টুকরো টুকরো কোভিড
চেম্বারে ঢোকার পর থেকেই খুক খুক করে কেশেই চলেছেন ভদ্রলোক। পরিবেশটা একটু অস্বস্তিকরই বটে। অস্বস্তিতে আমি, আমার চেম্বার সহযোগীরা, চেম্বারে উপস্থিত অন্য যারা তারাতো বটেই, আর অবশ্যই ভদ্রলোকও। বেশ বুঝতে পারছি শত চেষ্টায়ও তিনি কাশি চাপতে পারছেন না। মাস্কটা অবশ্য যথারীতি থুতনিতেই ঝুলছে। আমার চেম্বার সহকারী এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই ভদ্রলোককে মাস্কটা ঠিক-ঠাক মত পরতে অনুরোধ করলো। অস্বস্তিতে রোগীর স্ত্রীও। শুনতে পেলাম আস্তে আস্তে হাসবেন্ডকে বলছেন, ‘কাশিটা চাপো, না তো ডাক্তার বুঝে ফেলবেন তোমার কোভিড আছে।‘
দুই.
ভদ্রলোক প্রায় ঘন্টা তিনেক অপেক্ষার পর অবশেষে আমার চেম্বারে ঢোকার সুযোগ পেয়েছেন। যথেষ্ট বিরক্ত। বিরক্তির প্রকাশ তার চোখে-মুখে। না হবার কোন কারণও অবশ্য নেই। আমার বেলায় অমনটি হলে আমিও এমনই বিরক্ত হতাম। সমস্যা হচ্ছে উপায় নেই। রোগীর চাপ আর উটকো চাপ করোনাকালে ভার্চুয়াল মিটিংয়ের বাড়াবাড়ি। ভদ্রলোকের বিরক্তিটাকে পাশ কাটিয়ে তাই পরিবেশটা সহজ করার চেষ্টা করি। কুশল বিনিময় আর দু একটা এলেবেলে আলাপ-চারিতার পর তার রিপোর্টগুলো নিয়ে বসলাম। তার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বেশ বুঝতে পারছি আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্যটা সফল হয়েছে।
তার বিরক্তিটা কেটে গেছে। তবে এবার আমার বিরক্ত হবার পালা। কারণ ভদ্রলোক যে রিপোর্টের গোছাটা আমাকে গছিয়ে দিয়েছেন, তার সর্বশেষ রিপোর্টটা বলছে তিনি কোভিড পজিটিভ। বিরক্তিটা চেপে যতটা সম্ভব হাসি হাসি মুখে জানতে চাইলাম তিনি যে এতক্ষণ ধরে কোভিড পজিটিভ হয়েও আমার চেম্বারের ওয়েটিং এরিয়ায় বসে আছেন, এতে তার সাথে অপেক্ষমান লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারের খারাপ রোগীগুলোর যে কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল, সে সম্বন্ধে তার কোন ধারণা আছে কি না। ভদ্রলোক অবাক হয়ে উত্তর দিলেন, ‘কিন্তু আমারতো কোন লক্ষণ নেই।’ বুঝলাম তিনি ভনিতা করছেন না, যা বুঝছেন এবং এতদিন ধরে বুঝে এসেছেন তাই বলছেন।
তিন.
এক বন্ধুর অফিসে কদিন আগে আড্ডায় বসেছি আমরা কজন। নানা পেশার মানুষ সেখানে। বন্ধুটি পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে গরম-গরম পেঁয়াজু আর ডালপুড়ি আনিয়েছেন। দেখলেই জিভে জলের জোয়ার আসার অবস্থা। এর মধ্যেই একজন বললেন, ‘আমি না হয় মাস্কটা না-ই খুলি’। আমরা কেউ আর চাপাচাপি করলাম না। সময়টাইতো এমন। এসময়তো এমনটাই সঙ্গত। খানিক বাদেই উঠে পড়লেন ভদ্রলোক। সবাই অনুরোধ করছে আরেকটু থেকে যেতে। পেঁয়াজু আর ডালপুড়িতে আড্ডাটা তখন জমজমাট। ভদ্রলোকও যে যেতে চাচ্ছেন না বোঝাই যাচ্ছে। তবুও তাকে যেতেই হচ্ছে। বুঝলাম জরুরি কোন কাজ পড়েছে নিশ্চই। নিজ থেকেই বললেন, ‘আমি কোভিড পজিটিভতো, ভাবছি একটু পরীক্ষা করে দেখে নেই নেগেটিভ হলাম কিনা।’ আমরা অবশ্য ততক্ষণে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বললাম, ‘নিশ্চই - বিষয়টাতো জরুরি। আপনি যান, আমরা কেউ কিছু মনে করছি না।’
চার.
ভদ্রলোক আমার চেয়ে বয়সে খানিকটা বড়। আমার খুব ভালো সিনিয়ার ফ্রেন্ড। হঠাৎ শুনলাম কোভিডে আক্রান্ত। ফোন করলাম খোঁজ খবর নিতে। জানলাম ভালোই আছেন। নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করছেন। মাস্ক ছাড়াই হাঁটছেন। তবে তিনি দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের কারণে জোরে হাঁটেন বলে তার সাথে অন্য যারা হাঁটেন তারা পাল্লা দিয়ে পারেন না। এই কোভিডেও এই ব্যাপারটা আগের মতই আছে। তিনি জোরে জোরে হাঁটছেন, বাকিরা তার সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না, কাজেই তার থেকে অন্য কারো কোভিড ছড়াবার কোন শংকা নেই। নিজের কোভিড-দায়িত্বজ্ঞানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ভদ্রলোক নিজেই। আমিও প্রশংসা করেই ফোনটা ছাড়লাম।
পাঁচ.
ঘটনাটা আমার এক জুনিয়ার সহকর্মীর কাছ থেকে শোনা। কোভিডের সেই শুরু থেকেই সে ঢাকার একটা নামকরা সরকারি কোভিড হাসপাতালে কোভিড রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের তত্ত্বাবধানে ভর্তি হয়েছিলেন একজন তরুণ ব্যাংকার। এটা ২০২০-এর শুরুর দিকের কথা। তখনও আইসিউই বেড অনেক অপ্রতুল। সংকট ছিল এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডারেরও। ব্যাংকার ভদ্রলোক খুব ওয়েল-কানেকটেড পরিবারের সন্তান। একটা সময় হঠাৎই খারাপ হতে শুরু করলেন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ক্রমেই ড্রপ করছে।
অনেক তদ্বিরে তার জন্য একটা আলাদা সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে কোন মতে ঠেকার কাজ চালানো হচ্ছিলো। অবশেষে পাওয়া গেল বহু কাঙ্খিত একটি আইসিইউ বেড। কিন্তু তাকে যখন আইসিইউতে শিফট করা হবে, তখনই বেকে বসলেন তরুণ ব্যাংকার। তিনি আইসিইউতে যাবেন না। আইসিইউর ঐ বেডটা তার পাশের বেডের দরিদ্র, বৃদ্ধ মানুষটিকে বরাদ্দ করার জন্য বারবার অনুরোধ জানাচ্ছেন তিনি চিকিৎকদের। তার অনুরোধে শেষমেষ তাই করা হলো। আইসিইউতে না গেলেও কদিন পর সুস্থ হয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন তরুণ ব্যাংকার।
ছয়.
আইসিইউতে যে হতভাগ্য মানুষগুলো ভেন্টিলেশনে থাকেন তারা মৃত্যুর সময় কতটা কি বুঝতে পারেন তা এক স্রষ্টাই ভালো জানেন। অন্তত আমরা যারা চিকিৎসক তাদের পক্ষে কখনই বোঝা সম্ভব না, ভেন্টিলেটারের ঐ হতভাগ্য রোগীদের শেষ মুহূর্তের অনুভূতি আর উপলব্ধিগুলো। এর ব্যতিক্রম অবশ্য একটা আছে। আর তা হলো কোভিড আক্রান্ত রোগীরা।
এরা যখন ভেন্টিলেটরে থাকা অবস্থায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকেন, তখন তাদের বোধশক্তি পুরোপুরি অটুট থাকে। এতটুকু অক্সিজেনের জন্য অসম্ভব কষ্ট পেতে থাকা এই মানুষগুলো যে কি প্রচণ্ড কষ্টকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তাদের শেষ সময়গুলো পার করেন তা লিখে বোঝানো অসম্ভব। পানিতে ডুবতে থাকা মানুষের কষ্টটা মনে হয় অনেকটা এরকম।
সাত.
এমনি অনেক টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা ঝুলিতে পুরে আমরা পার করছি প্যান্ডেমিকের আরেকটি বছর। সামনে আরো ক’টি নিউ নরমাল বছর আমাদের পারি দিতে হবে তা এখনও একেবারেই অনিশ্চিত। যে গল্পগুলো বললাম তার প্রতিটি বাস্তব থেকে নেয়া। বাস্তবতার সাথে এর কোন অমিল নেই। স্থান, কাল, পাত্র - এর কোন কিছুই সামান্যতম এদিক-সেদিক করা হয়নি। কোভিডকে আমাদের চেনার, বোঝার আর চেনানোর সাথে বোঝানোর বাকি এখন অনেকখানি। এই ফারাকটা যত তাড়াতাড়ি ঘুচিয়ে আনা যাবে, তাতেই বোধ করি সবার মঙ্গল।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস