দ্রব্যমূল্য ও শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া
![দ্রব্যমূল্য ও শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/mostofa-kb-20240302094104.jpg)
নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল হবে- এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। রমজানে দ্রব্যমূল্য ক্রয়সীমার বাইরে ঠেলে দেওয়ার স্পষ্ট আলামতের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন- বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ছে। বিদ্যুতের দামও বাড়তে যাচ্ছে। যদিও বাসা-বাড়িতে সার উৎপাদনে, সিএনজি,বাণিজ্যিক ও চা-শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য সমন্বয় অপরিবর্তিত থাকবে।
বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে তার প্রভাব পড়বে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে। শুধু তাই নয় গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়বে বিদ্যুতের। এমন পরিস্থিতিতে বাজার পরিস্থিতি মানুষের অনুকূলে থাকার কোনো সম্ভাবনাই রইলো না। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রোজার পর মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের যুক্তি আছে। ভর্তুকি কমিয়ে আনার বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের কথাও মানুষ জানে। মানুষ জানে বিশ্ববাজার পরিস্থিতিও। কিন্তু তারা জানে না বর্ধিত ব্যয়ের সংস্থানটা কিভাবে হবে। একইভাবে জানে না-নির্বাচন পূর্বকালে সরকারি দল যে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিলো, সেই চ্যালেঞ্জ আদৌ মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে কি না।
এই মুহূর্তে সরকারকে বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। স্বাভাবিক যুক্তিতে তারা এই ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে চাইবে। কিন্তু ভর্তুকি কমিয়ে আনতে গেলে এর চাপটা পড়বে সাধারণ মানুষের উপর। সাধারণ মানুষের কি ক্ষমতা আছে এই চাপ সহ্য করার মতো?
জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এটা পুরনো ঘটনা। কতটা মূল্য বৃদ্ধি করা হলো এটা সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বর্ধিত উৎপাদন ব্যয়ের কারণে পণ্যের মূল্য কতটা বাড়তে পারে এই বিষয়ে সরকারি দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে।
সরকারের একটি সিদ্ধান্তের কারণে উৎপাদনকারীরা পণ্যের মূল্য যথেচ্ছ বাড়িয়ে দিতে দেরি করে না। এটা বাংলাদেশের জন্য অতি সাধারণ ঘটনা।সরকার একটি খাতে মূল্য বৃদ্ধি করে কিন্তু এই জ্বালানি ব্যবহার করে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় তার মূল্য বৃদ্ধি হয় কয়েক ধাপে।
ধরা যাক, একটি পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়লো প্রতি ইউনিট ১ টাকা। সেক্ষেত্রে উৎপাদনকারী বাড়ালো ১ টাকা ১০ পয়সা। কিন্তু সেই পণ্যটি ভোক্তা পর্যন্ত যেতে যেতে দাম বাড়ে ২টাকা। যার পুরো চাপ পড়ে তৃণমূলের সাধারণ মানুষের ওপর।
উৎপাদনক্ষেত্র থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত যেতে যেতে যে অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিক মূল্য বেড়ে যায়, এর তদারকি কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। যে কারণে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না।
সরকারিভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেও তার সুফল পায় শুধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক হার কমানোর প্রতিক্রিয়া থেকে। রোজায় অধিক ব্যবহৃত পণ্য তেল, চিনি, খেঁজুর, চাল এর ওপর থেকে শুল্ককর কমিয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি। এই নিবন্ধ লেখা হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি। মানে শুল্কহার কমানোর পর ২১দিন গত হয়ে গেছে।
শুল্ককর কমিয়ে দেওয়ার পরও একটি পণ্যের দামও বাজারে কমেনি। উল্টো চিনি ও খেঁজুরের দাম বেড়ে গেছে। এর উল্টোচিত্র দেখা যায়, যখন শুল্ক বাড়ানো হয় কিংবা যে দেশ থেকে আমদানি করা হয় সেখানে দাম বাড়ার আভাস পেলে। এই ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধিতে মোটেও সময় লাগে না। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে সবধরনের পণ্যের মূল্য দ্রুত বেড়ে যায়।
ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের কৌশল হিসেবে আমদানিকৃত খেঁজুর চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস না করে ফেলে রাখার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি দৈনিক পত্রিকায়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ব্যবসায়ীরা মনে করেছিলো অধিক হারে শুল্ক কমানো হবে রোজাকে সামনে রেখে। সেই সুবিধা গ্রহণের আশায় তারা আমদানিকৃত খেঁজুর খালাস করেনি। এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বাজারে। শুল্ক হার কমানোর পরও বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় খেঁজুরের দাম বেড়ে গেছে।
খেঁজুরের শুল্ক কমানো হয়েছে, এমন সংবাদ যখন গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে, ঠিক ওই সময় ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, তারা খেঁজুর আমদানি তে তাদের কেজি প্রতি খরচ ১১০টাকা। কিন্তু সেই খেঁজুরে তাদের শুল্ক দিতে হয় ১৪০টাকা। ফলে খেঁজুরের দাম দ্বিগুণ তিনগুণ পড়ে যায়। তাঁর এই বক্তব্য প্রকাশিত সংবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সত্যটা জানা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ী প্রতিনিধির বক্তব্যকে মেনে নিলেও বাজারের সঙ্গে কি মিল পাওয়া যায়? বাজারে খেঁজুরের সর্বনিন্ম দাম সাড়ে ৪শ’ টাকা হওয়ার পর কি যুক্তি থাকতে পারে?
দেশে উৎপাদিত চিনি ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, বিএসএফআইসি নিয়োজিত ৮০০ ডিলার মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত চিনি বাজারে ছাড়া হয়। তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে এসব চিনি কারখানাগুলো থেকে কিনে নিয়ে মিলগেটেই অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়। ওই ব্যবসায়ীরা সেসব চিনি প্যাকেটজাত করে অধিক মূল্যে বাজারে বিক্রি করে। যে কারণে ১৪০টাকা কেজি দরের চিনি কোথাও কোথাও ১৭০টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে।
আসলে সব নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেই কম বেশি এমন অবস্থাই দেখা যাচ্ছে। মনে হতে পারে বাজার ও সাধারণ ভোক্তা ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। সরকারের মূল্য বৃদ্ধির নির্দেশনা দ্রুত কার্যকর হয়ে গেলেও মূলহ্রাসের উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের ইচ্ছার কাছে। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের সরকারের সদিচ্ছা পূরণ হচ্ছে না। আবার দেশীয় উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধিকেও কাজে লাগানো হচ্ছে অতি মুনাফা লাভের ক্ষেত্র হিসেবে।
২৮ তারিখে এফবিসিসিআই মিলনায়তনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর মত বিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের মতামতগুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাজার মনিটরিং এ পুলিশ নিয়োগ হলে ব্যবসায়ীদের জন্য এটা শোভন হবে না। প্রতিমন্ত্রী মহোদয় ব্যবসায়ীদের সম্মান রক্ষায় একথা বলেছেন বোঝা যায়। ব্যবসায়ী নেতারাও তেমনি বলেছেন। পুলিশী হয়রানি যাতে না হয় তারা আবেদনও জানিয়েছেন। বলেছেন এফবিসিসিআই বাজার মনিটরিং করবে।
যতটা মনে আসে গত রমজানেও ব্যবসায়ী নেতারা এমন কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ করে দিয়েছে। সেই অবস্থায় ব্যবসায়ীদের সম্মান রক্ষায় ব্যর্থতার দায় কি তাদের ওপর বর্তাবে না? গত বছরের ব্যর্থ উদ্যোগকে এবার আবার চালানোর অর্থ হবে, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য হাসিলে সহযোগিতা করা। বাজার মনিটরিং যদি ব্যবসায়ীদের হাতেই থাকে তাহলে এটা হবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার মতো।
২৮ ফেব্রুয়ারির মত বিনিময় সভাতেই ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন,পণ্যের মজুত চাহিদা অনুযায়ী আছে তাই রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তিনি যখন এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন, ওই সময়ের বাজার পরিস্থিতি কি তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে কি?
শুধু এটুকু বলা যায়, তাদের এমন সুন্দর বক্তব্যগুলো যে সত্য এবং আন্তরিক তা প্রমাণ করুন। ব্যবসায়ীরা সৎভাবে ব্যবসা করে মুনাফা করবে এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু মুখে এক কথা আর কাজে তার বিপরীত হলে যে কেউই বলবে বাজার নিয়ন্ত্রণে পুলিশী ব্যবস্থা জোরালো করা হোক। ব্যবসায়ীরা নিজেরা যদি নিজেদের সম্মান রাখতে না চান তাহলে তাদের অসম্মান ঠেকাবে কে? একইসভায় বলা হয়েছে বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে রমজান উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য কমিয়ে দেয়। অথচ তারা মুখে এমন উদাহরণ দিলেও দোকানে গিয়ে করেন উল্টোটা।
বর্তমান সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সভায়ই প্রধানমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারিতে সচিবসভায়ও একই নির্দেশনার সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। যা নির্বাচন পূর্বকালে আওয়ামী লীগের ঘোষণারও অংশ ছিলো। ব্যবসায়ীদের বক্তব্যও রমজানে পণ্যমূল্য বাড়বে না। তাই বলা যায় সরকার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে দূরত্ব বেশি নয়। তাদের স্ববিরোধিতা দূর হোক, সরকার প্রধানের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হোক। তাইলে যদি জনমনে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএস