ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বহুমুখী দুর্যোগ সক্ষমতায় করণীয় : করোনা বন্যা ঘূর্ণিঝড় প্রসঙ্গ

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:৪৫ এএম, ০৭ জুলাই ২০২০

ড. আব্দুল্যাহ আল মারুফ

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানামুখী দুর্যোগের সাথে বসবাস করে আসছে। ১৯৮৮ ও ৯৮ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা এবং চলতি বছর আম্ফানের মতো ঘূর্ণিঝড়সহ ছোট-বড়, মাঝারি মাত্রার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে খাপ খেয়ে আসছে বাংলাদেশ। এর সাথে বিভিন্ন সময় যোগ হয়েছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট যার মধ্যে ১৯৯৭ সালের এশীয় এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট অন্যতম।

তবে আশার কথা হচ্ছে, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক সংকটের সাথে এ দেশের মানুষ যেভাবে তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে তা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং শিক্ষণীয় তো বটেই। তবে সমসাময়িক করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিতে যখন দেশ ও গোটাবিশ্ব অনেকটা অসহায় তখন সাম্প্রতিক দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং উজান থেকে নেমে আসা পানিতে দেশের উত্তর এবং উত্তরপূর্ব অঞ্চলের বন্যা এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও জটিল করে তুলেছে যা মানুষের কাছে বেশ অপরিচিত।

মানুষ শুধু একমুখী দুর্যোগ দিয়েই সংক্রমিত হচ্ছে না; এক দুর্যোগের সাথে যোগ হচ্ছে অন্যটি যা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। তাই দুর্যোগবিষয়ক পঠন-পাঠন এবং গবেষণায় বহুমুখী দুর্যোগ সক্ষমতা বা মাল্টি হ্যাজার্ড/ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্স বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন গুরুত্বসহকারে ভাবা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বহুমুখী দুর্যোগ বা মাল্টি হ্যাজার্ড/ডিজাস্টার এর প্রবণতা বাড়ছেই বা কেন?

সহজ ভাষায় বলা যায়, পৃথিবী তার বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যহীনতায় যত ভুগতে থাকে বহুমুখী দুর্যোগ বা মাল্টি হ্যাজার্ড/ডিজাস্টারের প্রবণতা ততই বাড়তে থাকে। পৃথিবী তার নিজস্ব একটি সিস্টেমে চলে। এই সিস্টেমের ভারসাম্যহীনতা প্রাকৃতিক এবং মানবিক উভয়ই কারণেই হয়ে থাকে। একটি দুর্যোগ যেমন অন্য একটি দুর্যোগ সৃষ্টির জন্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করে তেমনি একটি দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য পরিচালিত অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডও অন্য ধরনের আরেকটি দুর্যোগ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষ অপরিকল্পতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, বনজসম্পদ আহরণ, নদীভরাট, বাঁধনির্মাণ, অতিরিক্ত পানি-ভূমি ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে দুর্যোগে সক্ষমতা বাড়লেও অন্যদিকে বায়ুদূষণ, মরুকরণ, খাবার পানির সংকট ও ভূমি অবনয়নসহ বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো জটিল পরিস্থিতিও তৈরি করে। আর এ রকম সংকটময় পরিবেশ বায়ু এবং পানিবাহিতসহ আজকের করোনার মতো মহাদুর্যোগের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়। এভাবেই প্রাকৃতিক, মনুষ্যসৃষ্ট এবং বায়োলজিক্যাল দুর্যোগের সমন্বয়ে গঠিত বহুমুখী দুর্যোগ বা মাল্টি হ্যাজার্ড/ডিজাস্টারের মতো একটি সংকটকাল সৃষ্টি হয়। এই করোনাকালে ঘূর্ণিঝড়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা বহুমুখী দুর্যোগ সংক্রমণের একটি বড় উদাহরণ। একদিকে যেমন করোনা একটি সম্পূর্ণ নতুন মহামারি, অন্যদিকে একই সময়ে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় এবং চলমান বন্যার নানা ধরনের ঋণাত্মক প্রভাব। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে এ রকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমাদের করণীয় কী তা খোঁজা খুব জরুরি।

দুর্যোগব্যবস্থাপনা জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুসারে বলা যায়, বহুমুখী দুর্যোগ প্রশমন বা এর সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য প্রয়োজন একটি প্রযুক্তিগত জ্ঞানলব্ধ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টেকসই সমাজ। আর এ রকম একটি সমাজগঠনে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সামগ্রিক ভূমিকা খুবই প্রয়োজন। এখানে বলে রাখা ভালো, এসব বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশলে ভৌগোলিকভাবে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পার্থক্য দেখা যায়। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে আজকের এই করোনা দুর্যোগে একই সাথে বন্যা, সাইক্লোন, আম্ফানের মতো ঘটনার ঝুঁকি কমানোর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা যেতে পারে।

প্রথমত, একই সাথে বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। বাংলাদেশ দুর্যোগব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ তে (২০১২ সালের ৩৪ নং আইন) দুর্যোগ মোকাবিলাবিষয়ক কার্যক্রমকে সমন্বিত, লক্ষ্যভিত্তিক ও শক্তিশালী করা এবং সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও একই সময়ে একাধিক দুর্যোগ যেমন করোনা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সাংগঠনিক কাঠামোর কথা সুস্পষ্ট নয়। দুর্যোগব্যবস্থাপনা কাঠামোতে ৪১টি বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হলেও বুহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে তার ওপর জোর দেয়া এখন সময়ের দাবি।

জাতীয় দুর্যোগব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) দেখা যায়, প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন বিপর্যয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হলেও একই সময়ে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ করোনার মতো মহামারি সময়ে ঘটলে সেক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে কমিউনিটি পর্যায়ে করণীয় এবং সমন্বয় কেমন হবে তা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট নয়। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ ব্যক্তির সমন্বয়ে বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয়মুখী আলাদা একটি ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। যারা একই সময়ে সংগঠিত বিভিন্ন দুর্যোগের ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক প্রভাব আমলে রেখে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুর্যোগের তিনটি স্তরেই (প্রস্তুতি, প্রশমন, উত্তরণ) করণীয় সম্পর্কে বলবেন।

দ্বিতীয়ত, প্রাইমারি থেকে টারশিয়ারি পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে বহুমুখী দুর্যোগ বা মাল্টি-ডিজাস্টার বিষয় গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মকে বুঝতে হবে মানবস্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপাশি পৃথিবীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখাও অত্যাবশক। অধুনা “প্লানেটারি হেলথ” বিষয়ক পড়াশোনা দুনিয়াব্যাপী বেশ আলোচিত যেখানে মানুষ এবং পৃথিবী উভয়ের সুস্বাস্থ্যের সাম্যাবস্থা নিয়ে জ্ঞান আহরণ করা হয়। বিষয়টি মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতি থেকে সম্পদ আরহণের টেকসই কৌশল শেখায়। সময়য়ের সাথে দুর্যোগবিষয়ক পড়াশোনায় উপযোগী পরিবর্তন করা প্রয়োজন। জাতীয় দুর্যোগব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে লিডারশিপের বিষয়ে গুরুত্বসহকারে বলা হয়েছে, যার ভিত্তিই হচ্ছে অনেকটা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন। পাঁচ বছরব্যাপী এ পরিকল্পনায় রিস্ক, গভর্নেন্স, রেজিলিয়েন্স এবং প্রিপিয়ার্ডনেসের মতো চারটি অগ্রাধিকারের পাশাপাশি বহুমুখী দুর্যোগবিষয়ক সক্ষমতাকেও অগ্রাধিকার হিসেবে নেয়া এখন সময়ের দাবি।

তৃতীয়ত, দুর্যোগবিষয়ক পড়াশোনায় বলা হয়ে থাকে, বহুমুখী দুর্যোগ প্রশমনে উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন এবং কারিগরি দক্ষতা একটি সমাজব্যবস্থা খুব জরুরি। আনুষ্ঠানিক উদ্ভাবনী দক্ষতার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক উদ্ভাবনী দক্ষতাকে (যেমন, মিশ্র ও ভাসমান কৃষি) উৎসাহিত করা এবং বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলায় নীতি প্রণয়নে এগুলো অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বাংলাদেশে স্থানীয় জনপদ আলাদাভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় নানা ধরনের কৌশল উদ্ভাবন করে আসছে কিন্তু এসব কৌশল করোনার মতো মহামারির সময়ে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে তার দিকনির্দেশনা রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত থাকতে হবে। বর্তমান সরকার কর্তৃক কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে এর আগ্রহ খুবই কম দেখা যায়। কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝোঁক বাড়াতে বিভিন্ন পর্যায়ে বৃত্তিসহ কিছু বিশেষায়িত প্রোগ্রাম হাতে নেয়া যেতে পারে।

চতুর্থত, বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বহুমুখী পেশা এবং বৈচিত্র্যময় কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু একমুখী পেশা এবং কৃষি দুর্যোগে ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ পেশার পাশাপাশি বিকল্প পেশায় দক্ষতা থাকলে দুর্যোগকালে তা কাজে লাগানো যায় এবং জীবিকানির্বাহে পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। এই করোনাকালে অনেকেই চাকরি হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে অভিগমন করছে। কিন্তু এই সময়ে বিকল্প দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তারা বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে পারে। কৃষককেও তার গতানুগতিক কৃষি কর্মকাণ্ডের বাইরে নানামুখী কৃষি পদ্ধতির দিকে ধাবিত করতে হবে যাতে দুর্যোগের প্রভাবজনিত পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

পঞ্চমত, স্বাস্থ্য সাক্ষরতা বা হেলথ লিটারেসি। আনুষ্ঠানিক সাধারণ সাক্ষরতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেলেও স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতায় কতটা আমরা পিছিয়ে তা এই করোনাকালে সহজেই বোধগম্য। নানা ধরনের পদক্ষেপের পরও মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি কাজে তুলনামূলকভাবে মানুষের উদাসীনতা দুর্বল স্বাস্থ্য সাক্ষরতার প্রতিচ্ছবি। যেকোনো মহামারিসহ অন্যান্য দুর্যোগকালে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও দুর্বল স্বাস্থ্যশিক্ষার কারণে তা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে চায় না যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়া পারিবারিক দুর্যোগকালীন মূলধন গঠন, ঘরভিত্তিক আয় উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড, বহুমুখী দুর্যোগে ওয়ার্নিং সিস্টেমের উন্নয়ন, মোবাইলভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের মতো উল্লেখযোগ্য কৌশলগুলো বহুমুখী দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দুর্যোগের মতো প্রতিকূল পরিবেশের সাথে এ দেশের মানুষের যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা একটি পরিচিত ঘটনা।

এই মহাআপদকালীন মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, কূলের মানুষের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করার অদম্য শক্তি, ঝুঁকি নেয়ার সক্ষমতা, প্রতিটি দুর্যোগ শেষে স্থানীয়ভাবেই নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ, পেশা পরিবর্তনের অভিযোজন শক্তি, আমাদের এ সংকট থেকে উদ্ধার করবেই। একমুখী দুর্যোগ সক্ষমতা অর্জনের মতো বাংলাদেশ বহুমুখী দুর্যোগ সক্ষমতায়ও পৃথিবীর কাছে অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/পিআর