ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের অবর্ণনীয় সংকট

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ৩০ মে ২০২১

প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের একটি প্রাইভেট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সেদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘শিক্ষক-কর্মচারী, স্কুল ঘরের ভাড়া সবকিছু নিয়ে আমরা কি করে বেঁচে আছি, কেউ কি জানে? কতদিন আর এমন দুঃসহকাল চলবে’? একই স্কুলের একজন শিক্ষক বললেন, গ্রামে আমার মা-বোনদের দেখতে হয়। ঢাকায় বাসাভাড়া, খাওয়া খরচ আছে। স্কুল, টিউশনি সব বন্ধ। হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই কি করে চলি বলেন তো?

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ শিক্ষকের দুর্দশা ও কষ্টের কথা শুনলে যে কারও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। এমনিতেই আমাদের যাপিত জীবনে যন্ত্রণার শেষ নেই, তার ওপর করোনাভাইরাসের করাল কষাঘাতে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে ব্যয় কমছে না, কমছে আয়। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্য সামগ্রীর দাম বাড়ছে আর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিংবা সীমিত হয়ে পড়ছে আয়ের পথ বা উৎস।

একটা কথা ইদানীং কারও কারও মুখে শোনা যায় যে, 'ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল-কলেজ গজিয়েছে দেশে'। হ্যাঁ, কথা একেবারে অসত্য নয়। এই যে আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে, সেটা কি এমনি এমনি? ব্যক্তিগত উদ্যোগে, হয়তো বাণিজ্যিক চিন্তায় পাড়া-মহল্লায় এই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোই দেশে শিক্ষিতের হার বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। জ্ঞান বিতরণের সূতিকাগার হিসেবেও কাজ করছে খানিকটা। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রাথমিক শিক্ষার ত্রিশ ভাগ পূরণ হয়। বাচ্চারা যখন হাঁটতে শেখে, আধো আধো বুলিতে কথা বলতে শুরু করে, তখন পাড়ার স্কুলেই তাদের শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম পাঠ । টিফিনের সময় পাড়া মহল্লার স্কুলগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চাদের কিচির-মিচির, কোলাহল মুখরিত দৃশ্য হৃদয়ে দারুণ আনন্দময় অনুভূতি জাগায়।

শিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, কথা আছে। দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষার বেশিরভাগই সরকারি ব্যবস্থাপনা বা কারিকুলামের বাইরে। মাঝে মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কারিকুলামের খসড়া দেওয়া হয়। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। স্কুলগুলো কী পড়ায়, শিক্ষকের মানই বা কেমন, ব্যবস্থাপনা কেমন সে সবে সরকারের কোনো নজরদারি নেই। অবশ্য সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন আছে। অভিজ্ঞ জনেরা বরং এটাও বলেন যে, প্রাইভেট স্কুলগুলোতে যতটা যত্ন এবং আন্তরিকতা নিয়ে পাঠদান করা হয় সরকারি এবং ক্ষেত্র বিশেষে বেসরকারি স্কুলগুলোতে তেমনটা হয় না (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। এর যৌক্তিক কারণও আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকতে হয়, যা সরকারি স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে ঘটে না।

এসব বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে, এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের দুঃসহ জীবন যাপনের কথা বলা যেতে পারে। খুব নামকরা অল্পকিছু ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ব্যতিরেকে বাকিদের অর্থনৈতিক অবস্থা কোনো সময়ই খুব ভালো না। ঢাকা শহরের সিংহভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় ভাড়াবাড়িতে এবং এগুলোর আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের বেতন । বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, পানির বিল (বাণিজ্যিকভাবে) পরিশোধ করার পর পরিচালকের হাতে যে অর্থ থাকে তা দিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের যে বেতন দেওয়া হয় তা লজ্জাকর। শিক্ষকদের বেশিরভাগই প্রাইভেট টিউশনির মাধ্যমে সমন্বয় করে জীবন চালাতে বাধ্য হন। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, সত্যিকার অর্থেই তাদের মানুষের জীবন নয়। যে দেশে আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে কোনো ভারসাম্য নেই, সেখানে মানুষের মতো করে জীবন যাপন করা আসলেই দুঃসাধ্য। তবুও পুরোপুরি বেকারত্বের চেয়ে সম্মানের এই পেশাতে নামমাত্র সম্মানীতে জড়িয়ে গেছেন দেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ।

দুঃসাধ্যের এই জীবনে আর সবকিছুর মতো করোনাকালের থাবায় নিশ্বাস নিতে পারছেন না প্রায় ৬০ হাজার প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই ২০ লাখ মানুষ। এক বছরেরও বেশি সময় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অন্যসব প্রতিষ্ঠান নামমাত্র বন্ধ বা লকডাউন হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানগুলো আক্ষরিক অর্থেই একেবারে বন্ধ। আবার দীর্ঘ এই বন্ধের সময় শিক্ষকদের টিউশনিও বন্ধ রয়েছে, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের উপার্জনের দুটি পথই । এই অবস্থায় জীবিকা নির্বাহ করাটা কতটা দুরূহ তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন ।

কতদিন পর এসব প্রতিষ্ঠান খুলবে কেউ জানেন না। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকম হবে বা হতে বাধ্য। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, আবারও কাজ হারাবে লাখ লাখ মানুষ। মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হবেন অসংখ্য পরিবার। আমাদের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশে করোনা আরো কঠিন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কেউ কেউ বেঁচে থাকার জন্য পেশা বদলেও বাধ্য হয়েছেন। লন্ড্রি, মুদি দোকান, চায়ের দোকান খুলে আয়ের উপায় খুঁজছেন। কিন্তু এসব কাজে আগে থেকেই যারা আছেন, তারাও তো এখন সংকটের মধ্যেই আছেন। তবে এ মুহূর্তে ভবিষ্যতের অজানা আতঙ্কে দিশেহারা হওয়া কোনো সুস্থির কাজ নয়। বরং বর্তমানে এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সেটাই বিবেচ্য। এ অবস্থায় সরকারের এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। বিনা সুদে এবংসহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। সরকার নানা খাতে প্রণোদনা দিচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষা খাত এর আওতার বাইরে থাকবে কেন?

মানুষ গড়ার কারিগরেরা মানবেতর জীবন যাপন করবে, না খেয়ে থাকবে তা কী মানা যায়? জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এই সময়ে এসে দেশে আবার নতুন করে নিরক্ষরতার হার বাড়ুক ,শিক্ষার্থী ঝরে পড়ুক, শিক্ষকরা অন্য পেশা গ্রহণ বাধ্য হোক তা কারো কাম্য হতে পারে না। তারচেয়ে বরং সভ্যতার বিকাশে আলো ছড়ানো মানুষগুলোর সুস্থভাবে টিকে থাকার গল্প তৈরি হোক নতুন করে। সুদিন আসুক শীঘ্রই।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন