক কর্মী—সবাই অস্ত্র হাতে নিচ্ছে। মৃত্যুর কোনো ভয় নেই; সাপ-বিচ্ছু-জানোয়ার—সবকিছুই ছিল যেন পাক-জানোয়ারদের তুলনায় নগণ্য। সেই ভয়ংকর সময়কে তারা তুচ্ছ ভেবেছে, জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধের দামামায়।
ফারুক ভাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন তিনি। তিনি ভালো গল্প লিখতেন, কথাসাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর ‘যুদ্ধযাত্রা একাত্তর’ বইটি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার চোখে যুদ্ধদিনের হিরন্ময় ইতিহাস। যখনই দেশে যেতাম, দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ হতো। বার কয়েক তিনি বলেছেন আমাদের এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জামালের কথা, তাঁর মা ও একমাত্র কন্যা স্বাধীন সুন্দরীর বুকফাটা আর্তনাদের কথা। আমারও কথা হয়েছে তাদের সাথে, শুনেছি তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর শোকের আর্তনাদ।স্বাধীন সুন্দরী ভালো আছেন; কিন্তু খেদ—স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরও তাঁর পিতা এখনও পাননি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
২) “মেইল ট্রেন একটানা ছুটে চলেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেণির একটি কক্ষে আমি একা। সিলেট থেকে রংপুরে যাচ্ছি। মাঝখানে ট্রেন বদলির কারণে ঢাকায় কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি—”
অথবা
“মেঘের আকারকে কল্পনার আঙ্গিকে সহজেই যে কোনো কিছুর সঙ্গে এক করে দেখা যায়। খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে সার বেঁধে হেঁটে যাওয়া গ্রামগুলো ভীষণ ভালো লাগছিল। এমন দৃশ্য দেখি নি গত এক বছর। এই একটি বছরের মতো আমার কেটেছে সেনা প্রশিক্ষণে পশ্চিম পাকিস্তানে।”
—‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ বইয়ের শুরুটা এরকমই, যা প্রকাশিত হয়েছে ত্রিশ বছরেরও আগে।
মেজর নাসির উদ্দিনের এই বইটি প্রথমে মনে হয়েছিল কোনো গল্প কিংবা উপন্যাস। উপরের বাক্যগুলোতে তা-ই প্রতীয়মান হয় প্রথম পাঠে। কিন্তু যতই এগোতে থাকি, ততই বিস্ময় লাগে। শুধুই যুদ্ধ আর পাকবাহিনীর বাঙালি নিধনের নৃশংসতা দিয়েই তিনি আটকে থাকেননি; তুলে এনেছেন সেই সময়ের পাকিস্তানি সেনা সংস্কৃতিরও এক অদ্ভুত মূল্যবোধ(!), যা আজ পঞ্চান্ন বছর পরও হয়তো পুরোপুরি বদলায়নি।
অনেক লোম জাগানিয়া ঘটনার মাঝে পাকিস্তানিদের বৈষম্য-সাম্প্রদায়িকতা ও নৃশংসতার দুটি চিত্র এই বই থেকে তুলে ধরছি—
ক) প্রশিক্ষণ শিবিরে দুজন বাঙালি একত্র হয়ে বাংলায় কথা বললে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আপত্তি উঠত। তখন শৃঙ্খলার কথা বলা হতো—একাডেমির আলাপের ভাষা হবে শুধুই ইংরেজি। অথচ তারা নিজেদের মাঝে উর্দু, পাঞ্জাবি, পশতু, এমনকি সিন্ধি ভাষায় কথা বলত। মাঝে মাঝে প্রশিক্ষকেরা উর্দু ব্যবহার করেই পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন। কিন্তু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঢাল ব্যবহার করে সেনা শিবিরেও বলা হতো—উর্দুই হলো একমাত্র মুসলমানের ভাষা। এই ভাষা ছাড়া মুসলমানত্ব নেই।
তাই বিজয় দিবস শুধু উৎসব নয়—এ দিন প্রতিবাদেরও পবিত্র উচ্চারণ। যে চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমাদের পূর্বপ্রজন্ম যুদ্ধ করেছেন, যে মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এই দেশ তৈরি করেছেন—সেই চেতনা এক অনিঃশেষ কবিতা। সেই কবিতাই বাঙালিকে শেখায় আগামীর গান গাইতে—সংহতির, মানবিকতার, স্বাধীনতার গান।
খ) ২৭ মার্চ কীভাবে স্থানীয় নেতাদের এক উদ্ভট সিদ্ধান্তের বলি হয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শত শত সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাল—তা বইতে বর্ণিত। দা-বল্লম হাতে সাধারণ মানুষগুলো গিয়েছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেই সেনানিবাস ঘেরাও করতে। এদের থেকে সেনানিবাস রক্ষা করতে পাকিস্তানি হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। দিনে-দুপুরে ৫/৬ শত মানুষ হত্যা করে তারা, যেখানে বাঙালি সব অফিসারই ছিলেন একধরনের বন্দী। সেই বন্দী দশায়ই পাক আর্মি অফিসারদের নেতৃত্বে কীভাবে লাশগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল—তার জীবন্ত সাক্ষী নাসির উদ্দিন।
বিজয়ের মাস এলে এরকম হাজারো যোদ্ধা ফিরে আসেন স্মৃতিতে, শহীদেরা আমাদের প্রাণিত করে যায়। বহু ঘটনায় কখনো লোম খাড়া হয়ে ওঠে, কখনোবা ইতিহাসের পাঠ থেকে জেগে উঠে প্রচণ্ড এক ক্রোধ।
বিজয়ের মাস এলেই বাংলাদেশে নামে এক ভিন্ন আবহ—উদ্দীপনার, স্মৃতির, গর্বের। ডিসেম্বর এলেই একাত্তরের শক্তিমান দিনগুলোর অনুরণন বাংলার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। মনে পড়ে সেই সময়টাকে—যখন ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বনে নেমেছিলেন মুক্তির অন্বেষায়। মাঠে-প্রান্তরে, জলে-জঙ্গলে, অজানা মৃত্যুকে সামনে রেখে তারা লড়েছিলেন এক জালিম স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। কারণ সামনে ছিল একটাই স্বপ্ন—একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।
নয় মাসের দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্তে রঞ্জিত। ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানি, কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবন—সবই গড়ে তুলেছিল এক নির্মম কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ’৭১-এর যুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ, অধিকার আদায়ের যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। এ ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট উচ্চারণ—নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মহাকাব্য।
এই যুদ্ধই চিহ্নিত করে দিয়েছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস—যারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হয়ে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সেই শব্দগুলো তাই আজও রয়েছে, এবং থাকবে। কারণ যখনই কেউ একাত্তরকে হেয় করতে চাইবে, যুদ্ধকে ভ্রান্ত ব্যাখ্যায় “দুই ভাইয়ের লড়াই” বলে চালানোর চেষ্টা করবে—তখনই মুক্তিকামী মানুষ এসব শব্দের তলোয়ার তুলে প্রতিবাদে দাঁড়াবে।
একাত্তরের ভিত্তিকে অস্বীকার করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে যারা আস্ফালন করে, তারা নাগরিক দায়িত্বের জায়গা থেকে সরে গিয়ে অন্য এক মানসিক ভূগোলের বাসিন্দা হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের অস্তিত্ব তাদের কাছে যতই অস্বস্তিকর হোক না কেন, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুতির কোনো নৈতিক অধিকার কারও নেই।
তাই বিজয় দিবস শুধু উৎসব নয়—এ দিন প্রতিবাদেরও পবিত্র উচ্চারণ। যে চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমাদের পূর্বপ্রজন্ম যুদ্ধ করেছেন, যে মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এই দেশ তৈরি করেছেন—সেই চেতনা এক অনিঃশেষ কবিতা। সেই কবিতাই বাঙালিকে শেখায় আগামীর গান গাইতে—সংহতির, মানবিকতার, স্বাধীনতার গান।
লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম